বিজয় সিং নাহার ১৯০৬ সালে মুর্শিদাবাদের আজিমগন্জের এক বর্ধিষ্ণু জৈন পরিবারে জন্মগ্ৰহণ করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এই কৃতী ছাত্রটি আত্মোন্নতি সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কংগ্ৰেসে যোগ দিয়ে দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। কংগ্ৰেস পরিষদীয় দলের সদস্য ছিলেন, কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও সামলেছেন । স্বাধীন ভারতে কংগ্ৰেসের টিকিটে বিধানসভায় নির্বাচিত হন। বাংলা কংগ্ৰেসের অজয় মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রীসভায় উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন।
পরে কংগ্রেস ত্যাগ করে জনতা পার্টির হয়ে লোকসভায় নির্বাচিত হন কলকাতা উত্তর পশ্চিম কেন্দ্র থেকে, ১৯৭৭ সালে।
‘তরুণ জৈন’ পত্রিকার সম্পাদক এই নিরামিষভোজী নেতা অত্যন্ত দাপুটে ও ডাকাবুকো বলে পরিচিত ছিলেন। ১৬ই আগস্ট, মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্ৰামের সেই দূর্যোগের দিনে তিনি কলকাতার শান্তিরক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
Direct Action Day ; তালতলায় প্রতিরোধ
…………………………………………………………..
বিজয় সিং নাহার (Vijay Singh Nahar)
1946 সালের 16 ই আগস্ট এর আগে থেকেই স্বতন্ত্র পাকিস্তান গঠনের দাবি উঠেছিল। এই দিনটি মুসলিম লীগ Direct Action Day ঘোষণা করে। ওদের শ্লোগান হলো, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কলকাতার ময়দানে সভা হল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ. এস. সুরাওয়ার্দী সাহেব গরম গরম বক্তৃতা দিলেন। সেইসময় প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত। জনসভা শেষ হবার পর লুটপাট , দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ হল। ওই দিনে আমরা একটা কিছু গন্ডগোল ঘটার ব্যাপার আগেই আঁচ করেছিলাম। সুরাওয়ার্দী তালতলায় থাকতেন, প্রায়ই দেখা হত। কেননা জায়গাটা আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে তার মতিগতি দেখে বুঝতে পারতাম যে কলকাতায় দাঙ্গা বাধাবার একটা তাল তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছে। আমরা গোলমাল আন্দাজ করেছিলাম। 1946 সালের 16 ই আগস্ট বিকেলে বাড়ির একতলায় বসে আছি। হঠাৎ খবর এলো ওয়েলিংটন স্কোয়ারের আশেপাশে ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম। দেখি কি ব্যাপার। ওয়েলিংটনের মোড়ে দোকানপাট ভাঙ্গা হচ্ছে। বাধা দিলাম। চারিদিকে মুসলমান। ওদেরকে ধমক দিলাম। কি হচ্ছে, কেন ভাঙচুর করছে? এদিকে হঠাৎ দেখলাম একটা লোক আমার ওপরই তরোয়াল তুলেছে কোপ মারতে। ভাগ্যক্রমে আর একজন সেই লোকটাকে হাত দিয়ে আটকে দিল। বোধহয় আমাকে চিনতে পেরেছে। সব দেখে বুঝলাম যে একা বাধা দিয়ে লাভ নেই । বাড়ি ফিরে এলাম।
বাড়িতে মধুসূদন রায় ছিল। আমরা দুজনে লাঠি নিয়ে বেরলাম। পাড়ার সব বাড়ির দরজা বন্ধ। দাঙ্গাবাজরা ওয়েলিংটন পেরিয়ে ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে ঢুকেছিল। খবর পেলাম কুমার সিং হল ওদের লক্ষ্যস্থল। কারণ এই জায়গাটা কংগ্রেসের বড় ঘাঁটি । তখন ব্রিটিশ সরকারের ভয়ে অনেকেই মিটিং করার জন্য বাড়িতে জায়গা দিতে সাহস করতো না ।আমরাই আমাদের বাড়ি কুমার সিং হল কংগ্রেসের মিটিং করার জন্য দিতাম । এই স্থানটি ভাঙার জন্য ওরা দলে দলে এগিয়ে আসছে । রাস্তা ফাঁকা, কোনো বাধা নেই । আমি এবং মধু মাত্র দুজন। লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে আমরা রাস্তায় নেমে পরলাম ।এগিয়ে চললাম ।দাঙ্গাকারীদের মোকাবিলা করে তাদের দূরে ঠেলে দিতে লাগলাম। লাঠি খেলতে আমি আর মধু দুজনেই খুব পটু ছিলাম। বিপ্লবী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লাঠি খেলাটা আমাদের সকলকেই শিখতে হয়েছিল । আমরা বিপ্লবী হরিশচন্দ্র শিকদারের কাছে লাঠি চালানো শিখে ছিলাম। অভ্যাস রাখতাম । তখনও বোমার যুগ শুরু হয়নি । দাঙ্গাকারীদের হাতে ছোরা অনেক ছিল । আমরা মারমুখী হয়ে এগোতেই আক্রমণকারীরা পিছু হটতে শুরু করলো । আমাদের খেয়াল নেই যে আমি আর মধু কখন আলাদা হয়ে গেছি। হঠাৎ দেখি আমি একা । কি করে বাঁচাবো সেই চিন্তা । এদিকে আমার বাড়ির ছেলেরা কাগজ আর নেকড়া পাকিয়ে রেখেছিল। কেরোসিন তেলে ভালো করে ডুবিয়ে মোমবাতির আগুন জ্বালিয়ে, সেই বল একটা বাড়ির বারান্দা থেকে ছোড়া হচ্ছিল । সেই আগুন দেখে মিছিলের অনেক লোক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে । রাস্তা ফাঁকা । ভাগ্যক্রমে একটি জিপ দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে । আমি ঝট করে জিপটার আড়ালে দাঁড়ালাম । সেযাত্রা ভগবানের দয়ায় বেঁচে গেলাম।
রাতে বাড়ি এবং দোকান ভাঙচুর আবার শুরু হয়েছে। দাঙ্গা পুরোদমে চলছে । আমাদের বাড়ির সামনে ধর্মতলা স্ট্রিটে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার থাকতেন । তাদের বাড়ি থেকে ভীষণ হল্লার আওয়াজ আসছে । ঝাড়, লন্ঠন , আসবাব, জানলা, দরজা ভাঙ্গার শব্দ । আমার আশঙ্কা হল নিশ্চয়ই লুটপাট হচ্ছে । আমার নিজস্ব অস্ত্র নিয়ে আক্রান্ত বাড়িটার পেছনের দরজা দিয়ে সাহস করে সেই বাড়িতে ঢুকে পড়লাম । গিয়ে দেখি আমাদের পাড়ারই কয়েকটি ছেলে রিভলবার নিয়ে বাড়ির মালিক মুসলমান ভদ্রলোককে ভয় দেখাচ্ছে । আমাকে দেখেই তারা ঘাবড়ে গেল । তাদের ধমক দিয়ে দিলাম । তারা পালিয়ে গেল । মুসলমান ভদ্রলোককে অভয় দিয়ে এলাম।
আবার রাত তিনটার সময় বিরাট হল্লা । বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম । শুনলাম কাছেই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড তালতলা লেনের বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে । দোতালায় আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। ভেতরে মহিলারা আটকে পড়েছেন । কান্না ও চিৎকার শোনা যাচ্ছে। অত রাত্রে বেরিয়ে পড়লাম একা । লাঠি হাতে। রাস্তায় দেখলাম হুগলি ব্যাঙ্কের ধীরেন মুখার্জি মহাশয় একটা মশারির ডান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন । উনি বললেন, যাবে ওখানে ? আমার সঙ্গে চললেন গন্ডগোল এলাকায় । গিয়ে দেখি ভীষণ অবস্থা । বাড়ির ওপরতলা থেকে মেয়েরা ছেলেরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে । নিচে দাঙ্গাবাজরা আগুন আরো ছড়িয়ে দিচ্ছে । সে এক বীভৎস দৃশ্য । অত লোকের মধ্যে আমরা মাত্র দুজন । ওই জনতার মধ্যে পৌঁছানো দায়। আমি এখন কৌশল করলাম । বিপ্লবী নেতা অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে খুব জোরে বাঘের ডাক দিতে শিখেছিলাম । প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে এই রকম বিরাট আওয়াজ দারুণ অস্ত্র। গোলমালের মধ্যে বাঘের ডাক দিলাম খুব জোরে । ঐ অদ্ভূত আওয়াজে উপস্থিত অনেকে হকচকিত হয়ে থমকে গেল । সেই ফাঁকে আমি নিমেষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । আমি বহু বছর এই অঞ্চলের কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলাম । আমাকে সামনাসামনি দেখে অনেকেই গুটিগুটি সরে পড়ল । ইতিমধ্যে ফায়ার ব্রিগেড এসে গেল । মুসলমানরা দমকলকে রোখার চেষ্টা করছিল । আমিও ধীরে এগিয়ে গেলাম। ওদের বুঝিয়েসুঝিয়ে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করা হলো।
আমাদের পাড়াতে কাবলিওয়ালা থাকতো । ১৮ই আগস্ট সকাল বেলায় তাদের সামনে রেখে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের মসজিদে ঢুকলাম । কেবল আমি একা । সেখানে হিন্দু-মুসলমানদের বিরাট আড্ডা ছিল । ওই মসজিদের মৌলবি সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল । দাঙ্গা ওই অঞ্চলে বন্ধ করা যায় কিনা এই চেষ্টা করার জন্য মৌলবি সাহেবের সামনে গিয়ে বললাম, মৌলবি সাহেব এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ করতে হবে। আমি তো একা এসেছি । আমাকে মারতে পারেন । কিন্তু আমাকে মারলে আপনারা কেউ বাঁচবেন না । আমার কর্মী পাড়ায় বস্তিগুলো পুড়িয়ে দেবে। আমি এসেছি শান্তির জন্য । এখান থেকে হিন্দু-মুসলমান একত্র হয়ে শান্তি মিছিল বার করতে চাই । ওরা রাজি হয়ে গেলেন । প্রচুর লোক জুটে গেল । শান্তি মিছিল বের হল । মিছিল রাস্তা দিয়ে চলছে । হঠাৎ পুলিশের ডেপুটি কমিশনার দোহা এসে হাজির। তিনি অত্যন্ত হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশের আই জি হন। আমি দেখলাম দোহা সাহেব আমাদের মিছিল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য গাড়ি থেকে হাঁক দিচ্ছেন । আমি তার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলাম এবং বললাম, শান্তি মিছিল বের করা হয়েছে । চলুন আমাদের সঙ্গে । তিনি আমাকে চিনতেন না । কেউ তাকে কখনো আমার পরিচয় দিয়েছে । আমি তখন এম এল সি ছিলাম । তিনি ও আমার সঙ্গে চললেন । সবাই মিলে দোকানপাট খোলাতে লাগলাম । মনে হোল শান্তি ফিরছে।
পরের দিন সকালে তালতলা বাজারে গোলাগুলি শুরু হলো । আমি ঘটনাস্থলে সোজা হাজির হলাম । দেখি রাস্তাজুড়ে লোকের ভিড় । একপাশে হিন্দু, অন্যদিকে মুসলমান । সব তৈরি । আমি এগোতে যেতেই সবাই সাবধান করে দিলো । আমি পরোয়া না করে একেবারে দুই দলের মাঝখানে চলে গেলাম । গন্ডগোল মেটালাম । সেদিন আমি সাহস করে না গেলে দাঙ্গা নিশ্চয়ই হত । গুলি চলত।কিছু লোক প্রাণ হারাত।
