মানুষ যে পরিবেশে বাস করে সেই পরিবেশ একটি নির্দিষ্ট আবর্তন চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবর্তন চক্রে কোন ব্যাঘাত ঘটলেই পরিবেশের উপর তার কিছু কুপ্রভাব পড়ে, পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, পরিবেশ দূষিত হয়, মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এইভাবে পরিবেশ দূষণের একটি উদাহরণ হ’ল ফসলের রোগ ও পোকা দমনের জন্য অনিয়ন্ত্রিত ও অনাবশ্যকভাবে রোগনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার। সব রাসায়নিকই কম বা বেশী বিষাক্ত। রোগ ও পোকা দমনের সাথে সাথে রোগ ও কীটনাশকগুলি চাষের প্রতিবেশের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। ফলে ফসলের উপকারী জীবাণু, মাকড়সা ও বন্ধুপোকা মরে যায়। পরবর্তী কালে ফসলের ক্ষতিকারক রোগ ও পোকার বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

যে কোন চাষের জমিতে কিছু না কিছু রোগ ও পোকার আক্রমণ ঘটবেই। রোগ ও পোকার আক্রমণ হলেই যে ফসলের ক্ষতি হবে তা নয়। ফসলের ক্ষতি নির্ভর করে আক্রমণের তীব্রতার উপর। সাধারণত দুটি কারণে ক্ষেতে তীব্র ও ব্যাপক আক্রমণ দেখা যায়।
১. রোগ ও পোকা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ।
২. ফসলের রোগ ও পোকার সহনশীলতার অভাব।
রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা দিলেই রোগ বা কীটনাশক-রাসায়নিকের দ্বারা দমন ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় না।

শুধুমাত্র রোগ ও কীটনাশক-রাসায়নিকের উপর নির্ভর না করে, ফসল চাষের শুরু থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে রোগ ও পোকা আক্রমণের প্রকোপ কমানো বা এড়ানোর পদ্ধতিকেই বলা হয় সুসংহত উপায়ে ফসলের রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ। পদ্ধতিগুলি নীচে আলোচনা করা হল —



*১. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:*
_বন্ধু পোকার মাধ্যমে:_ ফসলের যেমন ক্ষতিকারক রোগজীবাণু বা পোকা আছে তাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক শত্রুও আছে। এরা ক্ষতিকারক রোগের ছত্রাক বা জীবাণু এবং পোকা মাকড়কে আক্রমণ করে ও তারপর মেরে ফেলে বা খেয়ে নেয়। পোকা মাকড় বা রোগ শত্রু দমনে এইসব প্রাকৃতিক শত্রু আমাদের খুব উপকারী। এদের আমরা মিত্রপোকা বা বন্ধুজীব বলি। অযথা নির্বিচারে রাসায়নিক প্রয়োগে এই সমস্ত বন্ধুপোকা ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ক্ষেতে ক্ষতিকারক রোগজীবাণু ও পোকার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে ও ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বিনা প্রয়োজনে রোগ বা কীটনাশক প্রয়োগ করে এদের ধ্বংস করা ঠিক নয়।

ক্ষেতে যথেষ্ট পরিমাণে মিত্রপোকা থাকলে শত্রুপোকারা বাড়তে পারে না। অনিষ্টকারী পোকা ও মিত্রপোকার মধ্যে একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য আছে। বিচার বিবেচনাহীন ভাবে রোগ বা কীটনাশক প্রয়োগ করলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। কয়েকটি বন্ধুপোকার নাম হল মাকড়সা, লেডি বিটল, গ্রাউন্ড বিটল, পিঁপড়ে, বোলতা, ঘাস ফড়িং, ড্যামসেল ফ্লাই, ট্রাইকোডারমা, ব্যাসিলাস, ভাইরাস ইত্যাদি। বন্ধুপোকা বা জীবাণুরা বিভিন্নভাবে অনিষ্টকারী পোকাকে ধ্বংস করে। কেউ সরাসরি খাদ্য হিসাবে খেয়ে নেয়, কেউ শত্রুপোকার উপর ডিম পেড়ে তার থেকে রস শুষে নেয়, আবার অনেক সময় কিছু বিষাক্ত পদার্থ বার করে ক্ষতিকারক রোগ জীবাণু বা পোকাকে ধ্বংস করে।
*_২. আধুনিক চাষ পদ্ধতি:_* প্রথমেই প্রয়োজন সুস্থ বীজের ব্যবহার। সেই সঙ্গে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সারের সুষম ব্যবহার। মনে রাখা দরকার জমিতে পটাশ সারের ঘাটতি থাকলে রোগ ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। জৈবসার ব্যবহার করতে হবে, জমিকে আগাছা মুক্ত করে রাখতে হবে এবং সঠিকভাবে সেচের জল ব্যবহার করতে হবে।
*_৩. রোগ ও পোকার সহনশীল জাত ব্যবহার_*
এলাকা ভিত্তিক রোগ ও পোকার সম্ভাবনা বিচার করে জাত নির্বাচন করতে হবে। বিশেষত রোগ দমনের ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরী। এছাড়াও বীজ লাগানোর আগে শোধন করে নিলে বীজ-বাহিত রোগ দমন করা যায়।
*_৪. যান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ_*
পোকার ডিম নষ্ট করা তুলনামূলক ভাবে সহজ। পাখী বসার জন্য ডাল পোঁতা যায়, যারা পোকা ধরে খায়। তাছাড়া সেক্স ফেরোমনও ব্যবহার করা যেতে পারে।
*_৫. রাসায়নিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ_*
সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে রোগ বা পোকার আক্রমণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করে সঠিক রোগ বা কীটনাশক সঠিকভাবে এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

সুসংহত উপায়ে ফসলের রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য কী কী
করণীয় সংক্ষেপে দেওয়া হল।
১. রোগ বা পোকা সহনশীল জাত নির্বাচন।
২. বীজ শোধন ও সঠিক সময়ে বপন।
৩. গভীরভাবে চাষ ও মাটি যাতে পর্যাপ্ত রোদ পায়, তার ব্যবস্থা করা।
৪. আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলা এবং নিজে থেকে গজানো গাছ মেরে ফেলা।
৫. জৈব/সবুজ সারের ব্যবহার।
৬. নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সারের সুষম ব্যবহার ও পরিমাণমত সেচ।
৭. মিশ্রচাষ পদ্ধতি।
৮. সেক্স ফেরোমন বা আলোক ফাঁদ ব্যবহার।
৯. বন্ধুপোকা বা উপকারী ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস ব্যবহার।
১০. সপ্তাহে দুই দিন মাঠ ঘুরে রোগ ও পোকার উপর নজর রাখা।
১১. চরম সীমা (যে পরিমাণ থাকলে রোগ বা পোকা ফলনের ক্ষতি করতে পারে) অতিক্রম করলেই রোগ বা কীটনাশক প্রয়োগের কথা বিবেচনা করা।


[ *লেখক পরিচিতি: ড. অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম কৃষি অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার* ]

_প্রস্তুত প্রবন্ধটি ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র জৈবকৃষি বিশেষ সংখ্যার অন্তর্গত। ১ লা ডিসেম্বর, ২০২০। সম্পাদক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।_ ( _Bharatiya Kishan Barta, Organic Farming Special Issue, 1 December, 2020, Editor: Dr. Kalyan Chakraborti)_

ড. অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.