কোনও সংবেদনশীল চিত্রপরিচালক যখন কোনও চরিত্র নির্মান করেন তখন অনেক সময়েই সেই চরিত্রটির মধ্যে চিত্রপরিচালকের ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিচিন্তার ছাপ পড়ে। মানিকদা তাঁর তৈরি করা বহু চরিত্রের মধ্যে নিজেকে ভেঙে ভেঙে দিয়েছেন। ওঁর বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা তো ছিলই সেই সঙ্গে ইনডোর গেম নিয়ে ছিল দারুণ আগ্রহ। সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রের যাবতীয় বুদ্ধিমত্তার ছাপ ছিল ফেলুদা চরিত্রে। সেই সঙ্গে ছিল ফেলুর জ্ঞান আর ইনডোর গেমে ফেলুর আগ্রহ। ইনডোর গেমে তুখোড় ফেলুদা মানিকদারই প্রতিচ্ছবি।
![Soumitra Chatterjee 'Never Imagined' Feluda Would Become a 'Cult ...](https://i.ndtvimg.com/i/2016-02/feluda_640x480_51455699825.jpg)
আর অপুর সঙ্গে মানিকদার আত্মার মিল ছিল। আত্মার আত্মীয় যাকে বলে না? একদম তাই। অপু ছিল মানিকদার আত্মার অংশ। অপুর থেকে আরও অল্প বয়সে বাবাকো হারান মানিক দা। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। সর্বজয়ার মত মানিকদার মা সুপ্রভাদেবীকেও সন্তান নিয়ে প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে হয়। আমার মনে হয় সর্বজয়ার চরিত্রের মধ্য সত্যজিৎ রায় তাঁর মাকে খুঁজে পেতেন। অপুর যে স্বপ্নদ্রষ্টা মন, তার মধ্যে মিশে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ওঁকে কখনও কোনও কিছুতে হার মানতে দেখিনি। অপুর সংসারে একটা দৃশ্য আছে যেখানে বন্ধু পুলুর সঙ্গে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অপু বলছে, সে চাকরি করবে না। কেরানির চাকরি তাঁর পছন্দ নয়। অন্যকিছু করতে চায় জীবনে সে।
![REVIEW: অপুর সংসার [Apur Sansar] [The World of Apu] [1959 ...](https://jaredmobarak.com/wp-content/filmstills/apursansar03.jpg)
এই স্বপ্ন দেখা অপু আসলে মানিকদাই।চূড়ান্ত দারিদ্র্যর মধ্যেও জীবনবিমুখ না হওয়ার যে গল্প অপু বলে, সেই গল্পের নায়ক কি মানিক দা-ও নয়? অপুর সঙ্গে সঙ্গে মানিকদাও বহু জায়গায় উঠে এসেছেন অপুর সংসারে, অপুর মধ্যে। কুরোশাওয়ার মতই সত্যজিৎ রায়েরও শেষ দিকের সিনেমা সিনেম্যাটিক যতটা তার থেকে অনেক বেশি বক্তব্যধর্মী। সিনেমার শৈল্পিক দিক মানিকদা কোনও দিন অস্বীকার করেন নি। মানিকদার কোনও সিনেমাই নিখাদ শিল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এই সিনেমাগুলিতে নৈঃশব্দের থেকে কথা বেশি। এই সিনেমাগুলির মাধ্যমে পরিচালকের নিজস্ব কিছু কথা বলার থাকে, সেই জন্যই। আগন্তুকের মনমোহন মিত্র যা কিছু বলেছেন তা মানিকদারই কথা। মনমোহনবাবু ভীষণভাবে সত্যজিৎ রায়।
![agantuk bengali movie full Mp4 HD Video WapWon](https://i1.wp.com/ytimg.googleusercontent.com/vi/nw4jshgJbcM/mqdefault.jpg)
আলতামিরার গুহাচিত্র দেখে যিনি মুগ্ধ হয়েছেন, বলেছেন এই শিল্পকে ছোঁয়ার যোগ্যতা হওয়া মুশকিল, তিনি মানিকদা ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না। যিনি সভ্যতার সংকট উপলব্ধি করছেন, যে সংকটে আজ আমরা জর্জরিত সেই তিনি মনমোহন মিত্র ওরফে সত্যজিৎ রায়। যেখানে তিনি সভ্য মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছেন, যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে , একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী সহ পুরো শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।সভ্য তাঁরা, যাঁরা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টি ছিল বলেই তিনি সময়ের অনেক আগে সময়কে দেখতে পেয়েছিলেন। এই চরিত্রের সঙ্গে এতটাই একাত্ম ছিলেন মানিকদা যে উৎপল দত্তের গলায় দুই কলি গানও গেয়েছিলেন নিজেই। উৎপল দত্তের সঙ্গে গলার স্বর সেই অর্থে ম্যাচ না করলেও। ইচ্ছা করলেই অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াতে পারতেন তিনি, উৎপল দত্ত নিজেও পারতেন গাইতে কিন্তু তা তিনি করেন নি। যখন আমি হেসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হঠাৎ নিজে গান গাওয়ার কারণ, একটু লজ্জিত হেসেই বলেছিলেন, ‘এমনি-ই’।এতটাই মনমোহন-এর মধ্যে মিশে ছিলেন সত্যজিৎ রায়।