কমরেড খুড়ো-র কল

রাস্তার মোড়ের মুদীর দোকান, যার কাছে ২০ বছর ধরে আমাদের বাকীর খাতা চলত সেও যে বুর্জোয়া আর আমাদের শত্রু তা ঐ বামাদা না বললে জানতেই পারতুম না ! আমাদের জগদ্ধাত্রী পাটকলের মালিক, কাঞ্চন মিত্র স্যার, ওনার স্ত্রী কমলা ম্যাডাম নিজের হাতে প্রতি বছর আমাদের ছেলে মেয়েদের পূজোয় জামা দিত; আমরা তাকে স্বয়ং অন্নপূর্ণা ভাবতাম ৷ কি বোকা ছিলাম আমরা ! বামাদা বলেছে ওরা নাকি আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রেণীশত্রু !

বামাদা, বামাচরন চক্রবর্তী ৷ আমার থেকে কয়েক বছরের বড় ৷ রোগাটে গড়ন, পাজামা পাঞ্জাবী পরত, চোখে চশমা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি, চুল আঁচরাত না, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ ৷ ব্যাগ ভর্তি সব কঠিন কঠিন ইংরেজি বই ৷ সাইকেল নিয়ে প্রায় সন্ধ্যা বেলা আমাদের বস্তিতে আসত ৷ আমাদের বস্তিটা বেশ বড়, কাছাকাছি দুটো চটকলের লেবার রা থাকতাম ৷ সন্ধ্যা বেলা আর ছুটির দিন গুলোতে পিকনিক, নাচ গান, পূজো, খেলাধূলা লেগেই থাকত ৷ তো বামাদা র সাথে আমাদের মত ছোকড়াদের বেশ খাতির হয়ে গেল ৷ বামাদা এত পন্ডিত, অথচ আমাদের সাথে বসে চা খেত, বিড়ি খেত ৷ সাথে সারা পৃথিবীর গল্প বলত ৷ বামাদার কাছেই প্রথম শুনলাম সোভিয়েত বলে নাকি একটা আজব দেশ আছে, ওখানে সাম্যবাদ আছে, তাই ওখানে সবাই নাকি রোজ লুচি মাংস মন্ডা মিঠাই খায়, কারো কোনও কষ্ট নেই ! বামাদার থেকে একটা নতুন শব্দ শিখলাম – ‘কমরেড’ ৷ এবার থেকে আমরা নিজেদের বন্ধুদের কমরেড বলে ডাকতাম ৷ বামাদা একদিন আমায় বলল, “কাঙাল, সব বুর্জোয়াকে খতম করতে পারলে আমাদের দেশও সোভিয়েত হবে ৷” আমি বললাম, “কিন্তু মুশকিল হল, কে বুর্জোয়া তা চিনব কি করে ?” বামাদা বলল, “কোনও চিন্তা নেই– আমি চিনিয়ে দেবো ৷ তোদের শুধু আমার কথা শুনে চলতে হবে ৷”

গঙ্গার পারে বসে এসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই দেখি পশ্চিম আকাশ লালে লাল, সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল ৷ লাল আকাশ দেখলেই কত কথা মনে পরে ! হরতালের কথা, বিপ্লবের কথা, সাম্যবাদের কথা ৷ কানে ভেসে আসে– “জাগো জাগো সর্বহারা….”