বিকেলে আমি খবর পেলাম ডক্টর লেনে গুলি চলছে। তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি অবস্থা থমথমে। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ (নেংটে বাবু ) বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন । বিপক্ষ দলের মুসলমান কাউন্সিলার। তার হাতেও বন্দুক । ইতিমধ্যে গুলি চলেছে বলে এ পক্ষের সবাই দারুন উত্তেজিত । আমি রবীনবাবুকে ঠান্ডা করলাম । কেননা গোলাগুলি চললে দাঙ্গা আরো বাড়বে। অন্যদিকে লোকদের নিরস্ত করতে সারং লেনের মসজিদের দিকে একাই এগিয়ে গেলাম । পাশের বাড়িতে বৃদ্ধ উকিল নিত্যগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে এলেন। কিন্তু আর কেউ সঙ্গে এলেন না । আমাদের দুজনকে দেখে মুসলমানদের একটু ভয় পেলে। আমরা সোজা ওদের সামনে গিয়ে সেই মুসলমান কাউন্সিলর আর মসজিদের মৌলবিকে বললাম, দেখুন আমরা এখানে মারামারি করতে আসিনি । আমারা শান্তি চাই । আপনারা গুলি ছোঁড়া বন্ধ করুন । ওদিকেও গুলি বন্ধ করানো হয়েছে । ওঁরা উত্তেজিত হয়ে দেখান তাঁদের দলের ৭/৮ জন আহত হয়েছে । চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই । আমরা ওই মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে আহতদের নিয়ে হিন্দু-মুসলমান দলবেঁধে তাড়াতাড়ি ডক্টর মহেন্দ্র সরকারের ডিস্পেন্সারিতে নিয়ে গিয়ে ওদের চিকিৎসা করালাম। এরপর ওই অঞ্চলে গোলমাল বন্ধ হয়ে শান্তি স্থাপিত হলো । এই ঘটনায় আমার অভিজ্ঞতা হল যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুভ উদ্দেশ্যে কোন কাজ এগিয়ে গেলে কখনো ক্ষতি হয় না।
এই সময়ে সুরাওয়ার্দী সাহেবের মন্ত্রিসভা । মুসলিম লীগ বেড়ে উঠেছে । মুসলমানরা চারিদিকে নিজেদের প্রভুত্ব দেখাচ্ছেন । এর থেকে বাঁচবার জন্য আমরা কয়েকজন বিশেষ করে আমি, বিপ্লবী দেবেন দে, কাউন্সিলর ইন্দুভূষণ বিদ একটি প্রতিরোধ বাহিনী “রেজিস্টেন্স গ্রুপ“ নামে গ্ৰুপ খুললাম । কলকাতা, হাওড়া ও হুগলি নিকটবর্তী স্থান থেকে অনেক উদ্যমী ও সাহসী ছেলেদের এই দলে নেওয়া হল। কুমার সিং হলে এঁদের কিভাবে কাজ করতে হবে তার শিক্ষা দেওয়া হতো। স্টেনগান আদি কিছু অস্রশস্ত্র যোগাড় করে এঁদের হাতে দেওয়া হলো । এইসব ব্যবহার করে মুসলমান আক্রমনকে রুখতে হবে । এই সব ছেলেরা হিন্দু-মুসলমানদের বাঁচাতে এবং দাঙ্গা রুখতে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছিল।।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হলো। সকাল থেকে কি উৎসাহ। চারিদিকে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন আরম্ভ হল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গান গাইতে শোভাযাত্রা বের করল । আমিও অনেক ছোট-বড় সভায় বক্তূতা করেছিলাম । বিভিন্ন স্থানে বহু ফল মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল । কলকাতায় কেবল আনন্দ মুখর ছিল না । সমস্ত দেশ এক নতুন উদ্দীপনার মাধ্যমে উৎসব করলো। ভাবলাম যে আমরা আর পরাধীন নই। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক । শক্তিশালী এবং সুন্দর দেশ গড়ার দায়িত্ব’ সকলকে নিতে হবে । পরনির্ভরতা দূর করে ভারতবর্ষকে সকল বিষয় আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।
আমাদের দেহ দ্বিখন্ডিত হলো । ভারত পাকিস্তান । পাকিস্তানের আবার দুই ভাগ। পশ্চিমৱ ও পূর্ব । বাংলাকে ভাগ করে পশ্চিমবাংলা ও পূর্ব পাকিস্তান করা হল। মুর্শিদাবাদ জেলা পূর্ব পাকিস্তানে গেল এবং খুলনা জেলা পশ্চিমবঙ্গে এল। আমাদের দেশ মুর্শিদাবাদ । সেখানে আমার বড়দা কেশরী সিংহ নাহার সপরিবারে থাকতেন । সেদিন পাকিস্তানের পতাকায় ওই অঞ্চলে উঠেছিল । ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য সব ওপরওয়ালা পদে মুসলমানরা এলেন। খুলনায় সেরকম হিন্দুরা গেলেন। এই অবস্থায় তিন দিন ছিল । বাংলাকে ভাগ করার লাইন টানার জন্য র্যাডক্লিফ সাহেবের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়েছিল । নদীর সীমানা করে র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডে মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতে আসে এবং খুলনা জেলা পাকিস্থানে যায় ।
১৮ই আগস্ট মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ ভারতের জাতীয় পতাকা অনুষ্ঠানিক ভাবে আমার বড় বৌদি উত্তোলন করেন। এই তিনদিন মুর্শিদাবাদ ও খুলনার অধিবাসীদের মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল তা ধারণা করা শক্ত। এই স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন কংগ্রেসের ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু হঠাৎ পয়লা সেপ্টেম্বর কলকাতায় আবার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাঁধলো। এই দাঙ্গা থামাতে গিয়ে গান্ধীবাদী কংগ্রেস কর্মী শচীন মিত্র, স্মৃতিশ বন্দ্যোপাধ্যায় কলুটোলায় নিহত হলেন। তখন মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় বেলেঘাটায় ছিলেন। দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য উনি অনশন শুরু করলেন। তার একটাই শর্ত। কলকাতার মানুষ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই যেন নির্ভয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে।
মুসলিম লিগের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরাওয়ার্দী সাহেব তখনও পাকিস্তানে যাননি। বরঞ্চ প্রতিদিনই গান্ধিজির কাছে আসতেন। শহরের হালচাল ওঁর জানা ছিল। উনি গান্ধিজিকে জানালেন যে এই দাঙ্গা থামাবার দায়িত্ব যদি বিজয় সিংহ নাহার, দেবেন্দ্র চন্দ্র দে এবং ইন্দ্রভূষণ বিদ গ্রহণ করেন, তবেই গোলমাল থামবে। কেননা ওঁরা রেজিষ্টেনস্ গ্রুপের নেতা, এই সংস্থার কর্মীরা সারা কলকাতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁরা দায়িত্ব নিলে দাঙ্গা থামবে। গান্ধিজির সেক্রেটারি নির্মল বসু আমাকে ৩রা সেপ্টেম্বর সকালে টেলিফোনে জানালেন, গান্ধিজি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। দমদম জেলে একসঙ্গে অনেক দিন ছিলাম, তাই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার খুবই পরিচয় ছিল।
আমরা কয়েকজন মিলিত হলাম। গান্ধিজির কাছে যেতে কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। আমি তাঁদের বোঝালাম, আমরা গান্ধিজির কাছে যাব। তারপর কী করণীয় তা ঠিক করা যাবে। কিন্তু আমরা যদি না যাই তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে। আমার কথায় ওঁরা রাজি হলেন। আমি, দেবেন দে, ইন্দ্র বিদ এবং আরও কয়েকজন একসঙ্গে বেলেঘাটায় গান্ধিজির কাছে গেলাম। গান্ধিজি বিছানায় শুয়ে আছেন। আমরা সবাই ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সেখানে বসলাম। কদিন উপবাসের জন্য ওঁকে ভীষণ দুর্বল দেখাচ্ছিল। কিন্তু রুগ্ন তপস্বীর কী বিরাট ব্যক্তিত্ব। ওঁকে দেখে সবার মন শ্রদ্ধায় ভরে উঠল। উনি কোনো কথা বলছেন না। আমরাই বললাম, আপনি অনশন ভঙ্গ করুন। আমাদের আবেদন শুনে গান্ধিজি বললেন, কলকাতার রাস্তায় মানুষ নির্ভয় চলতে পারে, এই অবস্থা হলেই আমি উপবাস ভঙ্গ করব। আমাদের মধ্যে দাঙ্গা বন্ধ না করার ব্যাপারে অনেকে উগ্রপন্থী ছিলেন, কিন্তু তাঁরাই গান্ধিজির পায়ে হাত দিয়ে বললেন, আমরা কলকাতায় শান্তি ফিরিয়ে এনে, মানুষের মন থেকে ভয় দূর করব। আজ থেকে সকলে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে। এই কথা বলেই হাঙ্গামা বন্ধের প্রতীক হিসেবে একজন পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে ওঁর পায়ে সমর্পণ করলেন, নির্মলবাবু গান্ধিজির সঙ্গে আমাদের সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা বললাম, আজ থেকেই দাঙ্গা বন্ধ হবে। শহরের সর্বত্র মানুষ নির্ভয়ে চলতে পারবে। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি অনুগ্রহ করে অনশন ভঙ্গ করুন। গান্ধিজি রাজি হলেন।
খানিকটা বাদেই মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, সুরাওয়ার্দী এবং আরও অনেকে এলেন। গান্ধিজিকে লেবুর রস পান করিয়ে অনশন ভঙ্গ করানো হল। গান্ধিজি আমাদের আশীর্বাদ করলেন।
ওঁর আশীর্বাদ আমাদের মধ্যে ম্যাজিকের মতন কাজ করলো। আমরা সর্বত্র প্রচার করলাম, গান্ধিজির নির্দেশ অনুযায়ী মানুষের মন থেকে ভয় দূর করতে হবে। আমরা চারদিকে খবর দিলাম, কোথাও যেন আর গন্ডগোল না হয়। এই ব্যবস্থা করতেই হবে। এই কথা সারা কলকাতায় ছড়িয়ে গেল। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা সেই দিনই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
এই প্রসঙ্গে, এরই কয়েক মাস আগে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গা ঘটার পর সেখানে গান্ধিজির যাওয়ার কথা মনে পড়ছে। নোয়াখালি রওনার জন্য গান্ধিজি শিয়ালদহ স্টেশনে এসেছেন। আমরাও স্টেশনে গেছিলাম। ওঁর থার্ড ক্লাস টিকিট। সঙ্গে আরও কয়েকজন সহকর্মী যাচ্ছেন। রেল কর্তৃপক্ষ ওঁদের জন্য পুরো কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করে দিয়েছেন। গান্ধিজির কামরার জানালার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। প্লাটফর্মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কিছু লোক বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যাপারে ফরওয়ার্ড ব্লক লোকেরা গান্ধী বিরোধী। স্টেশন চত্বরে ওঁদের সমর্থকরা ঢিল, জুতো গান্ধিজির দিকে ছুঁড়ছেন। আমরা কংগ্রেস কর্মীরা গান্ধিজির কামরা ঘিরে রেখে ওঁদের কাছে আসতে দিইনি। সারা এলাকা জুড়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা, গন্ডগোল। গান্ধিজি কিন্তু নির্বিকার। ওঁর ধৈর্য দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। উনি করজোড়ে সবাইকে নমস্কার করছেন, মুখে স্মিত হাসি। সেই রাজনৈতিক দুর্যোগের প্রেক্ষিতে গান্ধিজি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি যেভাবে অহিংস এবং প্রেমের দ্বারা শান্তির পথে ফিরিয়ে আনলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা সত্যিই বিরল।
[যা দেখেছি যা করেছি—-বিজয় সিং নাহার, পৃষ্ঠা ৮১-৮৬]
কৃতজ্ঞতা ; ‘ দাঙ্গা থেকে দেশভাগ ; ‘হিন্দু‘ বাঙালির প্রতিক্রিয়া
সংকলক ; সৌম্য বসু (Soumya Basu)
খড়ি প্রকাশনী
প্রকাশকাল ; ২০২০
নিবেদনে – ঋতুপর্ণ বসু