দ্বিতীয় পর্ব
মনে পড়ে সেই আষাঢ়ে
ছেলেবেলা,
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা।
বৃষ্টি পড়ে দিবস-রাতি,
ছিল না কেউ খেলার সাথি,
একলা বসে পেতেছিলেম
সাধের খেলা।
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা।
আজ থেকে কয়েক কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে রচিত বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে নানা প্রকার খেলার উল্লেখ করা হয়েছে। সেসকল খেলা শিশু ,কিশোর ও যুব সকলেই খেলতেন। যুব বয়সে সে সব খেলা একে অপরের আকর্ষণের জন্য খেলা হতো।
কচি কচি কুমড়োর ঝোল
ওরে খুকু গা তোল।।
জ্যোৎস্নাতে ফটিক ফোটে, কদম তলায় কে রে।
আমি তো বটে নন্দ ঘোষ, মাথায় কাপড় দে রে।।
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
মামার নামে টগর ফুল॥
বা
আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই।
মাছের কাঁটা পায়ে ফুটল দোলায় চেপে যাই।
দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি, গুনতে গুনতে যাই॥
এ নদীর জলটুকু টল্মল্ করে।
এ নদীর ধারে রে ভাই বালি ঝুর্ঝুর্ করে।
চাঁদ মুখেতে রোদ লেগেছে, রক্ত ফুটে পড়ে॥ ( এই ছড়ার একটি বাঁকুড়া লোকরূপও আছে। যেদিন কেবল ছড়া নিয়ে লিখব , সেদিন বিশদে আলোচনা করব।)
এখন তো কেউ পুতুলের বিয়ে দেয় না , হুলো আর মেনিরও বিয়ের হয় না । তাই পুঁটুরানীর পালকি বহুতল শহরের মধ্যে হারিয়ে যায়। কেউ এখন ছপন কড়ি গুনতে গুনতে মাছ ধরতে যায় না বা মাছধরা মাছধরা খেলা খেলে না। ২০০ রকমের প্রাচীন খেলা আজ হারিয়ে গেছে বা লুপ্তপ্রায়।
বাৎস্যায়নের রচনায় উপদেশ আছে “আকর্ষ ক্রীড়া, পট্টিকা ক্রীড়া, মুষ্টিদ্যূত, ক্ষুল্লকাদিদ্যূতানি, মধ্যমাঙ্গুলি গ্রহণং ষট্ পাষাণকাদীনি ” খেলা করার।
#আকর্ষ–ক্রীড়া , অর্থাৎ পাশা , দশ পঁচিশ আদি। #পট্টিকা – একজনের চোখ বেঁধে তার মাথায় বা কপালে এক একজন আঙ্গুলের টোকা মারবে , যার চোখ বাঁধা আছে, সে টোকা মারা সঙ্গীদের নাম বলবে। না বলতে পারলে সে হেরে যাবে । বলতে পারলে যার নাম বলবে তার চোখ বেঁধে পূর্ববৎ খেলা চলবে ।
#মুষ্টিদ্যূত – হাতের মুঠোর মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা । যে বলতে পারবে সে ওই মুষ্টি বদ্ধ লুক্কায়িত জিনিস পাবে। না বলতে পারলে তাকে সেই পরিমিত জিনিস দিতে হবে।
#ক্ষুল্লদ্যূত- কড়িখেলা। একটি গর্তে বা একটি নির্দিষ্ট স্থানে কতগুলি কড়ি রেখে এক একজনে নির্দিষ্ট ব্যবধান হতে নিজের কড়ি ওই কড়িগুলির উপর ছুঁড়ে মারবে। নিজের কড়ি যদি চিৎ হয়ে পড়ে তবে যতগুলো কড়ি চিৎ হয়েছে সবগুলোই সে পাবে । এই রূপ নিজের কড়ি উপুড় হয়ে পড়লে উপুড় হয়ে পড়া কড়ি গুলো তার হবে । কিন্তু যদি নিজের কড়ি চিৎ হয় এবং অন্য কড়ি উপুড় হয় বা নিজের কড়ি উপুড় ও অন্য কড়ি চিৎ হয় তবে যত কড়ি উপুড় বা চিৎ হয়েছে ততো কড়ি তাকে দিতে হবে।
#মধ্যমাঙ্গুলি_গ্রহণ- অঙ্গুলী দোলাতে দোলাতে অনামিকা বা তর্জনী বা কনিষ্ঠা ধরিয়ে দেওয়া।
#ষট্_পাষাণ – ছয়টি গুটি নিয়ে খেলা। প্রথমে একটি গুটি তুলে উপরে ছুঁড়ে দিয়ে নীচের আরেকটি গুটি তুলে সঙ্গে সঙ্গে উপরের গুটিকে হাতের পীঠে ধরে আবার একটি একটি করে মাটিতে নামিয়ে রাখতে হয়।
উক্ত সকল খেলাই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নানা স্থানে এই সেদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
যে সমস্ত খেলা অঙ্গের ব্যায়াম হয়, সেই সমস্ত খেলার উল্লেখ প্রাচীনগ্রন্থ গুলিতে বারবার করা হয়েছে । তাদের হয়ত একেকটি গ্রন্থে বা স্থান ,কাল , পাত্রভেদে এক এক রকম নাম ছিল। কিন্তু ধরন ছিল এক। যেমন – #সুনিমীলিতকা ― চোর চোর বা কানামাছি খেলা। শ্রীমদ্ভগবদতে এই খেলাই অস্পৃশ্য এবং অন্ধকরূপ ধারণ এই দুই পদ্ধতির উল্লেখ করা হয়েছে। আমি তা পূর্ব পর্বেই উল্লেখ করেছি।
এমন একটি খেলার উল্লেখ আছে, তার নাম #আরব্ধিকা -কিৎ কিৎ বা হা ডুডু খেলা। কোনো একটি শব্দ করে খেলা আরম্ভ করতে হয় তাই এর নাম আরব্ধিকা। টীকাকার বলেন , #কৃষ্ণফল_ক্রীড়া। যদিও পরিবর্তনের হাওয়ায় এসব নাম এখন অপ্রচলিত ।
#লবণ_বীথিকা – টীকাকার একে #লবণ_হট্ বলে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে , পাড়ায় পাড়ায় একে #নুনপালা খেলা বলা হয়। যদিও বর্তমানে মানে নিকট অতীতেই এই খেলা বালক বালিকারা আর খেলে না। খেলাটা ঠিক কেমন ভুলে গেছে।
#অনিল_তাড়িতকা – পক্ষীর ন্যায় বাহুদ্বয়ে প্রসারিত করে চক্রের ন্যায় ভ্রমণ। পশ্চিমবঙ্গে এই খেলাটির নাম #আনি_মানি খেলা। সেই ছোট বেলায় দুটি হাত সমানভাবে দুই দিকে সোজা করে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ছড়া কাটতাম –
আনি মানি জানি না ,পরের ছেলে মানি না….
#গোধূম_পঞ্জিকা – ধান , কলাই বা গমের মধ্যে পয়সা লুকিয়ে রেখে সমান ভাবে ভাগ করে দেয়। এবার যার যা খুশি ভাগ নিজের জন্য ডেকে বা নিয়ে নেবে। যার ভাগে পয়সা থাকবে না সে সেই অংশ পরিমান অর্থ বা পয়সা মূল ব্যক্তিকে দেবে। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে এমন ধরনের খেলা হয় না এখন।
#অঙ্গুলি_তাড়িতকা – টীকাকার বলেছেন – একজনের চোখ ঢেকে তার কপালে বা মস্তকে টোকা মারা এবং কে মেরেছে নাম ধরে জিজ্ঞাসা করা। অনুমান, পূর্বের পর্বে যে আঙ্গুল মটকে বুড়ি ,হাড়ি , অস্পৃশ্য খেলার কথা বলেছি এটা অনেকটা সেই রূপ খেলা। শ্রীমদ্ভাভাগবতের অস্পৃশ্য হয়ে অন্যকে ধরার জন্য দৌড়ে বেড়ানোর খেলাই পরবর্তী কালে নানা গ্রন্থে অঙ্গুলি তাড়িতকা বলে পরিচিত হয়েছে।
স্থান, কাল, পাত্র ভেদে খেলার আকার প্রকারে হয়ত সূক্ষ্ম বা মোটা পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু খেলাগুলি রূপান্তর ভেদে সকল স্থানে , সকল কালে ও সকল পাত্রের মধ্যে প্রচলিত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। একটা সময় অবধি হা ডু ডু বা কিৎ কিৎ সহ সকল খেলা বালক বালিকাগণ একত্রেই খেলত।
যে খেলা গুলি অদ্যাপি হাজার হাজার বৎসর ধরে জীবিত আছে কোনো প্রকারে , সেগুলিকে তাড়িয়ে দেবার জন্য সমাজের কিছু মানুষ কেন যে এত উতলা থাকে কে জানে ?
পল্লীগ্রামগুলিতে অনুসন্ধান করলে আরো বহু খেলার সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে বেছে নিয়ে আবশ্যক মতো কালোপযোগী খেলাগুলিকে পরিবর্তন , পরিবর্ধন বা কিছু অংশ পরিবর্জন করে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা , বঙ্গের পল্লীতে পল্লীতে , শহরে শহরে চালানো যায় কি না এবিষয়ে চিন্তা করা উচিৎ বলে মনে করি। সকল দেশের ,সকল জাতির নিজস্বতা আছে, কেবল আমরা কেন বিজাতীয় খেলা নিয়ে মেতে থাকব ?
শ্রীমদ্ভগবদতে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় প্রলম্বাসুরবধ প্রসঙ্গে একটি খেলার উল্লেখ আছে – একদিন বলরাম এবং কৃষ্ণ বৃন্দাবন মধ্যে গোপগণের সঙ্গে গোচারণ করছিলেন। এমন সময় প্রলম্ব নামে এক অসুর গোপরূপ ধারণ করে গোপালদের বধের নিমিত্ত আগমন করল। কৃষ্ণ সেই সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। কিন্তু , শাখার ন্যায় তার সঙ্গে ক্রীড়া করতে লাগলেন। বিহারবিৎ কৃষ্ণ সেই স্থানে গোপালদের আহ্বান করে বললেন , ” এস আমরা বয়স এবং বলবীর্য অনুসারে আমরা দুই দল হয়ে বিহার করি।”
গোপগণ এই ক্রীড়ায় বলরাম ও কৃষ্ণকে দলপতি নির্বাচন করলেন। কয়েকজন বলরাম এবং কয়েকজন শ্রীকৃষ্ণের দলভুক্ত হয়ে ক্রীড়া করতে লাগলেন। সকলের এই নিয়ম হল যে , যাঁরা জয়লাভ করবেন তাঁরা পরাজিতের পৃষ্ঠে আরোহণ করবেন এবং বিজিতরা জয়ীদের পৃষ্ঠে বহন করবেন।
শ্রীমদ্ভগবদতে নিয়মাবলী সহ এই খেলার উল্লেখ থাকলেও এই খেলার যে কি নাম ছিল তার কোনো উল্লেখ নেই। প্রসঙ্গত , পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের বহুস্থানে রাখাল বালকগণ এমন খেলা খেলত। এখন এসব ভুলে গেছে। খেলাটা এরূপ ছিল – প্রতিযোগী দুজনের দুই দল গঠিত হতো। দুজন একসঙ্গে দৌড়তে আরম্ভ করত। কোন একটি বৃক্ষ , পুকুরের পাড় বা একটা উঁচু ঢিপি লক্ষ্যরূপে নির্দিষ্ট হতো। যে অগ্রে গিয়ে লক্ষ্য স্থানে পৌঁছতে পারত , সেই কাঁধে চড়বার সৌভাগ্য লাভ করত। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি শব্দ করতে করতে দম ধরে দৌড়ে যাওয়ার রীতি ছিল।
এই খেলায় একটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভগবদতেও তার উল্লেখ রয়েছে। গোপালগণ কয়েকজন বলরাম এবং কয়েকজন শ্রীকৃষ্ণের দলের হয়ে খেলতে লাগলেন। এই নায়ক বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি ভারতবর্ষে বহুদিন হতে প্রচলিত ছিল। প্রজা কতৃর্ক রাজা নির্বাচনের কথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে সত্য এবং প্রসিদ্ধ। বঙ্গের প্রজাগণ শক্তিমান ছিলেন যে, তাঁরা গোপাল দেবকে সিংহাসন দান করে মাৎস্যন্যায় ও বঙ্গের অচলায়তনকে প্রতিরোধ করেছিলেন।
বঙ্গ তথা ভারতের বহুস্থানে গ্রাম্য শাসন পদ্ধতি আবহমানকাল হতে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে আসছে। যুগ যুগান্ত ধরে গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলিত ছিল । পঞ্চগ্রামী , নবগ্রামী , বাইশগ্রামী ইত্যাদি সভায় বহু বিরোধের মীমাংসা হতো। এই সকল রীতিতে জন্মগত বিশেষ রূপে পরিচিত না হলে , বালক বালিকাদের ভিতর গ্রামের খেলাতেও স্থান পেত না।
চাক্ককা লোতা ;
বাঁশের পাতা,
চাক্কা দুই,
তুল্যা থুই
চাক্কা তিন্ঘোঁরার ডিম্,
চাক্কা চার;
ব্যান্দ্যা মার্;
চাক্কা পনচো টিয়া।
চাক্কা লোতা খেলা, উক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের খেলার সঙ্গে একটি কিছু মিল ছিল। মূল মিল হল , খেলায় দুইটি দল হয় এবং প্রতি দলে একজন করে মোড়ল বা নেতা বা নায়ক / নায়িকা থাকত। এবার দুই প্রতিপক্ষের একজন করে ( প্রথমে দলের মোড়ল আসত) বালক বা বালিকা পাঁচটি কতে ইঁট বা পাথরের টুকরো নিয়ে খেলা শুরু করতো। প্রথমে একজন পাঁচটি টুকরো ইঁট বা পাথর নিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে , হাতের নানা ভঙ্গি ও কায়দায় পাথর বা ইঁট কুড়োতে কুড়োতে উক্ত ছড়া বলতে হতো। একজনের ছড়া কেটে পাথর সংগ্রহ হয়ে গেলে , দ্বিতীয় জন ও ছড়া কাটতে কাটতে নানা ভঙ্গিতে পাথর কুড়াতো। এভাবে খেলা দুই দলের মধ্যে চলতে থাকত। পাথর কুড়ানোর ধরন বা ভঙ্গি এবং ছড়া কাটার ভঙ্গির উপর জয়পরাজয় নির্নয় হতো। জয়ী ব্যক্তি পরাজিত ব্যক্তিকে দিয়ে পছন্দ মতো ফল পাড়ানো বা কাজ করাতে পারত। এই খেলার আরেকটি নাম ছিল #আকশো_মুনি বা #গরজো_মুনি। খেলার ধরন একই ছিল কেবলমাত্র ছড়া টা ছিল অন্য –
আকশো মুনি
আকশো মুনি
আকশো মুনিটি।
গরজো মুনি
গরজো মুনি
গরজো মুনিটি।
তেলতা হানি,
পতেকে জানি,
চারমা টেকার আকটা।
কোলাবোতি একানা,
কোলাবোতি দুয়ানা,
কোলাবোতি তিন্যানা,
পাঁচ পাটটি চর্যানাতুল্ শাপটি ।
এরকম আরো একটি খেলা আছে। তা নিয়ে এবং আরো কিছু খেলা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস
২) গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি