‘অগ্নিপুরাণ‘ এ বলা হয়েছে- “মন্দিরের আকৃতি হল প্রকৃতি” আবার ‘শিল্পরত্ন’তে বলা হয়েছে- “প্রাসাদ (মন্দির) পুরুষ রূপে পূজ্য“। মন্দির-স্থাপত্য একই সাথে কলা এবং বিজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞান এবং প্রয়োগ উভয়েরই লক্ষ্য হলো এক, আর তা হল- মোক্ষলাভ। মন্দির হল ‘তীর্থ’ আর মন্দির মাত্রই ‘তীর্থ’। মোক্ষ লাভের জন্য তীর্থযাত্রা বা মন্দির দর্শনের দ্বারা মানবজীবন জারিত হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।ব্রহ্ম হলেন পরম তত্ত্ব (Supreme Principle)আর মন্দির হল তাঁর প্রকাশ। বা বলা চলে মন্দির হল ভগবানের বাড়ি। সুদূর প্রাচীন কাল হতে পশ্চিমবঙ্গের মন্দির গুলি তার কলা, কৃষ্টি ও স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের তেইশটি জেলা তে প্রায় এগারোশ মন্দিরের সংখ্যা প্রাপ্ত হলেও, বাস্তবে মন্দিরের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মন্দিরগুলিতে বিভিন্ন স্থাপত্য রীতি লক্ষ্য করা যায়, যেমন- চালা(একচালা,দোচালা, চারচালা, আটচালা,বারোচালা),রত্ন (একরত্ন ,পঞ্চরত্ন ,নবরত্ন , একাদশরত্ন,পঁচিশরত্ন ),দালান(চাঁদনী দালান, দ্বিতল চাঁদনী দালান,দুর্গা দালান),মঞ্চ (রাসমঞ্চ,দোলমঞ্চ,তুলসীমঞ্চ),দেউল, মঠ,মিশ্র -রীতি প্রভৃতি। এছাড়া ও রয়েছে বিভিন্ন রীতির মন্দির সমবায়ে গঠিত মন্দির- গুচ্ছ। সতীর একান্ন শক্তিপীঠের মধ্যে তেরোটি শক্তিপীঠ মন্দির রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মন্দির যা দীর্ঘকাল ধরে হিন্দু আস্থার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সবচাইতে পূজিতা নারী দেবী হলেন মা কালী ও মা মনসা; এছাড়াও রয়েছেন মা দুর্গা, মা চন্ডী,শীতলা মাতা, মা লক্ষী। এবং সবচেয়ে অধিক পূজিত পুরুষ দেবের নাম হল মহাদেব; তা ছাড়াও রয়েছেন ভগবান বিষ্ণু, গণেশ, নাড়ুগোপাল, হনুমানজী প্রভৃতি দেবতা। মন্দিরময় পশ্চিমবঙ্গে মা কালী ও দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির এর সংখ্যাই সর্বাধিক। মন্দিরময় এই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান কিছু মন্দিরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
কালীঘাটের মা কালী মন্দির:
কলকাতার কালীঘাটে অবস্থিত সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম শক্তিপীঠ এই মা কালীর মন্দির। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা মানসিংহ এই মন্দিরটি তৈরি করেন যা ছিল খুবই ছোট এবং পরবর্তীকালে বর্তমানের মন্দিরটি তৈরি সম্পূর্ণ হয় 1809 সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায়। পুরাণ মতে শিবের রুদ্র তাণ্ডবের সময় সতীর ডান পায়ের আঙ্গুল শক্তিরুপে এই স্থানে পতিত হয়। সারাবছরই পুণ্যাতূর ভক্তের সমাগম এই তীর্থক্ষেত্র কে অনন্য গরিমা প্রদান করে। বিশেষত কালীপূজা, দুর্গাপূজা, পয়লা বৈশাখে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় মায়ের দর্শন এর জন্য।
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির:
স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর ইচ্ছাপূরণ ও মায়ের স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে রানী রাসমণি 1855 সালের 31শে মে স্নান যাত্রার দিন দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মূর্তি স্থাপন করেন। গদাধর চট্টোপাধ্যায় অথাৎ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। নবরত্ন স্থাপত্য-শৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে মায়ের মূর্তিটি- ভবতারিণী রূপে। হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত মায়ের নানা অদ্ভুত শক্তি ও রামকৃষ্ণ-সারদা সাধনার পীঠ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের কাছে এটি একটি অতি পবিত্র স্থান।