এখনও মনে হয়, এই তো সেদিন ! ১৯৭৭ সালে বাম সরকার এলো ৷ চারদিকে লাল পতাকায় ছেয়ে গেল ৷ শ্রমিকের রক্তে এই পতাকা লাল হয়েছে, তাই এই পতাকার ভিতর দিয়ে দেখলে রক্ত দেখা যায় না ৷ ১৯৭৮ এ নতুন শিল্প নীতি এল ৷ বুর্জোয়া শিল্পপতিদের কালো হাত লাল ফিতেতে বেঁধে দেওয়া হল, গলাতেও লাল ফাঁস দেওয়া হল ৷ পশ্চিমবঙ্গের এখন সাজ সাজ রূপ, সাম্যবাদ এই এল বলে ! আমাদের বস্তির মুখের শিব মন্দির ভেঙে দেওয়া হল ৷ বামাদা বলেছে শিব যদিও গাঁজা টাজা খায়, ছাই টাই মাখে, ওকে কমরেড ভাবার কোনও কারন নেই, সেও বুর্জোয়া ৷ কারণ ধর্ম হল আফিম; গাঁজা- মদ – বিড়ি সব চলতে পারে, কিন্তু আফিম এবং ধর্ম চলবে না ৷ সাম্যবাদ আনতে হলে ধর্ম আর ঘট-কে বিসর্জন দিয়ে ধর্মঘটকে হাতিয়ার করতে হবে ৷ সুতরাং শিবলিঙ্গ ভেঙে কমরেড লেনিন আর মার্কস এর মূর্তি বসল ৷ বামাদা আর অন্য কমরেডদের দেখা দেখি আমরাও ঘুসি দেখালাম ৷ পিছন থেকে আমার বৌ আর অন্য মহিলারা শাঁখ বাজাচ্ছে আর উলু দিচ্ছে শুনে বামাদা আর অন্য রাগী কমরেডরা ওদের এসব কুসংস্কার বন্ধ করতে ধমক দিলো ৷ আর বলল, মূর্তি র সামনে ঘুসি দেখিয়ে লাল সেলাম বলতে হয়, ওটাই নাকি বিজ্ঞানসম্মত !

আমার বৌ তো আবার সাথে করে চন্দন, বেলপাতা, দূব্বা, তুলসী, প্রদীপ সব নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ধমক খেয়ে আর সাহস পেল না ৷ মন্দির ভেঙে পার্টি অফিস হল, চারদিকে অদ্ভুত সব লোকের ছবি বসল– তাদের অদ্ভুত সব চুল, দাড়ি; অদ্ভুত সব নাম ৷ এরা নাকি সব অদ্ভুত পন্ডিত ! অদ্ভুত বিপ্লবী ! লেনিন, স্তালিন, মার্কস, মাও আরও কত! উচ্চারণ করা যায় না ! একজনের নাম তো আবার ‘গু-য়ে ভরা’– বললেই অনেকে নাকে হাত দিতাম বলে বামাদা খুব বকত ৷ যাই হোক তখন পার্টি অফিসে রোজ ছুটির পর আমাদের বিপ্লব শেখানো হত ৷ বামাদা বলত মালিকের হাতে অনেক টাকা, তাই সাম্যবাদ আনতে হলে মালিকের হাত ভেঙে দিতে হবে ৷ তা শুনে পল্টু একদিন বলে বসল, আপনার মাথাতেও তো অনেক বুদ্ধি, তাহলে সাম্যবাদ আনতে হলে কি করতে হবে ?

দেখতে দেখতে ১৯৮৮ এসে গেল, পশ্চিমবঙ্গ এখন শিল্পে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ হয়ে গেছে, কিন্তু ধর্মঘটে প্রথম ৷ বামাদা প্রায় সপ্তাহেই আমাদের হাতে লম্বা এক পাতা দাবি ধরিয়ে দিত ৷ সপ্তাহে অন্তত একদিন কারখানার সামনে আমরা সেই সব দাবি নিয়ে হরতাল করতাম ৷ বামাদা এখন আর সাইকেলে আসে না, তার সাদা অ্যাম্বাস্যডর থেকে নেমে সোজা মালিকের ঘরে ঢোকে, আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই, বামাদা মুখে চারমিনারের ধোঁয়া উড়িয়ে টেবিলে জোড়ে জোড়ে থাবড়া দিয়ে মালিকের কাছে দাবি জানাচ্ছে, আর মালিক মুখ কাঁচুমাচু করে হাত জোড় করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে ৷ অবশেষে মালিক পার্টি ফান্ডে মোটা টাকা দিলে তবেই হরতাল উঠত ৷ আমরা সবাই বুঝে গিয়েছিলাম বামাদার ক্ষমতা ৷ তাই এখন আমরা আর সেই পুরনো শ্রমিক নই যারা পার্টি করি, আমরা এখন পার্টির কমরেড যারা কারখানায় শ্রমিকের কাজ করি ৷ বুর্জোয়া মালিকের প্রতি আর আমরা অনুগত নই, আমরা পার্টির আর বামাদার অনুগত কমরেড ৷ বামাদা বলত কারখানার উৎপাদন দিয়ে সাম্যবাদ আসে না, সাম্যবাদ আনতে হলে বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রুকে চিহ্নিত করে, শ্রেণীসংগ্রাম করতে হবে, তবেই আসবে সাম্যবাদ ৷ আমরা বুঝতাম, বামাদা আমাদের মালিকের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী, আর তাই চেষ্টা করতাম বেশী বেশী করে তার অনুগত হতে ৷ বামাদার অনুপ্রেরণায় আমাদের আন্দোলন দিনে দিনে জোড়দার হতে থাকলো ৷

