তায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
হতাে বা প্রান্সসি স্বর্গং জিত্বা বা ভােক্ষ্যমে মহীম্।।
তস্মাদুতিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ।।২/৩৬।
যদি তুমি যুদ্ধে নিহত হও, তাহলে স্বর্গলাভ করবে আর যদি জয়লাভ করাে তাহলে পৃথিবীর রাজত্ব ভােগ করবে। তাই হে অর্জুন! তুমি যুদ্ধের জন্য দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে উত্থিত হও।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বৈদেশিক আক্রমণকারী গজনির দ্বারা ধ্বংস হওয়া সােমনাথ (দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ) মন্দিরের পুনর্নির্মাণ তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লৌহপুরুষ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সংকল্প ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে সম্ভব হয়েছিল। যদিও তাঁকে অনেক বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরােধিতা সর্দারজী তােয়াক্কা করেননি। রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ মন্দিরের উঘাটন করেন। তাকেও জওহরলাল নেহরুর বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয় যাতে তিনি সােমনাথ মন্দির উদঘাটন অনুষ্ঠানে না যান। জানা যায়, মন্দির উদ্বাটন অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রয়ােজনে রাষ্ট্রপতির পদও তিনি ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন। সােমনাথ মন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাভিমান পুনরুদ্ধারের অঙ্গ ছিল।
দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছর নিরন্তর সংঘর্ষের পর অযােধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমিতে হিন্দু সমাজ বিজয় লাভ করেছে। কেবল হিন্দু সমাজ নয়, কেবল ভারতবর্ষ নয়, সম্পূর্ণ বিশ্বের কাছে এটি একটি অভূতপূর্ব এবং বিস্ময়কর ঘটনা। কোনাে রাষ্ট্র কোনাে জাতি কতটা স্বাভিমানী হলে এটা সম্ভব হতে পারে।
শ্রীরামজন্মভূমি নিয়ে হিন্দু সমাজ যে লাগাতার সংঘর্ষ করে এসেছে, আপােশহীন লড়াই চালিয়েছে, বিশ্বে এরকম আর কোনাে উদাহারণ নেই। রামজন্মভূমির জন্য কোনাে প্রকার আপােশ বা সমঝােতা হিন্দু সমাজ কখনও করেনি। ভগবান শ্রীরামের প্রতি হিন্দুর আস্থা-শ্রদ্ধা আবহমানকাল ধরে ভারতীয় জীবনের অঙ্গ — ‘সিয়া-রাম ময় সব জগ জানি, করহি প্রণাম জোরী যুগ পানী’। অনেক আক্রমণ, অনেক অত্যাচার বিশ্বের ইতিহাসে প্রায় বিরল বলা যায় সে সত্ত্বেও হিন্দুসমাজ তার আরাধ্য প্রভু শ্রীরামকে কখনও ভােলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই তার জন্মভূমির উপর বিধর্মীর আধিপত্য হিন্দু কখনও মেনে নেয়নি।
১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবরের আদেশে তার সেনাপতি মীর বাকি যখন শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির ধ্বংস করে তখন অযােধ্যার আপামর হিন্দু সমাজ সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের আরাধ্য প্রভু শ্রীরামের মন্দির রক্ষার জন্য প্রাণপাত সংঘর্ষ করে। মুঘল আক্রমণকারীরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হওয়ার ফলে হিন্দু সমাজ অধিক সময় এই প্রতিরােধ বজায় রাখতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে জন্মভূমিকে যুক্ত করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা করেছে। অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, অনেক বলিদান দিয়ে জন্মভূমিকে উদ্ধারের চেষ্টা অনবরত চালিয়ে গেছে। কখনও হিন্দুরা জয়লাভ করেছে, কখনও আবার মুসলমান শাসকরা পুনরায় জন্মভূমিকে কবজা করেছে।
