দক্ষিণ দিনাজপুর চকরাম গ্রাম, মঙ্গলবার(১৮/০৮/২০২০)চুড়কা মুর্মু’র আত্মবলিদান দিবস উদযাপন
করনা মহামারীর করাল গ্রাসের মধ্যেও চুড়কা মুর্মুর- আত্মবলীদান দিবস মহাসমারহে পালিত হল দক্ষিণ দিনাজপুরের চকরাম গ্রামে, রক্তদানের মধ্যে দিয়ে। সামাজিক দূরত্ব এবং মাক্স পরেই সবাই কে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। চকরাম গ্রাম ও স্থানীয় মানুষদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। ৩১ জন উৎসাহী রক্তদাতা রক্তদান করেন। বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়। সকালে শহীদ বেদীতে পুষ্প ও মাল্যদান এর মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। উপস্থিত ছিলেন বালুরঘাট সাংসদ- ডঃ সুকান্ত মজুমদার (Dr. Sukant Majumdar), রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (R.S.S.) উওরবঙ্গ প্রান্ত সম্পর্ক প্রমূখ প্রদীপ সাহা, উওরবঙ্গ প্রান্ত সহঃ বৌদ্ধিক প্রমূখ উদয় শঙ্কর সরকার ও দিনাজপুর বিভাগ সেবা প্রমূখ সন্তোষ বেঙ্গনি। সমগ্র অনুষ্ঠান এর ব্যবস্থাপক ছিল- চুড়কা মুর্মু স্মৃতি সমিতি (বালুরঘাট)। উপস্থিত সকল বিদগ্ধ বক্তাগণ তাদের বক্তব্যে- সেই মহান, অমর, বীর কিশোরের কথা বলেন। দেশের সকল মানুষকে উজ্জীবিত করতে ১৮ই আগষ্ট এর রক্তঝরা দিনটির আত্ম বিশ্লেষণের আহ্বান জানান। এখন আমরা জানতে চেষ্টা করি কে এই চুড়কা মুর্মু আর কোথায় সে পেলো এতখানি আত্ম উৎসর্গের প্রেরণা –
আবির্ভাব :- ২রা জুলাই ১৯৫১ মহাপ্রয়াণ :- ১৮ই আগষ্ট ১৯৭১
১৯৫১ সালের ২রা জুলাই বর্তমান দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার চকরাম প্রসাদ গ্রামে চুড়কা মুর্মু জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খেলরাম মুর্মু মাতা সুমি হাঁসদা। ছেলেবেলা থেকেই তার মধ্যে দেশ প্রেম, সবার প্রতি দায়িত্বশীলতা ও কর্ম কূশলতা লক্ষ্য করা যায়।
তরুণ চুড়কা জে.এল.পি বিদ্যাচক্র বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। এরপর ১৯৬৯ সালে প্রথম বর্ষ সঙ্ঘ শিক্ষা সম্পন্ন করে সে নিজের গ্রামে শাখা শুরু করে। সে চকরাম শাখার মূখ্য শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে মনের আনন্দে কাজ করতে থাকে। বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কাজে তার অগ্রনী ভূমিকা থাকত। গ্রামবাসীদের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় সে গ্রামে একটি কূয়ো তৈরী করে। যে কোনো আপদে বিপদে মানুষের পাশে থাকা ও দেশের জন্য কাজ করাই যেন ছিল তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। গ্রামের সবাই চুড়কার আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হতেন।
পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো ভাগে ছিল ভারত। তাই সেই সময় ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে যুদ্ধের রনদামামা বেজে ওঠে।
১৯৭১ সালের ১৮ই আগষ্ট, পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তি ফৌজের ছদ্মবেশে ভারতের এক মাইল অভ্যন্তরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার চককালু গ্রামে পৌঁছে যায়। উদ্দেশ্য সেখান থেকে চকরাম গ্রামের বি.এস.এফ ক্যাম্প দখল করে নেওয়া। এই চকরাম গ্রাম দখল করতে পারলে তারা অত্যন্ত সহজে তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার জেলা সদর বালুরঘাট শহরে আঘাত হানতে পারবে। চককালু গ্রামে থেকে তারা চকরাম গ্রামের উপর গোলা গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা ভীত হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
ঐ গ্রামে বাস করত চুড়কা। চুড়কা মুর্মু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের চকরাম শাখার মূখ্য শিক্ষক। চুড়কা মুর্মু গ্রামবাসীদের ভয়ে পালিয়ে যেতে দেখে সে গ্রামবাসীদের বলল- ” দেশের এই বিপদে আমরা পালাব কেন ? চল আমরা বি.এস.এফ ক্যাম্প এ খবর দিই”। কয়েকজন কে নিয়ে চুড়কা বি.এস.এফ ক্যাম্প এ যায়। ক্যাম্পে তখন মাত্র ৪/৫ জন জাওয়াদ আছে। তারা ও প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জাওয়ানরা বলল- তাদের গুলির বাক্স বহন করার জন্য কয়েকজন কে চাই। কিন্তু কেউই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সাহস করে এগিয়ে আসছে না। এই কথা শোনামাত্র চুড়কা ও তার দুই বন্ধু গুলির বাক্স বয়ে নিয়ে যেতে রাজী হয়। চুড়কার বন্ধুরা গুলির বাক্স মাথায় করে একজন জাওয়ানের সঙ্গে গ্রামের দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে। খুব শীঘ্র তারা একটা পুকুরের পাশে পাটক্ষেতের মধ্যে উপস্থিত হয়। বি.এস.এফ জাওয়ানটি একটি বড় গাছের পিছনে পজিশন নেয়। জাওয়ানটি কে গুলি সরবারহ করার জন্য চুড়কা পাশের পাটক্ষেতে গুলির বাক্সসহ লুকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যরা জাওয়ানটিকে ঘিরে ফেলে ও আত্ম সমর্পন করতে বাধ্য করে। এমতাবস্থায় চুড়কা ভাবছে আমি ও তাদের হাতে ধরা পড়তে পারি। কিন্তু- “দেশের সম্পদ গুলি বারুদ বাক্স তাদের হাতে তুলে দেব না”। তাই সে গুলি বারুদ পাশেই একটা পুকুরে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুঃখের বিষয় আগের দিন রাতে প্রবল বারি বর্ষনের জন্য পুকুরের ধার পিছল হয়েছিল, ফলে সে গুলির বাক্স ছুড়ে ফেলতে গিয়ে পা পিছলে যায় এবং বাক্সসহ পুকুরে পড়ে যায়। পুকুরের অন্য পাড়ে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে দেখে ফেলে। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে চুড়কার দেহকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। সেই স্থানেই চুড়কা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এমনি ভাবে চুড়কা আরও অনেকের মত শহীদ এর ন্যায় বীরগতি প্রাপ্ত হয়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাপতির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। অনেক শহীদের বিনিময়ে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিনত হয়। সঙ্ঘের শিক্ষায় শিক্ষিত চুড়কা শিক্ষা দিল ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে দেশ। এই দেশ প্রেম এর সংস্কার তাকে সৈনিক এ পরিনত করল, দেশের বিপদে দেশবাসীর কর্তব্য কী তা চুড়কা তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে নিদর্শন রেখে গেল। বীর তরুণ চুড়কা প্রমাণ করে গেল যে বুকে সাহস ও দেশপ্রেম থাকলে একটা মানুষ কি করতে পারে।
দক্ষিণ দিনাজপুরে চকরাম গ্রামে গেলে আজ ও দেখা যায় চুড়কার শহীদ বেদী। প্রতি বছর ১৮ই আগষ্ট চুড়কার আত্মবলীদান দিবস মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। চুড়কা আজ নেই, কিন্তু তার অবিনশ্বর কীর্তি দেশবাসীর সামনে দেশ ভক্তি ও কর্তব্য পালনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।এই মহান দেশ প্রেম ও আত্মবলীদানের শিক্ষা ঐ তরুণ বয়সে চুড়কা পেল কোথায় ??
উওর হল- ডাঃ কেশব বলিরাম হেড গেওয়ার কতৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (R.S.S) এর নিত্যশাখায়। সেখানে গৈরিক ধ্বজের সামনে নির্দিষ্ট সময়ে, সমবেত ভাবে শিশু- তরুন- বালক তথা সমাজের সকল স্তরের মানুষ দেশ্বাত্ববোধক গান, ছোটো গল্প, বৈদিক মন্ত্র, যোগাসন, খেলাধুলার চর্চার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ শরীর ও মনের বিকাশের নিত্য সাধনা এবং দেশ্বাত্ববোধের পাঠ গ্রহণ করে। ১৯২৫ সাল থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এই নিত্য সাধনা চলে আসছে নিরবিচ্ছিন্ন ধারায়- হাজার হাজার চুড়কা মুর্মু তৈরীর মহান আদর্শকে সামনে রেখে।
মৃনাল মালিক
যোগ চিকিৎসক