বাবা তারকনাথের মন্দির:
হুগলির তারকেশ্বর শহরে 1729 সালে স্থাপিত আটচালা স্থাপত্য রীতির নিদর্শন বাবা তারকনাথের মন্দির। কিংবদন্তি অনুসারে, তারকেশ্বরের জঙ্গলে রাজা বিষ্ণু দাসের ভাই তারকনাথ শিব লিঙ্গটি খুঁজে পান এবং তারপরেই এই শিব লিঙ্গ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে একে ‘স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ’ ও বলা হয়। সারাবছর ভক্ত সমাগম থাকলেও শ্রাবণ মাসের পুন্য তিথিতে সারাদেশ হতে আগত ভক্তের “বোম্ -বোম্ -তারক -বোম্” শব্দে তারকেশ্বরের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
ঠনঠনিয়া কালী মন্দির:
কলকাতার বিধান সরণীতে অবস্থিত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি 1803(মতান্তরে 1703) সালে স্থাপিত হয়।এখানে মা সিদ্ধেশ্বরী (দুর্গা) রূপে পূজিতা হন। কালী পুজোর দিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এখানে।প্রত্যেক বছর দেবীর মূর্তির পরিবর্তন করে নতূন মূর্তি গড়া হয়।
হংসেশ্বরী ও অনন্ত বাসুদেব মন্দির:
হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় শতাব্দী প্রাচীন কালী মাতা হংসেশ্বরী রূপে বিরাজমান।রাজা নৃসিংহ দেবরায় মা কালীর স্বপ্নাদেশের ফলে তাঁর মাতা হংসেশ্বরী দেবীর নামে 1814 সালে এই মন্দিরটি স্থাপন করেন। এখানেই রয়েছে প্রাচীন এক কৃষ্ণের মন্দির যা অনন্ত বাসুদেব মন্দির নামে পরিচিত।রাজা রামেশ্বর দত্ত এই মন্দিরটি 1679 সালে প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্গভীমা মন্দির:
কলকাতা হতে প্রায় 87 কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে বর্গভীমা কালী মন্দির অবস্থিত।অতীব প্রাচীন এই কালী মন্দির যার উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায়। মুসলিম শাসকরা এই মন্দিরটি ধ্বংস করার ফলে নতুন করে আবার মন্দিরটি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। হিন্দু- বুদ্ধিস্ট -বাংলা স্থাপত্য রীতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মন্দির। কালী পূজা, দুর্গাপূজা পূজা ও নববর্ষে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।
বাহুলারার প্রাচীন শিব মন্দির:
বাঁকুড়া জেলার ওন্দা- 2 পঞ্চায়েতের বাহুলারা গ্রামে প্রাচীন এই শিব মন্দিরটি সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির নামে পরিচিত। এগারো শতকের (মতান্তরে -অষ্টম শতক )কলিঙ্গ স্থাপত্য রীতির এক অদ্ভুত নিদর্শন এই শিব মন্দিরটি।বহু ভক্ত এখানে মানত পূরনের জন্য এসে থাকেন।
তারাপীঠ:
বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের চন্ডিপুরে অবস্থিত তারা মায়ের বিখ্যাত মন্দির,তারাপীঠ। মহাশ্মশানে তান্ত্রিক সাধনার পীঠস্থান ও সাধক বামাক্ষ্যাপার সাধন ক্ষেত্র-তারাপীঠ। সারা দেশ হতে এখানে ভক্তরা আসেন মায়ের দর্শন করতে। অমাবস্যার সময় তান্ত্রিক মতে এখানে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন ও পুজো -পাঠ সারা রাত ধরে চলতে থাকে।
108 শিবের মন্দির:
বর্ধমানের কালনাতে মহারাজা তেজ চন্দ্র বাহাদুর 1809 সালে স্থাপন করেন 108 শিবের মন্দির(মন্দির-গুচ্ছ)। বৃত্তাকারে এর ভেতরের দিকে 34 টি ও বাইরের দিকে রয়েছে 74 টি মন্দির। প্রতিটি মন্দিরেই শিব লিঙ্গ স্থাপিত হয়েছে।এই মন্দির গুলিকে “নব কৈলাশ মন্দির” ও বলা হয়।
মা নলাটেশ্বরী মন্দির:
বীরভূমের নলহাটিতে দেবীর একান্ন পীঠের অন্যতম সতীপীঠের অবস্থান। পুরান মতে সতীর গলা (নালা বা নলি) এখানে পড়ে তাই দেবী এখানে নলাটেশ্বরী রূপে পূজিতা। প্রচলিত মতে, কামদেব মায়ের স্বপ্নাদেশের ফলে জঙ্গল হতে নলাটেশ্বরী মাতাকে এনে মন্দির স্থাপন করেন।দূরদূরান্ত হতে ভক্ত সমাগমের ফলে এই স্থানের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
মা জহুরা কালী মন্দির:
আমের শহর মালদা হতে মাত্র দু- কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির, মা জহুরা কালী মন্দির। কথিত আছে রাজা বল্লাল সেন 1159 থেকে 1179 সালের মধ্যে এই মন্দিরটি তৈরি করেন। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার দিনের বেলাতেই মায়ের পুজো হয় এখানে। রাত্রে মন্দির বন্ধ থাকে।
মদন মোহন মন্দির:
কুচবিহারের বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন 1887 সালে প্রতিষ্ঠা করেন। চার চালা ও দালান মন্দির স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মন্দির। এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মদন মোহন রূপে বিরাজমান। রাস মেলা উপলক্ষে এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। মা ভবতারিণীর মন্দির ও রয়েছে পাশেই।
ইস্কন মন্দির:
নদীয়া জেলার মায়াপুরে অবস্থিত রাধা-কৃষ্ণের বিশ্ব বিখ্যাত মন্দির। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের, ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভক্তরা এসে বসবাস করেন এবং বৈদিক সভ্যতার দ্বারা নিজেদের জীবনযাত্রা কে জারিত করেন।এটি একটি তীর্থ শহরে পরিণত হয়েছে। সারাবছরই ভক্ত সমাগম থাকে এখানে।
বেলুড় মঠ:
হাওড়া জেলার বেলুড়ে ,গঙ্গার পাড়ে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ‘বেলুড় মঠ’ নামে অধিক পরিচিত।”আত্মানো মোক্ষনম্,জগৎ হিতায় চ” অর্থাৎ নিজের মুক্তি ও বিশ্ব কল্যাণের জন্য নিরন্তর সেবামূলক কাজ, করে চলেছে বেলুড় মঠ। ভক্ত সমাগমের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তির সামনে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয় এইখানে। সুন্দর শান্ত পরিবেশে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে এইখানে।
মন্দিরময় পশ্চিমবঙ্গে এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক মন্দির। যেমন- বিড়লা মন্দির (বালিগঞ্জ), ঘটেশ্বর মহাদেব মন্দির (বি.বি. গাঙ্গুলী স্ট্রিট), রাধা গোবিন্দ মন্দির (বিষ্ণুপুর),ধীরধাম মন্দির (দার্জিলিং), শিবাখ্যা মন্দির (বর্ধমান),মদনেশ্বর শিব মন্দির(বীরভূম),রাজরাজেশ্বরী মন্দির (কোন্নগর),কপিল মুনির আশ্রম ও মন্দির (গঙ্গা সাগর),পরামায়া মন্দির (নদীয়া), গৌরাঙ্গ মন্দির (কাটোয়া),আজুড়িয়ার মন্দির (পঃ মেদিনীপুর),ডাকাতে কালী মন্দির(ত্রিবেণী) প্রভৃতি।
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগুলি তার রচনার সময়কাল ও শৈলীর মধ্যে অনেক ইতিহাস বহন করে চলেছে। রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী এই শত-সহস্র মন্দির গুলি। বাংলার ইতিহাসের দলিল স্বরূপ এই মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ সর্বত্র সমান নয়।তাই অবহেলাতে অনেক ইতিহাস হারিয়ে যেতে বসেছে।
ড.সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)