হঠাৎ একদিন কারখানায় ঢুকতে গিয়ে দেখলাম তালা ঝুলছে, আর ইংরেজিতে নোটিস ঝোলানো; বামাদা পড়ে বলল বুর্জোয়া মালিক আমাদের টাকা মেরে কারখানা বন্ধ করে পালিয়ে গেছে ৷ আমরা বললাম এবার কি হবে? খাব কি ? বামাদা বলল, মালিক যে আমাদের শ্রেণী শত্রু তা আবার প্রমাণিত হল, আর আমরা তো শুধু পেটের ভাতের জন্য বিপ্লব করছি না, আমরা বিপ্লব কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিপ্লব করছি ৷ কিন্তু পেটে ভাত না থাকলে বিপ্লব কি করে বাঁচবে ! বিপ্লব, আমার একমাত্র ছেলে, চার বছর বয়স ৷ ১৯৮৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা লাগাতার ধর্মঘটে ৫১ দিন বন্ধ থাকার পর, এই ধর্মঘটে র সমর্থনে ২২শে জুন, যেদিন পশ্চিমবঙ্গের সব খবরের কাগজ বন্ধ ছিল সেদিন আমার ছেলের জন্ম হয় ৷ তাই বামাদা স্বয়ং নাম রেখেছিল বিপ্লব ৷ বললাম বামাদা বিপ্লব কি করে বাঁচবে ? বামাদা সারা পৃথিবীর ইতিহাস ঘেটে আমায় বোঝালো অনাহারেই বিপ্লব বেঁচে থাকে, আর বেশী খেলে বিপ্লব ঘুমিয়ে পরে ৷ সুতরাং খাদ্যের চিন্তার বদলে বিপ্লব কে জাগিয়ে রাখাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিৎ৷

