টিয়ের মার বিয়ে
নাল গামছা দিয়ে॥
আশথের পাতা ধনে।
গৌরী বেটী কনে॥
নকা বেটা বর!
ঢ্যাম কুড়্ কুড়্ বাদ্দি বাজে, চড়কডাঙায় ঘর॥
প্রথম , দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্বে আমি লৌকিক এবং বিলুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় খেলা নিয়ে কথা বলার সময় বিভিন্ন রকমের খেলার উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে বাৎসায়ন তথা প্রাচীন বেশকিছু খেলার উল্লেখ করেছি। সেই সমস্ত খেলা উল্লেখ করতে গিয়ে আমি একটি খেলার নাম বলেছিলাম – #লবণ_বিথীকা । একসময় বঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এই খেলাটির #নুনঘর , #নুনকোট #নুনপালা ইত্যাদি নামে প্রচলিত ছিল। বিশেষত বীরভূম ,বর্ধমান , নদীয়া জেলায় প্রচলি উক্ত খেলাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
উক্ত খেলায় বালক-বালিকারা পৃথক পৃথকভাবে অথবা দলবদ্ধ হয়ে খেলতে পারত। খেলায় বালক এবং বালিকা কোন নির্দিষ্ট সংখ্যার প্রয়োজন পড়ত না।
খেলাবার জন্য প্রথমে একটি ঘর আঁকতে হত। সেই খেলাঘর কয়েকটি কুঠুরিতে বিভক্ত থাকত। কুঠুরিরও কোন বাঁধাধরা সংখ্যা থাকত না। বালক বালিকার সংখ্যা বাড়লে কুঠুরি সংখ্যা বাড়াত। উপরের ঘরটি ছয় কুঠুরিতে বিভক্ত থাকত। ছয় সংখ্যক ঘরটি নুনঘর নামে পরিচিত।
ধরা যাক – ৬ জন বালক বালিকা দুই দলে বিভক্ত হয়ে খেলার সূচনা করত। তিনজন বালক বা বালিকা বা বলা ভালো খেলোয়াড় এক চিহ্নিত কুঠুরির মধ্যে এসে দাঁড়াত। এই তিনজন উক্ত ঘর হতে বেরিয়ে দুই , তিন চার , পাঁচ সংখ্যক ঘর পর হয়ে ছয় বা নুনঘরে পৌঁছত। তারপর নুনঘর থেকে বেরিয়ে পুনশ্চ এক সংখ্যক ঘরে এসে দাঁড়ালে খেলায় জিৎ হতো। তবে বিষয়টা এতো সহজ ছিল না । কারণ , অপর তিনজন খেলোয়াড় উক্ত তিনজনকে বাঁধা দেবার চেষ্টা করত। একজন ‘ক’ চিন্হ স্থান দাঁড়িয়ে থাকত এবং সে ক, ঘ ,চ ,খ চিহ্নিত সরল রেখাটি ধরে সমস্ত পথকেই আলাতে পারত। অপর জন “গ” চিন্হ ঘরে দাঁড়াত এবং অপর জন “ঙ ” স্থানে দাঁড়াত। “গ” চিহ্নের খেলোয়াড় “ঘ” চিহ্নিত পথ পর্যন্ত এবং ” ঙ” চিহ্নের খেলোয়াড় “চ” চিহ্নিত পথ পর্যন্ত আগলাতে পারত। ওই দুই সরল রেখা ভিন্ন তারা আর কোনো স্থানে যেতে পারত না বা আগলাতে পারত না।
খেলা সূচিত হলে , এক সংখ্যক ঘরে যে তিনজন খেলোয়াড় থাকত , তাদের একজন কোনোক্রমে বের হয়ে দুই চিহ্নিত ঘরে এসে দাঁড়াত। এদিকে অপর দুজনের মধ্যে একজন প্রথমেই নুনঘরে পৌঁছে যেত। তখন যে নুনঘরে পৌঁছাত তাকে পুনশ্চ সব ঘর ঘুরে এসে এক সংখ্যক ঘরে দাঁড়াতে হতো। এইরূপে যাতায়াতের সময়ে অপর পক্ষের কোনো খেলোয়াড় যদি তাকে ছুঁয়ে দিতে পারত তবে নুনঘরের খেলোয়াড়ের দলের সকলে হেরে যেত। তখন অন্য দল এক চিহ্নিত ঘরে এসে দাঁড়াত এবং পূর্বোক্ত দল তাদের বাঁধা দেবার জন্য পূর্বের পদ্ধতি মতো আপন আপন স্থানে গিয়ে দাঁড়াত। কিন্তু যে খেলোয়াড় দুই চিহ্নিত ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল , সে তিন চিহ্নিত ঘরে আসবার সময় কিংবা যে এক চিহ্নিত ঘরে হতে বের হতে পারেনি সে বার হয়ে দুই চিহ্নিত ঘরে আসবার সময় যদি অপর পক্ষের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিত তবে কেবল সেই খেলা থেকে বের হয়ে যেত, দল হারত না, বাকি খেলোয়াড়রা খেলতে পারত।
যদি সকলে নুনঘরে এসে পৌঁছে যেত এবং অপর পক্ষ কাউকেও ছুঁতে না পারত ,তবে নুনঘর হতে বের হয়ে যাবার সময় একজন খেলোয়াড় অপর পক্ষ কর্তৃক ছোঁয়া পড়লে দলের সকলে হেরে যেত।
