ধ্রুপদী ভাষা ও ভাষার রাজনীতি

অগস্টের শুরুতেই মাননীয়া সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী একটি চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে। চিঠিতে উনি দাবী জানান বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, এবং নব শিক্ষা নীতিতে বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা রুপে গুরুত্ব প্রদানের করবার জন্য।

ধ্রুপদী ভাষা কী?
ইউরোপীয় ধ্রুপদী চর্চার প্রেক্ষিতে ধ্রুপদী ভাষা রুপে কেবলমাত্র গ্রীক ও ল্যাটিনকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা ভূমধ্যসাগর ও সন্নিহিত অঞ্চলের সাহিত্যের ভাষা ছিল। এডোয়ার্ড সাপির তাঁর ‘Language’ বইতে পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রাচীন চাইনিজ, সংস্কৃত ও আরবীকে ধ্রুপদী ভাষা রুপে স্বীকৃতি দেন।
“একজন শিক্ষিত জাপানী চীনের ভাষার সাহায্য ব্যতীত একটি বাক্যগঠন করতে পারবেন না, এমনকি বর্তমান সময়ের সিয়ামিজ, বর্মা বা কম্বোডিয়ার ভাষায় সংস্কৃত বা পালি, যা হিন্দু বা বৌদ্ধদের সাথে এসেছিল তার সুস্পষ্ট ছাপ বর্তমান। যখন আমরা গ্রীক বা ল্যাটিন নিয়ে আলোচনা করি, সেই আলোচনা রোম বা এথেন্সে ব্যবহৃত শব্দে পরিপূর্ণ থাকবে। এখান থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি, চীনের প্রাচীন ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও সংস্কৃত কীভাবে প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রভাব ফেলেছিল। সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে পাঁচটি ভাষা উল্লেখের দাবী রাখে। সেইগুলি হচ্ছে, প্রাচীন চীনের ভাষা, সংস্কৃত, আরবী, গ্রীক ও ল্যাটিন। এদের সাথে তুলনায় অপরিসীম সাংস্কৃতিক গুরুত্বের অধিকারী হিব্রু ও ফ্রেঞ্চ ভাষাও পেছনে রয়ে যায়।“

দীর্ঘ সময় ধরে সুবিস্তৃত প্রভাব এবং তা বর্তমানে কথ্য ভাষা নয়, এবং কোনো ভাষায় নতুন শব্দ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই ভাষাগুলির মৌলিক শব্দগুলির ব্যবহার করে তবে যে ভাষা থেকে মৌলিক শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে তাকে ধ্রুপদী ভাষা বলা যায়।
সাহিত্য আ্যকাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর ক্লাসিকাল তামিলের ভাইস চেয়ারম্যান ভি সি কুলন্দাইস্বামী ইউনেসকোকে চিঠি লিখেছিলেন কোনো ভাষা । কিন্তু United Nations Educational, Scientific and Cultural Organisation (UNESCO) কর্তাব্যক্তিরা জানান ধ্রুপদী ভাষা নির্ধারণের কোনো নির্দিষ্ট শর্তাবলী নেই। এমনকি কোনো প্রচলিত অভিধান বা বিশ্বকোষেও ধ্রুপদী ভাষার কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসবার পর তামিল ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা ঘোষণা করবার জন্য সাহিত্য আ্যকাডেমির সভাপতি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন, যা দোসরা সেপ্টেম্বর, ২০০৪ সালের একটি বৈঠকে জানায়, ‘ধ্রুপদী ভাষা নির্ধারণের জন্য কোনো শর্তাবলী কোথাও লিপিবদ্ধ নয়, তবুও যে ভাষাগুলি সর্বসম্মতভাবে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে বিবেচিত তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে ধ্রুপদী ভাষার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা যেতে পারে।‘ সাহিত্য আ্যকাডেমীর বিশেষজ্ঞ কমিটি চারটি প্রধান শর্তকে ধ্রুপদী ভাষার বৈশিষ্ট্য রুপে নির্ধারণ করেন,
১) ভাষাটির প্রাচীনত্ব। লিখিত ইতিহাস অনত্তঃ ১৫০০-২০০০ বছরের পুরনো।
২) প্রাচীন সাহিত্যকে মূল্যবান ঐতিহ্য রুপে মান্যতা।
৩) সাহিত্যের মৌলিক পরম্পরা।
৪) ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্য বর্তমান ভাষা ও সাহিত্যের থেকে সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন।

এই চারটি শর্তাবলীর প্রেক্ষিতে তামিল ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা রুপে ঘোষণা করা হয়, এবং ইউ পি এ ১ সরকারের জোটসঙ্গী তামিল ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা ঘোষণা করবার কৃতিত্ব নিজেরা দাবী করে। ২০০৫ সালে সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্রের তরফে ধ্রুপদী ভাষা রুপে ঘোষণা করা হয়। ২০০৮ সালে কন্নড় ও তেলেগু ভাষাকে কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মালয়ালম ও ওড়িয়া ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নির্দেশে ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ধ্রুপদী ভাষাগুলির জন্য,
কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপক পদের সৃষ্টি, ভাষা উৎকর্ষ কেন্দ্রের স্থাপনা এবং ভাষা বিশেষজ্ঞদের সম্মানার্থে দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়

এখন কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক:-
২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামেদের সম্মিলিত সাংসদ সংখ্যা ছিল ৩৫ টি, কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা ছিল ৬টি। বামেরা কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা রুপে ঘোষণা করবার জন্য কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি।
২০১১ সালে ১৮৪ টি বিধায়ক পদে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন, কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা ছিল ৪২ টি। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট ছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যখন একদা বামপন্থী, বর্তমানে তৃণমূল সমর্থক গর্গ চ্যাটার্জি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসকারী অন্য রাজ্যের অধিবাসীদের বিরুদ্ধেও যেভাবে হিংসা ছড়াচ্ছেন শাসকদলের পরোক্ষ মদতে, এবং রাজ্যে বসবাসকারী অবাঙালি মানুষদের বিরুদ্ধে হেনস্থা করছেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম সন্দেহের উদ্রেক করে। যখন ওনারা ক্ষমতায় ছিলেন তখন ওনারা কিছু করেন নি, এমনকি বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা ঘোষণা করবার জন্য যে গবেষণাপত্র তৈরী করবার প্রয়োজনীয়তা আছে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কমিটিও গঠন করতে পারেন নি।


সামনেই ২০২১ এ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন, দু্র্নীতি, স্বজনপোষণ ও বিশেষ সম্প্রদায়ের তোষণে যখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন তিতিবিরক্ত, মুক্ত চাইছে এই সরকারের হাত থেকে, ঠিক তখন বাঙালির ভাযা নিয়ে আবেগকে উসকে দিয়ে রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছেন বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলই। কোথাও যেন একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে শাসকদলের সঙ্গে কংগ্রেস ও বামদলগুলির। দীর্ঘ ৩৪ বছর কেন্দ্রের কংগ্রেসের পরোক্ষ সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালিয়ে এসেও বামদলগুলি আজ অপ্রাসঙ্গিক। নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক তোষণে কংগ্রেসের গড়গুলিতে কংগ্রেসের ভোটে থাবা বসিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এমনকি ২০১৯ সালে অধীর বাবুর জেতার মার্জিন ২০১৪ সালের ৩,৫৬,০০০ থেকে নেমে এসেছে মাত্র ৮০,০০০ ভোটে। তাও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধানসভা বহরমপুর ও কান্দী এই দুটি বিধানসভা এলাকার ভোটেই জিতেছেন অধীর বাবু। এমতাবস্থায় বাঙালি অবাঙালি বিভাজন কংগ্রেসের ও তৃণমূল কংগ্রেসের উভয়ের পক্ষেই লাভজনক হতে পারে, তাই বাংলা পক্ষ নামক হিংসাত্মক সংগঠনের পুষ্টি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে কিছু বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে। তাই দীর্ঘদিন রাজ্যে ও কেন্দ্রে সরকারে আসীন থাকা সত্ত্বেও যারা বাংলা ভাষার জন্য কিছুই করেনি তারাই এখন বাংলা ভাষার জন্য কুম্ভীরাশ্রু মোচন করছে। আর বামেরা তাকিয়ে আছে, যদি তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে দুই একটি আসন ২০২১ এ পাওয়া যায়, সেই আশায়। তবে সেগুড়ে বালি, বাঙালি আজ আর ইতিহাসবিমুখ নয়, বাঙালি জানে অবাঙালিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল কলকাতার ডিরেক্ট আ্যকশন ডে থেকে শুরু করে দেশভাগের সময়ে। একসাথে লড়েছিল রক্তলোলুপ হায়নাদের বিরুদ্ধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.