নিন্দুকেরা বলে, ১৯৯০ আসতে আসতে নাকি পশ্চিমবঙ্গের GDP কমতে কমতে দেশের ১৩ তম স্থানে পৌছে গেল ৷ কিন্তু তাতে কি ! বামাদা আমাদের বলল আমাদের রাজ্য বিপ্লবে প্রথম, স্বপ্ন দেখায় প্রথম ৷ ধর্মের ঘটকালি ছেড়ে আমরা ধর্মঘটের মহান ঐতিহ্য গ্রহন করেছি ৷ তাছাড়া তুচ্ছ দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতার কথা আমরা ভাবি না, দুনিয়ার মজদুরদের এক করার স্বপ্ন দেখি আমরা ৷ কিন্তু এখন মজদুর কৈ ? আমাদের বস্তির কাছের দুটো চটকল ই তো বন্ধ ৷ বামাদা বলল, সমাজতন্ত্রের মজদুর তোরা, তোদের হাতুড়ি আজ হাত ছেড়ে পতাকায় উঠেছে, সেই পতাকা আকাশে পতপত করে উড়ছে ৷ বলেই হাঁক দিলেন, দুনিয়ার মজদুর এক হও, ইনকালাব জিন্দাবাদ ৷ আমরাও সবাই অভ্যাস বসত বলে উঠলাম ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! এদিকে আমার বৌ লক্ষ্মী এখন তিন বাড়ি বাসন মাজার কাজ ধরেছে ৷ এর ভিতর বামাদার বাড়িও আছে, ওখানেই একটু বেশী মাইনে ৷ বামাদারা মস্ত মানুষ ৷ তিন তলা বাড়ি, বামাদার বাবার পুরনো মুদীর দোকান এখন রেশন শপ হয়েছে ৷ রেশনের চাল ডালে তো কুলোয় না, বেশী কিছু লাগলে বামাদার বাবা পবিত্র কাকু ব্ল্যাকের জিনিস একটু কম পয়সায় আমাদের দেন, আর মাসের শুরুতে মাইনে থেকে কেটে নেন ৷ বামাদারা চক্কত্তি বামন, বাড়িতে গোপাল আছে, তাই বামাদার মা একটু ছোঁয়াছুঁয়ি মানেন ৷ বামাদা কিছু মানে না বলে ঘরে ঢোকার আগে ওকেও গঙ্গা জল গায়ে মাথায় দিয়ে তবেই ঘরে ঢুকতে হয় ৷ কাকিমা লক্ষ্মীকে দুপুরে পান্তা খেতে দিতেন, লক্ষ্মী দরজার সিড়িতে বসে বাটি এগিয়ে দিলে, উনি ভিতর থেকে পান্তা ঢেলে দিতেন, সাথে কাঁচা লঙ্কা আর লেবুও দিতেন; কখনও বাসি তরকারি থাকলে তাও দিতেন ৷ বেশীরভাগ দিন ঐ খেয়েই আমাদের তিন জনের চলত ৷ পার্টির দৌলতে আমারও তখন মাঝে মাঝে ড্রেন পরিষ্কার, জঙ্গল পরিষ্কার এমন নানা কাজ জুটতো ৷ তবে বামাদা কথা দিয়েছে পার্টির জন্য মন দিয়ে কাজ করলে, কিছু একটা ব্যবস্থা উনি করবেন ৷ আর তাছাড়া সাম্যবাদ তো এলো বলে ! একবার এসে গেলে আর কারো কোনও চিন্তা নেই ৷

এরপর বিশ্বায়ন এল, আমরা অনেক আন্দোলন করছি তখন; বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার কাছে ভারতবর্ষ নাকি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ! বামাদা তাই আমেরিকার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে তখন খুব ব্যস্ত ৷ ফাঁক পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বামাদা এই বিশ্বায়ন টা কি ? বামাদা বলল, তোর বাড়ির যে লেবু গাছটাই এত কাগজি লেবু হয় ঐ লেবু গুলো আর তোর থাকবে না, আমেরিকার হয়ে যাবে ৷ তাই নাকি ! এ তো মানা যাবে না ৷ লেবুগাছটা আমার খুব প্রিয়, দেশের ব্যপারে আমি অত বুঝি না, কিন্তু আমার লেবু আমি কিছুতেই আমেরিকাকে নিতে দেব না ৷ সুতরাং পার্টি র কাজে আরও জোর দিলাম ৷ এদিকে মাঝে মাঝেই আমার পেট ব্যথা হত, আসলে রোজ ঠিক ঠাক খাওয়া হত না তো, তাই বোধ হয় ৷ কিন্তু এই ব্যথা দিনে দিনে অসহ্য হয়ে দাড়ালো; কাছাকাছি একটা নার্সিংহোম হয়েছে বটে; কিন্তু ওতে যাওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। অগত্যা বস্তির অন্য কমরেডরা আমায় নিয়ে ট্রেনে করে নীলরতন হাসপাতালে গেল ৷ বামাদাও সেই সময় নেই, দিল্লী গেছে ৷ আমি যন্ত্রণায় এই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি, আবার সবাই চোখে মুখে জল দিচ্ছে, জ্ঞান ফিরছে, আবার নেই ৷ লক্ষ্মী শুধু কেঁদেই চলেছে ৷ ঐ দিনটা ভোলার নয়, মহান নভেম্বর দিবস; পাড়ার পার্টি অফিসের সামনে লাল কাপড় পেতে মহান লেনিনের ছবি বসানো, গলায় গাঁদার মালা; মাইকে গান চলছে ” আমরা করব জয়…” ৷

