*সম্পাদকীয়*
জৈবকৃষিতে ‘সবুজ সার’ কথাটা আমরা অনেকেই শুনেছি। কাকে বলে সবুজ সার? সবুজ সার বা গ্রীন ম্যানিওরের সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গেলে আমরা ভগিনী নিবেদিতার উদাহরণ আনতে পারি। নিবেদিতার জীবনবোধটি আসলে সবুজ সারের খাঁটি উদাহরণ, দেশভক্তির সমার্থক। ভারতবর্ষকে তাঁর অন্তরঙ্গভাবে ভালোবাসার মধ্যে সবুজ পাতা সারের ভূমিকা যেন স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। নিবেদিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার ‘গ্রীন ম্যানিওর’ এবং ‘গ্রীন-লীফ ম্যানিওর’-এর কথা উত্থাপন করেছিলেন। বলেছিলেন, “বাংলার মাটিতে হলকর্ষণের পর যখন নবজীবনের বীজবপন ও বারিসিঞ্চন আরম্ভ হইয়াছে, তখন দিকে দিকে যত অঙ্কুর দেখা দিয়াছিল, তাহারই মধ্যে এই আর একটি বীজ যেন সকলের দূরে এক কোণে — নিজেকেই ফুলেপুষ্পে বিকশিত করিবার জন্য নয় — অপরগুলির সাররূপে ব্যবহৃত হইবার জন্য এমন ফসলের আকাঙ্খা করিয়াছিল, যাহা বাজার পর্যন্ত পৌঁছায় না, সে কেবল সার হইবার ফসল।” এবার আমরা বিচার করবো, সবুজ সার কাকে বলে এবং ভগিনী নিবেদিতার প্রসঙ্গে সবুজ সার কথাটি আসছেই বা কী করে!
‘সবুজ সার’ বা ‘সবুজ-পাতা সার’ হচ্ছে এমন ফসল যা চাষ করি তার ফুল-ফল বা কোনো অঙ্গ ব্যবহারের জন্য নয়, বাজারে উপস্থিত করার জন্যও নয়। তা ব্যবহার করি অপরিণত দেহে; নরম অবস্থায় মাটিতে চষে দেবার জন্য। মাটির সঙ্গে তার উদ্ভিজ্জ অংশ মিশিয়ে দিতে, যাতে পরবর্তী ফসল তার সুবাদে তারই জীবনের বিনিময়ে মাটিতে সুষম খাদ্যোপাদান লাভ করে এবং ফসল পরিপুষ্ট হয়। আমরা ধঞ্চে বা ধইঞ্চার নাম শুনেছি, আমরা দানা ধইঞ্চার নামও জেনেছি; এরা সবুজ সার উৎপাদন করে। মুগ, শন, বুনো নীল চাষ করেও সবুজ সার উৎপাদন করা যায়। এই শুঁটি ফসলের বীজ বোনা হয় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে, মাটিতে পরবর্তী ফসলের জন্য উপকারী জীবাণুর সক্রিয়তা বাড়াতে, জমির গভীর স্তর থেকে পুষ্টিমৌল তুলে এনে উপরের স্তরে পৌঁছে দিতে, জমি ঢেকে রেখে মাটির ক্ষয় কমাতে এবং অবশ্যই মাটির জল সংরক্ষণ করতে। অন্য ধরনের গাছের নামও জানি, যেমন করঞ্জ, নিম, গ্লিরিসিডিয়া, কালকাসুন্দা, আকন্দ, ঢোল কলমী। এই সমস্ত গাছের সবুজ পাতা এবং পাতার সঙ্গে নরম কচি ডাঁটা কেটে নিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে তা উচ্চ মানের জৈবসারের কাজ করে। এদের বলা হয় ‘সবুজ-পাতা সার’ বা ‘গ্রীন-লীফ ম্যানিওর’। এরা সকলেই আপন বলিদানের মাধ্যমে মানুষের খাদ্য ফসলকে বেড়ে ওঠতে যথাযোগ্য সাহায্য করে। ফুলে-ফলে-পল্লবে ডগমগে যৌবন পায় মাঠের ফসল, উদ্যানের নানান ফল ও সব্জি। ধঞ্চের সবুজ গাছ প্রতি বিঘায় ১.৩ থেকে ২.৬ টন সবুজ দ্রব্য ফলন দেয়, তাতে ১০ কেজির মতো নাইট্রোজেন যোগান থাকে। এর জন্য বিঘা ৩-৪ কেজি বীজ প্রথম বৃষ্টির পর ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বোনার ৫-৬ সপ্তাহের মাথায় নরম থাকতেই মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে সেই গাছ। করঞ্জ গাছের প্রতিটি গাছ বছরে ১-২ বার ছাঁটা যায়, তা থেকে ১০০-১৫০ কেজি সবুজ দ্রব্য আসে। এদের শুকনো পাতায় ৩.৭ শতাংশ নাইট্রোজেন মজুত থাকে। একটি আকন্দ গাছের বলিদানে ৫ কেজি সবুজ দ্রব্য পায় মাঠের ফসল, তাতে উই পোকার আক্রমণও কমে যায়। নিমকে সবুজ-পাতা সার হিসাবে ব্যবহার করলে গাছ প্রতি ১৫০-২০০ কেজি সবুজ দ্রব্যই শুধু দেয় না, পরবর্তী ফসলে রোগ পোকার আক্রমণও ভীষণভাবে কমিয়ে দেয়।
এবার আসি ভগিনী নিবেদিতার কথায়। তিনি নিজেকে নিবেদন করতেই এসেছিলেন, এসেছিলেন ভারতবর্ষ নামক একটি বৃহৎ কুসুমোদ্যানে নিজেকে সমানে বিলিয়ে দিতে। তাই নবজাগরণের এক একটি মানব-রূপী ফুল ফুটে উঠলো থরেবিথরে, তাদের প্রেরণা হয়ে দেখা দিলেন ভারতের মাটিতে, বিকাশের যাবতীয় পুষ্টিরস সরবরাহ করলেন আপন সৌকর্যে, অথচ নিজে থাকলেন একেবারেই নেপথ্যে, অবগুণ্ঠিত হয়ে। আমরা তার কতটুকু ইতিহাস জেনেছি! যতটা জেনেছি হিমশৈলের মতো, বেশীরভাগটাই অজানা রয়ে গেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে এনেছিলেন এই ফুল। বলেছিলেন, “Nivedita is the fairest flower of my work in England.” সেই সময় ভারতের নারীসমাজের জন্য প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন ছিল। সেই সময় ভারতবর্ষ মহীয়সী নারীর জন্মদান করতে পারে নি। তাই স্বামীজির ডাকে সাড়া দিয়ে নিবেদিতা এলেন, নবজাগরণের সার হল। নিজেকে প্রচার করতে নয়, ভারতবর্ষের এক একটি জীবনবৃক্ষকে প্রাণদান করতে এলেন, পরিপুষ্ট করতে এলেন। ঠিক যেমন সবুজ-সার সমৃদ্ধ করে থাকে ফসল, সবুজ-পাতা সার হয়ে ওঠে ফসলের জমি! গ্লিরিসিডিয়া, করঞ্জের মতোই নিবেদিতা আত্মবলিদান করলেন ভারতবর্ষের জমি-জিরেতের মৃত্তিকা খন্ডে। নিবেদিতা তেমনই ফসল, হাট পর্যন্ত বিকোবার জন্য নয়, ব্রিটিশ ভারতের মাটিতে ফুটে ওঠা ফুলগুলিকে বিশ্ব সংসারের ফুলদানিতে পৌঁছে দেবার জন্য। “কেবলই সার হইবার ফসল।”
_প্রস্তুত সম্পাদকীয়টি ‘ভারতীয় কিষান বার্তা’-র জৈবকৃষি বিশেষ সংখ্যার অন্তর্গত। ১ লা ডিসেম্বর, ২০২০। সম্পাদক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। ( _Bharatiya Kishan Barta, Organic Farming Special Issue, 1 December, 2020, Editor: Dr. Kalyan Chakraborti.