শিকাগো শহরে পয়লা মে শ্রমিক ধর্মঘট আজ বিশ্ব ইতিহাসের পাতা থেকে স্কুলপাঠ্যে যেমন ঠাঁই পেয়েছে, তেমনই বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের প্রেক্ষিতেও দিনটার অন্য তাৎপর্য আছে। এ দিনেই উত্তর কলকাতায় রামকৃষ্ণ-পার্যদ বলরাম বসুর বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ পরমহংসদেবের চিন্তা, উপদেশ ও আদর্শ প্রসারের আন্দোলন নামে এক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অদ্ভুত সমাপতন!
বিবেকানন্দ বরাবরই ভারতের শ্রমজীবীদের জন্য গলা ফাটিয়েছেন। বলেছেন, “এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উল্টে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রিলোকে এদের তেজ ধরবে না।” পরিব্রাজক জীবনে স্বামীজি ভারতের নিপীড়িত অবহেলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি, শান্তি ও ভালবাসার মেলবন্ধন দেখেছিলেন। স্বপ্নদিশারি বিবেকানন্দের নতুন ভারত তৈরি হবে চাযা-জেলে-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ি থেকে। তাঁর মতে, আমাদের জাতির জীবনের স্পন্দন ‘দরিদ্রের কুটিরেই’।
ক্যালিফর্নিয়া থেকে ১৯০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখেছেন, “আমাদের নিশন হচ্ছে অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ চাষাভুযোর জন্য; আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য।” এই হল রামকৃষ্ণ যুগধর্ম। রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য। শুধু নিজের মুক্তির জন্য সন্ন্যাস নয়। স্বামীজির স্মৃতিতত্ত্বে, পিছিয়ে পড়া সর্বহারা আর্ত-পীড়িতদের শিবজ্ঞানে সেবাও হল সন্ন্যাসীর কর্তব্য। আসলে স্বামীজি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন এক বৌদ্ধিক কর্মপ্রবাহ তৈরি করে গিয়েছেন। সেই বৌদ্ধিক কর্মপ্রবাহ থেকেই ভারতে একটা নতুন সমাজ তৈরি হবে। তাঁর আহ্বান শূদ্র জাগরণ। সেই সূত্র ধরেই তিনি লিখেছিলেন, “ক্রমে ওদেরই মধ্য হতে শিক্ষক বেরুবে।” কিন্তু এই শিক্ষকরা নিছক চাকুরে হবে না। মানি মেকিং এডুকেশনের সঙ্গে ম্যান মেকিং এডুকেশনও চলবে— এটাই প্রত্যাশিত। সেই প্রত্যাশা নিয়েই হাজার বছরের পদানত ভারতের জন্য তাঁর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা। এ প্রসঙ্গে মিস মেরি হেল-কে স্বামীজি লিখেছেন, “কেবল একটা ভাব আমার মাথার ভিতর ঘুরছিল— ভারতবাসী জনসাধারণের উন্নতির জন্য একটা যন্ত্র প্রস্তুত করে চালিয়ে দেওয়া। আমি সে বিষয়ে কতকটা কৃতকার্য হয়েছি। অথচ প্রথম বার বিদেশ থেকে এসে আলমবাজার মঠে আর্তদের সেবার নিয়ম যখন ঢালু করেছিলেন, তখন তাঁকে কয়েক জন গুরুভাইয়ের প্রতিবাদ সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁদের অভিযোগ, “বিদেশী ভাব দ্বারা কলুষিত।” যদিও অল্প দিনের মধ্যেই তাঁদের ভুল ভাঙে ও বাদপ্রতিবাদ ‘হাওয়া’ হয়ে যায়। স্বামী প্রভানন্দের মত, “বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত মঠ, মিশন, অদ্বৈত আশ্রম, বেদান্ত সোসাইটি প্রভৃতির প্রাতিষ্ঠানিক উৎস এই রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন।” সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার দু’মাস পর বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন, “জোর তিন চার বছর জীবন অবশিষ্ট আছে।… আমি দেখতে চাই যে, আমার যন্ত্রটা বেশ প্রবলভাবে চালু হয়ে গেছে; আর এটা যখন নিশ্চয় বুঝব যে সমস্ত মানবজাতির কল্যাণে অন্তত ভারতে এমন একটা যন্ত্র চালিয়ে গেলাম, যাকে কোন শক্তি দাবাতে পারবে না, তখন ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে আমি ঘুমোব।” সোজা কথায়, স্বামীজির কাছে, ভারতের উন্নতি আর রামকৃষ্ণধর্ম একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাঁর উপাস্য পাপী নারায়ণ, তাপী নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্র নারায়ণ। এঁরাই স্বামীজির আরাধ্য। তাই তাঁদের প্রয়োজন হলেই রামকৃষ্ণ-যন্ত্র তার সাধ্যটুকু নিয়ে নতমস্তকে এগিয়ে যায়। প্রয়োজনই এখানে মুখ্য। দাবি গৌণ। শিকাগোর মে দিবস আর কলকাতার মে দিবসের এখানেই ফারাক।
এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটি ঘটনা ও স্মরণযোগ্য। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে সপরিবার মথুরানাথ বিশ্বাস তাঁর বাবা রামকৃষ্ণকে নিয়ে তীর্থে বেরিয়েছিলেন। দেওঘর-বৈদ্যনাথের কাছে গ্রামবাসীর দুঃখ দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরানাথকে বলেন, গ্রামের লোকেদের একমাথা করে তেল, একটা করে কাপড় আর পেটপুরে খাওয়াতে হবে। একটা গ্রামের লোকের কথা ভেবে মথুর পিছিয়ে যেতেই শ্রীরামকৃষ্ণের গোঁ, ‘দূর শালা, তোর কাশী আমি যাব না। আমি এদের কাছেই থাকব, এদের কেউ নেই, এদের ছেড়ে যাব না।” শেষে মথুরানাথ কলকাতা থেকে কাপড় আনিয়ে গ্রামের হতদরিদ্রদের দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের কাছে জীবই শিব। সেই শিবরূপ জীবের সেবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা। গুরুভাই অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি লিখেছিলেন, “মানুষ কাজ যদি করে— তাকে কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? তোমাদের মতো যদি ২০০০ লোক জেলায় জেলায় কাজ করে—ইংরেজরা ডেকে রাজকর্ণে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করবে।” স্বামীজির সেই কথাও অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার শিক্ষা-স্বাস্থ্য-দানবসম্পদ বিকাশ-সহ নানা ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রকল্পের সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনকে বেছে নিচ্ছে।
একবিংশ শতকের প্রথম পাদে আমাদের দেশের স্কুলপাঠ্য বইয়ে যে মে দিবস-এর কথা আছে, সেই মে দিবসের সঙ্গে যে দিন রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ইতিহাসবিদরা আলোচনা করবেন, সে দিনই আসবে স্বামীজির স্বপ্নের নতুন ভারত।
2019-05-01