আমায় বাড়ি থেকে বের করে ভ্যানে করে স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার সময় লেনিন ঠাকুরকে প্রণাম করে বললাম, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও, এবার থেকে আরও মন দিয়ে পার্টির কাজ করব ৷ যাইহোক, ঐ ভাবে সকাল দশটায় আমায় নীলরতনে ঢোকানো হল; হাসপাতালের বাইরে প্লাস্টিক পেতে আমায় শুয়ে রাখা হল ৷ পাশে বসে বৌ কেঁদে চলেছে ৷ অনেককে ধরে অবশেষে কমরেডরা বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমায় ভর্তি করালো ৷ কিন্তু বেড নেই; আরও অনেক রুগীর মত আমিও মাটিতে পরে যন্ত্রণায় কতরাচ্ছি ৷ চিৎকার করারও শক্তি নেই ৷ লক্ষ্মী মাথার কাছে বসে, একে ওকে কেঁদে কেটে বলছে ডাক্তার পাঠাতে ৷ সাতটা নাগাদ কেউ একজন এসে একটা ইনজেকশন দিয়ে গেল, কিন্তু কিছুই হল না ৷ ঘন্টার পর ঘন্টা যায়; আর সহ্য হয় না ৷ লেনিন ঠাকুর কে এত বলেও কিছু হল না যখন শিব ঠাকুরের শরণ নিলাম ৷ বললাম, এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই দাও, হয় ভালো কর, নয় তুলে নাও ৷ মহাদেব প্রার্থনা শুনলো ৷ আমার মৃত্যু হল ৷ চাঁদা তুলে আমার দাহ হল, পাঁচটা ব্রাহ্মণ খাইয়ে শ্রাদ্ধও হল ৷ বামাদা ও পবিত্রকাকু দুজনেই খেলেন ৷

তারপর দেখতে দেখতে অনেক বছর কেটে গেল, প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও পরে মৃত্যু ব্যপারটাকে বেশ উপভোগ করতে লাগলাম, কারন মরে গেলে খিদে পায় না, জামাকাপড় লাগে না, বাড়ি ঘর লাগে না ৷ এখন বুঝতে পারছি, যারা যত বেশী মানুষ মারে তারা ততবড় কমরেড কেন হয় ৷ কারন মেরে দিলে তো সব সমান হয়েই গেল; এও তো সাম্যবাদ-ই হল, তাই না ! এদিকে সমাজতান্ত্রিক সরকার এখন সংবেদনশীল হয়ে গেছে ৷ বামাদার চুল সব পেকে গেছে, সুন্দর পাট করে আঁচরানো; আগের সেই রাগী রাগী ভাব আর নেই; এখন বেশ মিষ্টি হেসে কথা বলে ৷ পার্টি অফিসেও দেখলাম বিদেশী পন্ডিতদের রঙচটা ছবির পাশে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের নতুন ছবি ৷ এখন আর পার্টিতে কেউ রবীন্দ্রনাথ কে বুর্জোয়া আর বিবেকানন্দ কে সাম্প্রদায়িক বলে না ৷ একদিন আবার দেখলাম বামাদা বলছে, একজন বড়লোক বাঁচলে ছটা গরীব বাঁচে ৷ কিন্তু বড়লোক তো বুর্জোয়া ! ওরা তো গরীরের শত্রু, ওদের ভালো বললে শ্রেণী সংগ্রাম হবে কি করে, আর তা না হলে সাম্যবাদ আসবে কি করে ! চিৎকার করে বললাম, বামাদা তাহলে সাম্যবাদ কি করে আসবে ? বামাদা শুনতে পেল না, এই প্রথম বুঝলাম মানুষ কেন মরতে চায় না ৷ তবে ভালো লাগলো বিপ্লব কে দেখে; ও এখন শৈশব কৈশর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছে ৷ বামাদার সাথে সাথে ঘোরে ৷

আমার মারা যাওয়ার পর, পবিত্র কাকু বিপ্লব কে ওনার রেশন দোকানে কাজ দেন, সারাদিন দোকানে সাহায্য করত, রাতে ওখানেই ঘুমাতো ৷ তখন ওর ৮ বছর বয়স, এখন ২০ চলছে ৷ বামাদাও বেশ কয়েক বছর হল প্রোমোটারি ব্যবসা করছে ৷ অনেকগুলো বন্ধ জুটমিলের জমিতে এখন আবাসন হচ্ছে ৷ এই কাজে বিপ্লব বামাদার চ্যালা হয়েছে ৷ আমার ঐ রোগা ছেলেটার এখন কি ভাল সাস্থ্য হয়েছে ! বামাদার মা মারা যাওয়ার পর থেকে লক্ষ্মীও বামাদার বাড়িতেই রাতদিন থাকে; বামাদার বৌ এর কাজে সাহায্য করে ৷ আমার তাই বামাদার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, ও না থাকলে আমার পরিবারটার কি যে হত ! বিপ্লব জমি খালি করানো থেকে মালপত্র জোগান দেওয়ার মত অনেক কাজেই বামাদার ডান হাত ৷ কিছু দিনের মধ্যেই বিপ্লব নিজের নামে একটা ফ্ল্যাট নিল ৷ দেখে আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল ! সেই ৫২ সালে বাবা ওপার বাংলা থেকে এসেছিল ৷ প্রায় ৫৫ বছর লাগলো আমাদের একটা পাকা আস্তানা জোগার করতে ৷ মনে মনে আশীর্বাদ করে বললাম বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক ৷

চারদিকে এখন বড় শিল্প আনার তোড়জোড়; শালবনি, নন্দীগ্রাম, নয়াচর, সিঙ্গুর কত কত নাম ৷ বড় বড় শিল্পপতিদের নাম শোনা যাচ্ছে ৷ বামাদা প্রতিদিনই নানা সভা থেকে টাটা, ঝিন্দাল, আম্বানি কত নাম বলছে ৷ এসব শুনতে শুনতে একটা পুরোনো নাম মনে পরে যাচ্ছিল, কাঞ্চন মিত্র, আমাদের জগদ্ধাত্রী জুটমিলের মালিক, যাকে বামাদা বুর্জোয়া বলত ৷ তাহলে কি কাঞ্চন বাবু বুর্জোয়া, আর টাটা ঝিন্দাল রা নয় ! মানে বেশী টাকা থাকলে বুর্জোয়া, আর অনেক অনেক বেশী টাকা থাকলে কমরেড ! কি জানি ! জিজ্ঞেস করারও তো উপায় নেই !

কয়েক বছর যেতে যেতে আবার চারদিকে আন্দোলন শুরু হল, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর ৷ এবার নাকি বদল হবে ৷ লালের বদলে সবুজ সরকার হবে ৷ মা মাটি আর মানুষের সরকার হবে ৷ দেখতে দেখতে সরকার বদল হল ৷ চারদিকে নীল সাদা রঙ হল; ত্রিফলা আলোয় চারদিক ছেয়ে গেল ৷ এবার থেকে জোর করে জমি নেওয়া যাবে না ৷ ছোট ছোট জমি শিল্পপতিদের সরাসরি মালিকের থেকে কিনতে হবে ৷ জমি ব্যঙ্ক হল, ছোট, মাঝারি জমির লিস্ট দেওয়া হল ৷ বড় বড় শিল্প সম্মেলন হল ৷ কিন্তু শিল্পপতিরা সব বড় জমির লোভে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে পালিয়ে যেতে লাগল ৷ সবাই বলতে লাগল জমিনীতির জন্য পশ্চিম বঙ্গে আর শিল্প নাকি আসবে না ৷ বিরোধীরা এও বলল, স্বাধীনতার পর নাকি দেশের GDP র ৪০% পশ্চিমবঙ্গের ছিল, এখন নাকি কমতে কমতে ৩% হয়েছে ৷ সবাই বলছে অর্থনীতির হাল নাকি খুব খারাপ ৷

কিন্তু আমি তো তার উল্টোটাই দেখলাম ! বিপ্লব এখন সিন্ডিকেট চালাচ্ছে ৷ একটা বড় চারচাকা গাড়ি কিনেছে ৷ আরও দুটো নতুন ফ্ল্যাট করেছে ৷ দুই হাতে ছটা সোনার আংটি, গলায় মোটা সোনার চেন ৷ লক্ষ্মী কে এতবছর পর সত্যিকারের লক্ষ্মীর মতন লাগছে ৷ দেখে মন ভরে যায় ৷ বামাদাও তার বাড়িতে নতুন নীল সাদা রঙ করেছে ৷ রেশন দোকানের পাশে একটা বিলিতি মদের দোকান দিয়েছে ৷ নাম রেখেছে ‘পরিবর্তন ফরেন্ লিকর অফ শপ’ ৷ পার্টি অফিসে এখন বিদেশীদের ছবি র বদলে সব চেনা বাঙালি মনীষীদের মুখ ৷ মাঝখানে সবচেয়ে বড় করে মুখ্যমন্ত্রী র ছবি ৷ বামাদা এখন প্রতিদিন মাইকে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণার কথা বলে ৷ কিন্তু আগের মত আর কথায় কথায় বলে না ‘সাম্যবাদ আসবে’ ৷
আমি কিন্তু আজও মাঝে মাঝেই চটকলের ধারে এই গঙ্গার পারে বসে থাকি ৷ এখানেই প্রথম বামাদাকে বলতে শুনেছিলাম “সাম্যবাদ আসবে, এখানেই আসবে ৷”

এসব কথা ভাবতে ভাবতে রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল ৷

এ কি! কারখানার ভিতরে একটা ঝাপসা অবয়ব ! গড়নটা তো বেশ চেনা !
— কি খবর কাঙাল দাস, আমায় চিনতে পরছ না ?
— কাঞ্চন মিত্র ! স্যার, আপনি এখানে ! আপনি তো পালিয়ে গেছিলেন !
— আমি তো নয় ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালাম, আর কাঙাল তুমি? তুমি তো এখনও ছুটে চলেছ সাম্যবাদের লুচি খেতে– হা হা হা হা হা…–
” মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে ৷
এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
উৎসাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে ৷”

এই ছড়াটা শুনেছ কাঙাল ?
–না ৷
— ‘খুড়োর কল’, সুকুমার রায়ের লেখা ৷ খুড়ো এক কল বানিয়েছিল, যা দিয়ে ছোটার গতি আর ক্ষমতা দুই ই বাড়ানো যায় ৷ কিভাবে জানো ? পিঠের সাথে একটা কল বেঁধে দেওয়া হবে, যা মাথার উপর দিয়ে এসে নাকের সামনে একটা দড়ি ঝোলানো, এই দড়িতে লুচি, মাংস মিষ্টি বেঁধে দাও, এবার খাব খাব করে মুখ যত এগোবে, খাবার তত এগোবে, আর খাবার লোভে তুমি ছুটতেই থাকবে ৷ এমনভাবেই বামাচরন তোমার সামনে সাম্যবাদের লুচি ঝুলিয়েছিল ৷ ঐ লুচি তোমায় ৫০ বছর ছোটাচ্ছে !
–আপনি তো বুর্জোয়া, আপনি চান না সাম্যবাদ আসুক ৷ তাই এসব আবোল তাবোল বলছেন ৷ তা আপনি এই কাকভোরে এখানে কেন ?
— সকাল দেখতে ৷
— মানে?
— শেষ বার এই চটকল যখন ছাড়তে বাধ্য হলাম, সময়টা ঠিক অন্ধকার নামার আগে; পশ্চিম আকাশ তখন টুকটুকে লাল ৷ খুব ইচ্ছে হত, গঙ্গার ধারে, এই চটকল থেকে একদিন আবার সকাল দেখব ৷ এত বছর প্রাণের ভয়ে আসতে পারিনি ৷ গতকাল রাতে প্রাণের সাথে প্রাণের ভয়ও চলে গেল, তাই সকাল দেখতে চলে এলাম ৷
কাঙাল, আকাশের রঙ দেখ– সূর্য্য উঠছে ৷ এবার সকাল হবে ৷

আমি আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ; পূবের আকাশ যেন গেরুয়াধারী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ৷ পাশের এক মন্দির থেকে মঙ্গল আরতির ঘন্টার ধ্বনি র সাথে ভেসে এল, বৈদিক মন্ত্র:
“অসতো মা সদ্গময় ৷
তমসো মা জ্যোতির্গময় ৷
মৃত্যু র্মা অমৃতং গময় ||
ওম্ শান্তি শান্তি শান্তিঃ || “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.