১.
রাসায়নিক বা অজৈব সার হিসাবে কৃষকেরা যে নামগুলির সঙ্গে পরিচিত তা হচ্ছে ইউরিয়া, ক্যান বা ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, অ্যামোনিয়াম সালফেট, সিঙ্গল সুপার ফসফেট বা এসএসপি, ডাই এমোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি, মিউরিয়েট অফ পটাশ বা এমওপি, সুফলা, গ্রোমোর, এনপিকে ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে নানান মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম থাকে, এগুলি কৃত্রিম সার, কলকারখানায় তৈরি করতে হয়, ব্যবহারের জন্য খরচও অনেক বেশি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক জৈবসারের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব, খরচসাশ্রয়ী, স্বনির্ভরতা একটি নাম। জৈবসারের মধ্যে রয়েছে খামারজাত জৈবসার বা ফার্মইয়ার্ড ম্যানিওর, কম্পোস্ট সার, ফসফোকম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, পোল্ট্রি-খামারজাত সার, খোল বা অয়েল কেক, বর্জ্যসার (যেমন চিনি কারখানার বর্জ্য, কষাইখানার বর্জ্য) এবং সবুজ সার ও সবুজপাতা সার। রাসায়নিক সারে উদ্ভিদের খাদ্যোপাদান যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম প্রভৃতি উচ্চমাত্রায় থাকে, তাই পরিমাণে কম লাগে; কিন্তু জৈবসারে মূল খাদ্যোপাদান বা পুষ্টিমৌলগুলি কম পরিমাণে থাকায় পরিমাণে বেশি লাগে। এই বেশি লাগার কারণে মাটির সদর্থক ভৌতগুণগুলি বেড়ে যায়, বেড়ে যায় মাটির নানান উপকারী জীবাণুর দল, গাছের শ্রীবৃদ্ধি কাঙ্খিত মাত্রায় হতে থাকে।
২.
খনার বচনে আছে, “গোয়ে গোবর, বাঁশে মাটি। অফলা নারিকেল শিকড় কাটি।” গোবর সার সম্পর্কে আরও একটি প্রবাদ হল, “তামাক ক্ষেতে গোবর সার। তামাক বাড়ে বেজায় বাড়।” অর্থাৎ সুপারি, তামাক প্রভৃতি ফসলে সার হিসাবে উত্তমরূপে পচানো গোবর অনবদ্য। সকল ফসলেরই গুণগত মান বাড়ে গোবর সারে। এতে রয়েছে ফসলের প্রাণশক্তি, সকল অণুখাদ্য, বীজ উৎপাদনের অসামান্য ক্ষমতা। পরাশরের ‘গোময়-কূটোদ্ধার’-এ বলা হয়েছে, গোবরের ঢিপি থেকে ধান জমিতে কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে জৈবসার। তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, মাঘমাসে ভক্তিশ্রদ্ধার সঙ্গে গোবর-স্তূপ পূজন করে শুভদিনে কোদালের দ্বারা জৈবসার উত্তোলন করতে হবে। তারপর অন্যতর কাজ — শুকিয়ে, গুঁড়ো করে ফাল্গুনমাসে জমির মধ্যে মধ্যে ক্ষুদ্র গর্তে তা সংস্থাপন করতে হবো। বীজ বপনের আগে বা সময় ঐ সার জমির চারিপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষক অবশ্যই বুঝতে পারবেন সারযুক্ত ও সার-বিহীন জমির ফসলের চরিত্র কতটা আলাদা। সার যেখানে পড়ে না, সেখানে অঙ্গজ বৃদ্ধি হলেও ফলন তেমন উপলব্ধ হয় না। কিন্তু সারা বাংলায় আজ গরুর ব্যবহার কমে আাসছে। আজ মাথা কুটলেও সর্বত্র পরিমাণ মত গোবর সার পাবার নয়। সামগ্রিক কৃষির মূল্যবান অঙ্গ হিসাবে গরুর ব্যবহার কমে যাওয়ার প্রভাব সর্বত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যতটুকু গো-সম্পদ এখনও দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে প্রাপ্ত গোবর-গোমূত্র সঠিকভাবে পচিয়ে সার তৈরি হয় না, অনেকটাই নষ্ট হয়, অপচয় হয়। গোবর-গোমূত্রকে সঠিকভাবে পচিয়ে কীভাবে উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার তৈরি করতে হবে, তারজন্য রাজ্যব্যাপী বিশেষ প্রশিক্ষণ জরুরী। দেশী গরুর থেকে প্রাপ্ত জৈবসারের গুণমান জার্সি গরুর চাইতে অনেক বেশী বলে প্রমাণিত হয়েছে। একটি গরু বছরে দুই টন উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার দিতে পারে, তার মূল্য জৈবকৃষিতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোশালার পাশে গোবর-গোমূত্র, গরুর ভুক্তাবশেষ যেমন তেমন ভাবে ফলে রাখলে চলবে না। উন্মুক্ত, অনাদৃত, মামুলি প্রথার বদলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা সংরক্ষণ করা দরকার, নইলে রোদে-জলে সারের অপচয় ঘটবে।
৩.
“খনা ডাক দিয়ে বলে,/চিটা দিলে নারিকেল মূলে/গাছ হয় তাজা মোটা,/শীঘ্র শীঘ্র ধরে গোটা।” চিটা মানে কী? ধানের আগড়াজাতীয় জৈবসার। নারকেল বাগানের পরিপুষ্টিতে ধানের আগড়া ব্যবহার সুনিশ্চিত করার কথা বলেছেন বিদূষী খনা। এটি গ্রাম বাংলায় সহজলভ্য উপাদান, তাতে উদ্ভিজ্জ খাদ্যোপাদান ভালোই আছে, খরচ সাশ্রয়ীও বটে। আগেকার দিনে অজৈব সারের কথা জানা ছিল না। গ্রাম বাংলায় অঢেল ছিল ধানের চিটা এবং তূষ। জমিতে প্রয়োগ করলে মাটির গঠন, গ্রোথন, জল-বায়ু ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যেত, মাটির উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করত। আজও চারাকুশলীরা বীজ তলায়, নারকেল চাষীরা ফল বাগানে সিলিকন ও পটাশিয়াম খাদ্য যোগান দিতে ধানের বর্জ্য ব্যবহার করে থাকে। দেখা গেছে, প্রতিটি নারকেল গাছে ২৫ থেকে ৫০ কেজি ধানের বর্জ্য পদার্থ প্রয়োগ করলে শাঁস পুরু হয়, নারকেলের সাইজ ও সংখ্যা বাড়ে, ভুয়ো নারকেল ফলে না। এই জৈবসার মাটিতে জমা জলের কুফলও খানিকটা কাটায়।
৪.
কেঁচো কৃষকের বন্ধু আমরা জানি। কিন্তু রাসায়নিক চাষে আমার বন্ধু রোজই মারা পড়ছে অসংখ্য। বিষমুক্ত কৃষিতে কেঁচো স্বাভাবিকভাবেই জমিতে থাকে এবং সুস্থ্যের অধিকারী যে জমি, তাতে কেঁচোর সংখ্যা অজস্র। আজকাল জমির যাবতীয় কেঁচোকে মেরে ফেলেছি বলেই কেঁচোসার কৃত্রিমভাবে পরিবেশন করতে হয়। একেই বলে কেঁচোসার বা ভার্মি কম্পোস্ট। কেঁচোর বিভিন্ন উন্নত প্রজাতি ব্যবহার করে, প্রাথমিক জৈব খাদ্যোপাদান সরবরাহ করে কেঁচোসার বাইরে তৈরি করিয়ে তবে জমিতে ঢালা হয়। জমিতে যদি কেঁচোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম, ফসলের অবশেষকে জমিতেই মিশিয়ে দিতে পারতাম, তবে বাইরের এই নাট্যমঞ্চ দরকার হত না। আজকাল পরিবেশ সচেতন মানুষ মনে করছেন, বিদেশী প্রজাতির কেঁচো নয়, দেশীয় প্রজাতির কেঁচোই আমাদের দেশের বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কৃষির জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির জন্য কেঁচো গহ্বরে জৈব আবর্জনা পরিবেশন করা হয়, কেঁচোর দল তা খেয়ে ক্রমাগত বিষ্ঠা ত্যাগ করে চলে, তাই শুকিয়ে হয়ে ওঠে ঝুরঝুরে কেঁচো সার। যেহেতু অন্যান্য অনেকানেক জৈবসারের চাইতে কেঁচোসারে খাদ্যোপাদান বেশী থাকে, তাই এই সার প্রয়োগে গাছের বাড়বাড়ন্ত বৃদ্ধি পায়, মাটিতে বাতাসের পরিমাণ বাড়ে, তাই মাটিতে দ্রুত শিকড় ছড়িয়ে গাছ জাঁকিয়ে বসে। অন্য জৈবসারের মতো কেঁচোসারও মাটির জলধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। জমি যদি অম্ল বা ক্ষারীয় হয়, কেঁচোসারের প্রয়োগে তা প্রশম হয়ে ওঠে। আমরা জমির একটি অংশে কেঁচোসার অনায়াসেই তৈরি করে নিতে পারি। গরু ও অন্যান্য গৃহপালিত পশুর বিষ্ঠা, খামারের নানান আবর্জনা, পচা ফুল-ফল-শাকসব্জি, কলাগাছের অব্যবহৃত খোল, গেঁড়ো, পাতা, পেঁপের গাছের অবয়ব, কচুরিপানার রাশি, অ্যাজোলার সংগ্রহ, নানান জলজ আগাছা, ধানের কুড়ো ইত্যাদি দিয়েই কেঁচোর ভোজনালয় তৈরি করে নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এ সব সামগ্রী যেন অর্ধপচিতভাবে পরিবেশন করা হয়, নতুবা তা কেঁচোর ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠবে। ৩০ দিন ধরে এইসব সামগ্রীর পচিতরূপ কেঁচোতলায় বা কেঁচোঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে। কেঁচোর সফল ব্যবহারের পর তা সংগ্রহ করলেই হয়ে উঠবে উত্তম মানের জৈবসার। খুবই খরচ সাশ্রয়ী এই কেঁচোঘর নির্মাণ। এমন এক একটি কেঁচোর কেয়ারি বানাতে হবে, যাতে প্রতি মাসে আড়াইশো কেজি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপন্ন হয়।
[ *লেখক পরিচিতি: রাজদীপ চ্যাটার্জী এবং স্বর্ণায়ু সরকার যথাক্রমে বারুইপুর ও আলিপুরদুয়ার নিবাসী এবং ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র সহ-সম্পাদক]*
_প্রস্তুত প্রবন্ধটি ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র জৈবকৃষি বিশেষ সংখ্যার অন্তর্গত। ১ লা ডিসেম্বর, ২০২০। সম্পাদক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।_ ( _Bharatiya Kishan Barta, Organic Farming Special Issue, 1 December, 2020, Editor: Dr. Kalyan Chakraborti)_
রাজদীপ চ্যাটার্জী এবং স্বর্ণায়ু সরকার