বছরের পর বছর, যুগ যুগ ধরে শ্রীরামজন্মভূমিকে মুক্ত করার জন্য হিন্দু রাজা-মহারাজা, ধর্মগুরু, সাধু-সন্ন্যাসীরা তথা দেশের আপামর রামভক্ত এই স্থানটির জন্য সর্বস্ব বলিদানের, পরাক্রমের, আত্মত্যাগের এক উদাহরণ প্রস্তুত করেছে। সেই সময়কার প্রায় সহায় সম্বলহীন হিন্দু সমাজ কীভাবে অত্যাচারী বর্বর মুসলমান শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তা আজ ইতিহাসকার, চিন্তক , বিদ্বান ও গবেষকদের কাছে এক বিস্ময়ের বিষয়। শত অত্যাচারেও হিন্দুর সেই চেতনা কখনও লুপ্ত হয়নি। যখন সুযােগ পেয়েছে তখনই স্বাভিমানী হিন্দু সমাজ তার হৃতগৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে লড়াই করেছে।
ইসলামি শাসনের অবসানের পর ইংরেজ রাজত্ব শুরু হলে, তখনও জন্মভূমির বিষয়ে তাদেরও নীতির কোনাে পরিবর্তন হয়নি। জন্মভূমিকে হিন্দুর হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। হিন্দু সমাজ কিন্তু থেমে থাকেনি। জন্মভূমিকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা দিন প্রতিদিন আরও তীব্র হয়েছে। কোনাে এক সময়ে হিন্দু মুসলমান উভয়ই সহমত হলে কুটকৌশলী ইংরেজ তা বানচাল করে বিবাদ জিইয়ে রাখে। শুধু তাই নয়, যারা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিল এরকম উভয় পক্ষের কয়েকজনকে ইংরেজ শাসক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, হিন্দুদের দ্বারা জন্মভূমিকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত ধাঁচা মেরামতের সম্পূর্ণ খরচ ইংরেজ শাসক শাস্তিস্বরূপ হিন্দুদের নিকট হতে জবরদস্তি আদায় করে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ধাঁচা মেরামত করেছে —এরকম প্রমাণও আছে।
তা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজ চুপ করে বসে থাকেনি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাসকারী হিন্দু, বিভিন্ন ভাষাভাষী হিন্দু, পৃথক পৃথক গুরু পরম্পরা অনুসরণকারী হিন্দু, বনবাসী-শহরবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-নিধন, মহিলা-পুর, কবি-সাহিত্যিক-লেখক-শিল্পী কোনাে না কোনাে সময়ে শ্রীরামজন্মভূমির বিষয়ে সােচ্চার হয়েছেন। হিন্দু যেমন কখনও রামকে ভােলেনি ঠিক সেই রকমই ভগবান শ্রীরামের জন্মস্থানকে মুক্ত করার কথা কখনও ভােলেনি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে গেছে কিন্তু হিন্দুর ধমনীতে পুরুষানুক্রমে এই অন্যায়-অপমান-কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়ার চেতনা সদা জাগ্রত থেকেছে। আমাদের দেশের সাধু-সন্ন্যাসীগণ, ধর্মগুরু, মনীষীগণ, রাষ্ট্রনায়কগণের বিশেষ ভূমিকা এ বিষয়ে কখনও অস্বীকার করা যাবে না। জাতির চেতনাকে সদা জাগ্রত (অলখ নিরঞ্জন) রাখার কাজ এই মহান বিভূতিরা করেছেন।
বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণও দেখতে পাই। ইজায়েল থেকে ইহুদিরা যখন বিধর্মীদের দ্বারা পরাভূত হয়ে তাদের নিজভূমি থেকে উৎখাত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী রূপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তখন শত সমস্যার মধ্যেও তারা তাদের নিজ মাতৃভূমি ও ভাষা হিব্রুকে কখনও ভােলেনি। ইজরায়েলকে বিদেশিদের থেকে মুক্ত করার সংকল্প তারা কখনও ভােলেনি। দুনিয়ার যেখানেই তারা থেকেছে সেখান থেকেই তারা আগামী বছর জেরুজালম (ইজরায়েলর রাজধানী)-এ স্বাধীনতা দিবস পালন করার সংকল্প বার বার স্মরণ করেছে। আগামী বছরই তারা জেরুজালম উদ্ধার করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু তাদের জাতির স্বাভিমানী চেতনা কখনও লুপ্ত হয়নি যে তাদের দেশ পরাধীন, তারা বিদেশিদের পদানত হয়ে আজ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে শরণার্থী রূপে অবস্থান করতে হচ্ছে। একটি জাতির সেই স্বাভিমানী মানসিকতা দৃঢ় সংকল্পের পরিণাম স্বরূপ আমরা জানি যে প্রায় ২০০০ বছর পর তারা ইজরায়েলকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছে। আজ তাদের প্রতিবেশী অনেক শক্তিশালী ইসলামি দেশগুলাে ইজায়েলের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে পারে না। ইজরায়েলের মানসিকতার সঙ্গে শ্রীরামজন্মভূমি উদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ ভারতবাসীর মিল অনেকটাই।
শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির কোনাে সামান্য মন্দির নির্মাণের আন্দোলন ছিল না। এটি বাস্তবে রাষ্ট্রমন্দির নির্মাণের আন্দোলন। আমাদের দেশে রাম রাষ্ট্রের কল্পনা আছে। গান্ধীজীও রামরাজ্যের কথা বলেছেন। রামরাজ্য মানে এক আদর্শ রাষ্ট্র যেখানে সমস্ত নাগরিক ন্যায় পাবেন, এক সুশাসন সম্পন্ন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা তথা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সহ সর্বপ্রকারের উন্নতিসম্পন্ন এক রাষ্ট্র। এ সবকিছু তখনই সম্ভব হবে যখন কোনাে জাতি কোনাে রাষ্ট্র স্বাভিমানী হবে, আত্ম মর্যাদাসম্পন্ন হবে; নিজ মহাপুরুষ, নিজ ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতির প্রতি গর্ববােধ করবে, শ্রদ্ধাবিন্দুগুলির ওপর পূর্ণ আস্থা থাকবে— আর এগুলির মূলে কিন্তু আধ্যাত্মিকতা। যুগ যুগ ধরে ভারতের হিন্দুরা সমাজ জীবনে ধর্মকে ধারণ করে চলেছে। তাই শত অত্যাচারেও হিন্দু নিজ সত্তা কখনও বিসর্জন দেয়নি।
বিদেশি আক্রমণকারী শাসকরা ভেবেছিল কিছুমন্দির ধ্বংস করে, ধর্মগ্রন্থ নষ্ট করে, তীর্থস্থান অপবিত্র করে, ধর্মান্তরিত করে, সর্বত্র। এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে ভারতকেও সম্পূর্ণ ইসলামিক দেশে পরিণত করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কারণ ভারতের মূলে যে ধর্মচেতনা আর সেখান থেকে রাষ্ট্রচেতনা তা থেকে ভারত কখনও বিচ্যুত হয়নি। ঋষি। অরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী রামতীর্থ প্রমুখ মনীষীর জীবনে ধর্মচেতনা ও রাষ্ট্রচেতনা সমার্থক ছিল। যেখানে মর্যাদা পুরুষােত্তম ভগবান শ্রীরামকে জীবনাদর্শ রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমাজকে পথ দেখিয়েছেন। যেখানে গীতা, রামায়ণ-মহাভারত জীবনের অঙ্গ সেখানে বিজয় নিশ্চিত।
১৫২৮-এ অযােধ্যায় রামজন্মভূমি পুনরুদ্ধারে যে সংঘর্ষ আমাদের পূর্বপুরুষেরা শুরু করেছিলেন তা কিন্তু একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। এ আন্দোলন শুধু অযােধ্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতের সর্বত্র সকল রাষ্ট্রভক্ত রামভক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাম এখানে রাষ্ট্রনায়ক – রাজারাম; তিনি সকল হিন্দুর হৃদয়ের রাজা, তাকে মুছে ফেলা যায় না। গােস্বামী তুলসীদাসের জীবনের ঘটনার কথাও আমরা জানি যে, আকবর যখন দরবারে তাঁকে বাদশার সম্মানে নতমস্তক হতে বলে তখন তিনি তুলসীদাস প্রত্যাখান করে বলেন যে আমার তাে রাজা শ্রীরাম। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রই হচ্ছেন একমাত্র রাজা, তিনি কেবল তাঁর সামনেই নতমস্তক হন। দুর্দণ্ডপ্রতাপ আকবর বাদশার ভূকুটি কিন্তু তাঁকে নতমস্তক করাতে পারেনি। এই চেতনা, এই স্বাভিমানের কারণেই আজ ৫০০ বছর পর অযােধ্যায়। শ্রীরামজন্মভূমিতে হিন্দুর বিজয় পতাকা উত্তোলিত হলাে।
একটি স্বাভিমানী জাতি তার রাষ্ট্রীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আনন্দে উদ্বেলিত। যাঁদের আত্মবলিদান, ত্যাগ, তপস্যায় এ বিজয় সম্ভব হলাে জাতি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধাবনত। সমগ্র বিশ্ব এই বিজয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল।
করুণা প্রকাশ