এক চিহ্নিত ঘর থেকে বাইরে যাবার সময় অপর পক্ষকে বিভ্রান্ত করার নিমিত্ত কোনো খেলোয়াড় এক চিহ্নিত কুঠুরি হতে পাঁচ চিহ্নিত কুঠুরিতেও আসতে পারত। সে ক্ষেত্রে এই খেলোয়াড়কে সব কুঠুরি ঘুরেই নুনঘরে পৌঁছতে হতো এবং পুনরায় বেরিয়ে এক চিহ্নিত কুঠুরিতে ফিরতে হতো। এই অসুবিধার জন্য সাধারণত খেলোয়াড়ের দল দুই , তিন, চার, পাঁচ এই ক্রম অনুসারে কুঠুরিগুলি ঘুরে যেত। স্থানভেদে খেলার নিয়ম কানুনের হয়ত কিছু এদিক ওদিক ছিল । তথাপি উল্লিখিত ক্রম হতে খেলার পদ্ধতিটি কিছু জানা যাবে বলে আশা রাখি। এই খেলায় শ্রমশক্তি , সতর্ক দৃষ্টি এবং স্ফূর্তির আবশ্যকতা ছিল। ব্যায়ামের দিক হতেও একে উপেক্ষা করা যায় না।
আরো একটি প্রাচীন খেলার উল্লেখ করেছিলাম, তার নাম #আরব্ধিকা । শব্দ করে খেলা হতো বলেই নাম আরব্ধিকা। গ্রামের অনেক খেলাই আরব্ধিকার পর্যায়ে পড়ে। এমনই একটি আরব্ধিকা খেলার নাম #চাকাচুয়া। একটি সীমানা নির্দিষ্ট করে সমান ব্যবধানে দুই পক্ষ গিয়ে দাঁড়াত। দুপক্ষেই বালক বা বালিকা বা খেলোয়াড় সমান সংখ্যায় থাকত। এক পক্ষের একজন প্রথমে “চু――” বা এরম কোনো শব্দ বলে অপর পক্ষের খেলোয়াড়কে ছোঁয়ার চেষ্টা করত। অপর পক্ষ পালিয়ে বেড়াত। কেউ যদি ছোঁয়া পড়ত তবে সে এসে বিপক্ষ দলে যোগ দিত। এবং সে পুনরায় বিপক্ষের হয়ে অন্য পক্ষকে ছোঁবার প্রচেষ্টা করত।
শব্দ করে ঘোরবার সময় যদি শব্দ বন্ধ হয়ে যেত এবং সেই সময় অন্য পক্ষ তাকে ছুঁতে পারত , তখন সে পুনরায় অন্যপক্ষে গিয়ে যোগ দিত। #হা_ডু_ডুর সঙ্গে এর পার্থক্য এই যে , একজন অন্য পক্ষের নিকট হারলে সেই পক্ষের দলে ভিড়ে যেত এবং সেই পক্ষের হয়ে খেলতে পেত। একটি দলকে ছুঁয়ে নিঃশেষ করতে পারলেই জিৎ হতো।
এরকম আরো কিছু খেলা যদিও এখনো ভারতের গ্রামে গ্রামে প্ৰচলিত আছে – যেমন কিৎ কিৎ বা এক্কা দোক্কা।
দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচলিত এক্কা দোক্কা খেলা। অবশ্য অঞ্চলভেদে এর নামের ভিন্নতা রয়েছে। কোথাও কোথাও একে সাতখোলা এবং চিরিয়া নামেও ডাকা হয়। বাড়ির উঠোন কিংবা খেলার মাঠে মাটিতে দাগ কেটে আয়তাকার ঘর কাটা হয়। সে ঘরে আড়াআড়ি রেখা টেনে ছয়টি খোপ করা হয়। এর মধ্যে চার নম্বর ঘরটি হচ্ছে বিশ্রামঘর। নিচ থেকে ঘরগুলির নাম যথাক্রমে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌক্কা, পক্কা ও লাষ্ঠি। ভাঙা হাঁড়ি বা কলসির গোলাকার টুকর হচ্ছে খেলার উপকরণ; এটি চাড়া, ঘুঁটি, ডিগা, খোপলা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
চাড়াটিকে এক এক করে প্রতিটি ঘরে ছুঁড়ে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পায়ের টোকা দিয়ে এমনভাবে বাইরে নিয়ে আসা হয় যেন তা কোনো দাগের ওপর না থেকে যায় কিংবা পাশের দাগ অতিক্রম করে না যায়। চাড়াটি কোনো দাগের ওপর থেমে গেলে বা পাশের দাগদুটির কোনো একটি অতিক্রম করে গেলে সে দান হারায়। তখন পরবর্তীজন দান পায়। সে সফলভাবে সবগুলো ঘর পার হয়ে আসতে পারে তার জিত হয়। মেয়েরা একা একা কিংবা দল বেঁধে এক্কা দোক্কা খেলে থাকে।
এসব বলতে বলতে মনে পড়ল আমার ঠাকুমা ভালো গুটি খেলতে জানতেন। একটা সময় ঘরোয়া পরিবেশে তাদের কাছে কড়ি, তিন গুটি, পাঁচ গুটি, ছয় গুটি, দশ গুটি প্রভৃতি খেলা তাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর প্রায় প্রতিটি খেলার সাথে জড়িয়ে থাকত বিভিন্ন ছড়া-গান। আমাদের লোক-সাহিত্যে এ ছড়া গানগুলো অত্যন্ত মূল্যবান।
পাঁচ গুটি খেলার একটি ছড়া কাটা হতো। সেটা ঠাকুমা আমাকে শোনাতেন মাঝে মাঝে –
‘তেলোটা কামিনী
গুটিকে যামিনী
ও তিনশো টাকা
চার শো দানা
পঞ্চমীটা কানা।।’
এছাড়াও একসময়ে পলাপলি, শব্দ খেলা, শালিক পাখি নমষ্কার, সাত ধাপ্পা, ইত্যাদি খেলারও খুব চল ছিল।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস
২) গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি