মানুষ তার অস্তিত্বের শুরু থেকেই প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার কারণ ও বিভিন্নতার মধ্যে একটি যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করে চলেছে। প্রকৃতির এই নিয়ম কে সে যত বুঝতে পেরেছে সে ততই তা নিজের অনুকূলে , নিজের বিকাশের কাজে লাগিয়েছে।সেই বিকাশ কখনো বহির্জাগতিক আবার কখনো অন্তর্জগতের । মানুষ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সমাজ , জাতি ও দেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতি ও রাষ্ট্রের গঠন একই নিয়মে হয় নি।
ইউরোপীয় দার্শনিকগণ জাতি গঠনের মূল হিসেবে কখনো ভাষাগত ঐক্যের কথা বলেছেন ,কখনো রাজতন্ত্র কে ‘জাতি’ গঠনের আধার বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
ভারতবর্ষের ভাষাগত বিভিন্নতা , আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিভিন্নতা বরাবরই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু তারা ইউরোপীয় ‘জাতি’ গঠনের তত্ত্ব দিয়ে ভারতবর্ষ কে ব্যাখ্যা করেছেন।তারা ইউরোপীয় ‘রিলিজিয়ন’ এর চশমা দিয়ে ভারতবর্ষ কে দেখতে গিয়ে ভারতবর্ষের ভাষা-পোশাক-আচার এর বিভিন্নতার মধ্যে থাকা ঐক্যসূত্র কে চিনতে পারেন নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ'(আত্মশক্তি) প্রবন্ধে এই ব্যর্থতার কথা বলেছেন এইভাবে….
“এই লোকচিত্তের একতা সব দেশে এক ভাবে সাধিত হয় না। এইজন্য য়ুরোপীয়ের ঐক্য ও হিন্দুর ঐক্য একপ্রকারের নহে, কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দুর মধ্যে যে একটা ঐক্য নাই, সে কথা বলা যায় না। সে-ঐক্যকে ন্যাশনাল ঐক্য না বলিতে পার– কারণ নেশন ও ন্যাশনাল কথাটা আমাদের নহে, য়ুরোপীয় ভাবের দ্বারা তাহার অর্থ সীমাবদ্ধ হইয়াছে।”
ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের অবধারণা(Concept) মূলত রাজনৈতিক ও সার্বভৌম ক্ষমতা ভিত্তিক। ভারতবর্ষের ‘জাতীয়তাবাদ’ এর ভিত্তি সংস্কৃতি যা তার ভাষা-মত-পরিধান এর বিভিন্নতাকে ছাপিয়ে গেছে এবং এই সংস্কৃতির মূল নিঃসন্দেহে তার ‘ধর্ম’ , ‘হিন্দুত্ব’ এর মধ্যে প্রোথিত।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে এই ধারণাটিকেই সুসংবদ্ধ করেছেন…
“হিন্দুধর্ম সমাজের প্রত্যেককে পঞ্চ যজ্ঞের দ্বারা ঋষি,পিতৃপুরুষ ,সমস্ত মনুষ্য ও পশুপক্ষীর সহিত আপনার মঙ্গলসম্বন্ধ স্মরণ করিতে প্রবৃত্ত করিয়াছে। ইহা যথার্থরূপে পালিত হইলে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের পক্ষে , সাধারণভাবে বিশ্বের পক্ষে মঙ্গলকর হইয়া উঠে।
……..ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বাঁধিয়া তুলিবার ধর্ম চিরদিন বিরাজ করিতেছে। নানা প্রতিকূল ব্যাপারের মধ্যে পড়িয়াও ভারতবর্ষ একটা ব্যবস্থা করিয়া তুলিয়াছে ,তাই আজও রক্ষা পাইয়াছে।এই ভারতবর্ষের উপর আমি বিশ্বাস স্থাপন করি।
আমরা প্রত্যেকে যেন সজ্ঞানভাবে উহাতে যোগ দিতে পারি—জড়ত্বের বশে বা বিদ্রোহের তাড়ণায় , প্রতিক্ষণে ইহার প্রতিকূলতা না করি।
ভারতবর্ষ রাজ্য লইয়া মারামারি, বাণিজ্য লইয়া কাড়াকাড়ি করে নাই।
…….সৈন্য এবং পণ্য লইয়া সমস্ত পৃথিবী কে অস্থিমজ্জায় উদ্বোজিত করিয়া ফিরে নাই।সর্বত্র শান্তি , সান্ত্বনা ও ধর্ম ব্যবস্থা স্থাপন করিয়া মানবের ভক্তি আদায় করিয়াছে। এইরূপে যে গৌরব সে লাভ করিয়াছে , তাহা তপস্যার দ্বারা হইয়াছে এবং সে গৌরব রাজচক্রবর্তীত্বের চেয়ে বড়”।
ভারতীয় চিন্তায় ‘রাষ্ট্র’
আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন ।এই বৈশিষ্ট্যের কথা চিন্তা না করলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এর অভাবে স্বাধীনতা কখনো সমৃদ্ধি বা সুখের আস্বাদ দিতে পারেনা। যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত না হবো ততদিন আমরা আমাদের উন্নতি সাধন করতে পারবো না।
ঋষি অরবিন্দ বলেছিলেন “অন্যলোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ–কতকগুলো মাঠ,ক্ষেত্র,বন,পর্বত ,নদী বলিয়া জানে।আমি স্বদেশকে ‘মা’ বলিয়া জানি–ভক্তি করি ,পূজা করি।”ভগিনী নিবেদিতাও ভারতবর্ষ কে এক জীবন্ত মাতৃরূপ হিসেবে দেখেছেন–“হিমালয় হতে কন্যাকুমারী এক স্পন্দিত, জীবন্ত,অখন্ড অস্তিত্ব।এই মাতৃভূমি ভারতবর্ষ নিজ জন্মদাত্রীর মত।শ্রদ্ধা কর,সেবা কর, ভালোবাসো,আগলে রাখ।”
বহুযুগ পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষরা গেয়ে গেছেন :
“উত্তরং যৎসমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষাং তদ্ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ।”
(সমুদ্রের উত্তর দিকে এবং হিমালয়ের দক্ষিণ দিক ব্যাপী যে ভূমি ,তারই নাম ভারতবর্ষ এবং তার সন্ততি হল ভারতী)
আজও দৈনন্দিন স্নান-পর্ব সম্পন্ন করার সময়ে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, স্বরস্বতী,নর্মদা ও সিন্ধু থেকে কাবেরী পর্যন্ত সারা দেশের পবিত্র নদীগুলির নাম জপ করে সাধারণ মানুষ…
“গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।”
এই ভূমিকেই ঋষি কবি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর অমর সঙ্গীত ‘বন্দেমাতরম্’-এ মাতৃভক্তিতে প্রণাম জানিয়েছেন , যে গান কত সহস্র দেশপ্রেমিক যুবকদের হৃদয়কে আবেগে আপ্লুত করেছে ,যার ফলে তারা হাসতে হাসতে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে উঠেছে। কবি গেয়েছেন–
“ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণীম্।”
–এই ভূমিকেই আমাদের সকল দ্রষ্টা ,ঋষি মুনিগণ ‘মাতৃভূমি’ ,’ধর্মভূমি’ ,’কর্মভূমি’ ও ‘পূণ্যভূমি’ , এবং বাস্তবিক ‘দেবভূমি’ ও ‘মোক্ষভূমি’ বলে অভিহিত করেছেন।
লঙ্কা বিজয়ের পর লক্ষ্মণ, রামচন্দ্র কে ‘সোনার লঙ্কা’য় রাজত্ব করার পরামর্শ দিলে , শ্রী রামচন্দ্র ‘মাতৃভূমি’তে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন
“জননী জন্মভূমিশ্চ সর্গাদপী গরিয়সী” ।
ভারতীয় সংস্কৃতি , দেশ কে ‘মাতা’ রূপে পূজার কথা বলে,স্বদেশ-রক্ষার কথা বলে যা এদেশের সন্তানদের রাষ্ট্রধর্ম, যা এদেশের জাতীয়তাবাদ এর উৎস।
ভারতবর্ষের ইতিহাস কমপক্ষে ৫০০০ বছরের পুরনো। ভারতবর্ষ একসময় আধ্যাত্ম , বাণিজ্য , সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় উৎকর্ষতা অর্জন করেছিলো।প্লাস্টিক সার্জারি,শূন্যের আবিষ্কার,যোগ ও আয়ুর্বেদ চর্চা,শিখ , বৌদ্ধ ,জৈন ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে এখানে। এই মহান দেশের সাংস্কৃতিক বিস্তৃতি পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান পর্যন্ত ছিল।ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতার প্রতি সন্দিহানদের এ প্রশ্ন কি মনে জাগে না যে , কোনো এক ঐক্যসূত্র ছাড়া ভারতবর্ষ কিভাবে একসময় ‘বিশ্বগুরু’র মর্যাদা পেয়েছিল? তারা নিশ্চয়ই জানেন বলেই ভারতবর্ষের সেই সনাতন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কে অস্বীকার করে দেশ কে বিপথে চালিত করতে চান শুধুমাত্র নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।
ভারতবর্ষের ‘জাতীয়তাবাদ’ ইংরেজদের সৃষ্ট নয়
বৈদেশিক শাসনে শাসনাধীন একটি জাতির স্বকীয় সত্তা কে দাবিয়ে রাখা হবে তা বলাই বাহুল্য। ইংরেজরা এই কাজ টি সুচতুরভাবে করেছিলো।তারা ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদ ও অখন্ডতার মূল ভিত্তি ‘ধর্ম’ এর অপব্যাখ্যা ভারতীয় মননে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করলো ম্যাক্স মূলার এর মতো বেতনভোগী ইতিহাস-ধর্ম বিকৃতকারী কে নিয়োগ করে। একদিকে ম্যাক্স মূলার বেদ-উপনিষদ এর ভূল ব্যাখ্যা করলেন আর অন্যদিকে আর্য-অনার্য তত্ত্ব ,বেদে বর্ণীত স্বরস্বতী নদীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে ভারতবর্ষের ঐক্যের ভিত্তি দুর্বল করার চেষ্টা করলেন।দুঃখের বিষয় , স্বাধীনতার পর খন্ডিত ভারতবর্ষের ক্ষমতা যাদের হাতে ন্যস্ত হলো , ‘মেকলীয়’ শিক্ষায় শিক্ষিত ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা ইংরেজদের পরিবেশিত বিকৃত তথ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে , সমাজে, রাজনীতি তে প্রচারিত করলেন।
‘গীতা’র ধর্ম , ‘শিবাজী’ র মতো দেশনায়ক দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘ভারত মাতা’ কে শৃঙ্খলামুক্ত করতে আত্মবলিদানে প্রস্তুত যুবসম্প্রদায়ের ঐক্য কখনোই ইংরেজ জাতির প্রতি দ্বেষ-ঘৃণা থেকে সৃষ্টি হয় নি। ভারতবর্ষের ‘জাতীয়তাবাদ’ এর ধারণা ছিল সুপ্রাচীন অখন্ড ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।লোকমান্য তিলক তাঁর ‘গীতারহস্য’ পুস্তকে ভারতের পুনরুত্থানের দার্শনিক পটভূমিকা আলোচনা করেন। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র , ঋষি অরবিন্দ,বীর সাভারকার তাদের লেখনীর মাধ্যমে ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘রাষ্ট্রবাদ’ এর যোগসূত্র দেশবাসীকে বোঝাতে সমর্থ হন।
কিন্তু স্বাধীনতার পর সংবিধানের ১ নং আর্টিকেল ‘India that is Bharat’ দিয়ে শুরু হলেও ক্ষমতাসীন দল ভুলে গিয়েছিল যে ভারতবর্ষের ইতিহাস ১৯৪৭ থেকে শুরু হয় নি। রাজনৈতিক ভাবে ভারত খন্ডিত হয়েছিল কিন্তু ইউরোপীয় দৃষ্টি তে দেখতে গিয়ে তারা ভারতবর্ষকে সাংস্কৃতিক ভাঙ্গনের পথে এগিয়ে দিলেন।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটি উপাসনা-পদ্ধতির লক্ষ্যপূরণ এর জন্যে শুরু হওয়া ‘খিলাফত আন্দোলন’ এর সঙ্গে যুক্ত করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় সংস্কৃতির পথ থেকে বিচ্যুতির যে ধারা শুরু করেছিলো তা ক্রমশঃ ‘বন্দেমাতরম্’ এর প্রসঙ্গে মুসলিম নেতাদের বিরোধিতা কে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে ‘জরুরী অবস্থা’র সময় অসাংবিধানিকভাবে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেক্যুলার’ শব্দ যুক্ত করে তা অব্যাহত রাখা হয়।
এই বিপথগামিতাকেই ভারতবর্ষের অবনমনের জন্য দায়ী করা যায়।ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন কি শুধুই দেশকে ইংরেজ-শাসন মুক্ত করার জন্যই ছিল ,না দেশের মননে , আচরণে ভারতীয়ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছিল?
‘অখন্ড ভারত’- এর ঐতিহাসিকতা সুপ্রতিষ্ঠিত
স্বাধীনতার পর আমরা দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্য খন্ডিত ভারতবর্ষ পেলাম এবং যারা দ্বিজাতি তত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো ,যারা ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের যোগস্থাপনে লজ্জাবোধ করতেন তারাই এদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন। ফলস্বরূপ তারা স্বাধীনতা-আন্দোলনের সময়ে করা একই ভুল যা দ্বিজাতি তত্ত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো তার পুনরাবৃত্তি করে, ভারতবর্ষের স্বকীয় সত্তা কে অগ্ৰাহ্য করলেন এবং এক মিশ্র , জোড়াতালি দেওয়া সংস্কৃতির দিকে দেশ কে নিয়ে গেলেন।যেন পাকিস্তানের মতোই ভারতবর্ষ ১৯৪৭ এ তৈরি হওয়া এক নতুন দেশ।যেন ভারতবর্ষের নিজস্ব সুপ্রাচীন গৌরবময় কোনো ইতিহাস নেই। কিন্তু ইতিহাস যে অন্য কথা বলে। দীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর বৈদেশিক শাসনের আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের এক গৌরবময় ইতিহাস আছে ।
খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্ৰিক ঐতিহাসিক হোরোডেটাস তার বই ‘The Histories’ এ India ও Indian কথাটি ব্যবহার করেন।
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মেগাস্থিনিস ‘ইন্ডিকা’ গ্ৰন্থে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা দেন।
খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতবর্ষকে সিন্ধু(হিন্দু) বলে উল্লেখ করেন যা থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনি এক অখন্ড সভ্যতা হিসেবে দেখিয়েছেন।
খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক জুয়াং জাং(Xuan Zang) এই দেশকে ‘সিন্তু’ হিসেবে উল্লেখ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ ও প্রকৃতির বিবরণ দেন যা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে একটিমাত্র অখন্ড সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে আরবীয় আক্রমণকারীরা সপ্তম শতাব্দীতে ‘সিন্ধ’ প্রদেশ দখলের পর এদেশের গণিত ও বিজ্ঞান এর বিভিন্ন গ্ৰন্থের যে অনুবাদ করেছিলেন (যেমন ভারতীয় সংখ্যা কে আরবীয়রা ‘আল-হিন্দসা’ বলতো) তা সহজেই ‘হিন্দ’ এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুণী ‘তারিখ-আল-হিন্দ’ এ বর্তমান পাকিস্তান কে ‘হিন্দ’ বলে উল্লেখ করেন।
মহাভারতের নবম অধ্যায় ‘ভীষ্ম পর্ব’ তে ভারতীয় উপমহাদেশের বিশদ বিবরণ দিয়ে তাকে ‘ভারত’ নামে উল্লেখ করা হয়।
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে।
খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারত মুনি রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্নতাসহ একে একটিমাত্র সাংস্কৃতিক সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করে।এই গ্ৰন্থের ১৭তম অধ্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশ কে ‘ভারতবর্ষ’ নামে অভিহিত করা হয়।
কলহন্ তার ‘রাজতরঙ্গিনী’ তে মহাভারতের যুদ্ধে কাশ্মীরের রাজার অপ্রাপ্তবয়স্কতা কে সারা ভারতবর্ষে ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠার এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
শিখদের পবিত্র গ্ৰন্থ ‘গুরু গ্ৰন্থ সাহিব’ মোট চারবার ভারতীয় উপমহাদেশ কে ‘হিন্দুস্তান’ বলে উল্লেখ করে।লক্ষণীয় এই পবিত্র গ্ৰন্থের কোথাও ‘পাঞ্জাব’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না।
অষ্টম শতাব্দীতে কেরালার সন্যাসী আদি শঙ্করাচার্য্য ‘ব্রক্ষ্ম সত্যম ,জগত মিথ্যা’ মন্ত্র নিয়ে সারা ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে জগন্নাথপুরী ,দ্বারিকা,বদ্রীনাথ ও শৃঙ্গেরী তে যে চারটি মঠ নির্মাণ করেছিলেন তা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।শিবময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের ১২ টি জ্যোতির্লিঙ্গ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষদের একসূত্রে বেঁধেছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী কমিউনিস্টদের রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি ভারতীয়-সংস্কৃতি বিরোধী
মার্ক্সবাদীরা রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে পুরোপুরি বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে যেখানে মানুষের আবেগ কিংবা অনুভূতির কোন স্থান নেই। মার্ক্সবাদ শুধুমাত্র অর্থনীতি , উৎপাদন ও মালিকানার ভিত্তিতে সমাজকে দেখেছে এবং সমাজ কেবল পরস্পরের অর্থনৈতিক স্বার্থবিরোধী , সর্বদা সংগ্ৰামরত কতকগুলি শ্রেণীর সমষ্টি।মার্ক্সবাদ অনুযায়ী শ্রেণি বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকরা মনে করতেন যে তাদের মালিকানা থাকবে না অতএব কোন এক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই ব্যক্তিগত মালিকানাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শ্রেণি না থাকলে রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন নেই। মার্কসবাদের আদর্শকে রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রয়োগ করতে গিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবাধীন পূর্ব জার্মানি অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়ায় সাম্যবাদের নামে স্বেচ্ছাচারী সেনানায়ক বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে।বর্তমান চীন সাম্যবাদের নামে নিজের দেশের মানুষের মানবাধিকার,স্বাধীন ধর্মচর্চা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে এক রাষ্ট্রীয় কারাগারে পরিণত হয়েছে। হংকং ,তিব্বত চীনা-আগ্ৰাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রানপণ চেষ্টা করছে। শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব দিয়ে গড়া সমাজ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে আত্মঘাতী হয়েছে।এ সব উদাহরণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে কমিউনিজম এর রাষ্ট্র সম্পর্কিত ব্যাখা ভুল প্রমাণিত হয়।
অন্যদিকে ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতি মুহাম্মদ বিন কাশিম , মুহাম্মদ ঘোরি থেকে শুরু করে মোঘল শাসনে ঔরঙ্গজেব,টিপু সুলতান তার পরে ইংরেজদের আঘাত সত্ত্বেও নিজের সনাতন সংস্কৃতি সমাজে জিইয়ে রাখতে পেরেছে।এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘ভারত-কলঙ্ক’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ উল্লেখযোগ্য…. “ভারতভূমি সর্ব্বররত্নপ্রসবিনী, পররাজগণের নিতান্ত লোভের পাত্রী। এই জন্য সর্ব্বকালে নানা জাতি আসিয়া উত্তর পশ্চিমে পার্ব্বত্যদ্বারে প্রবেশলাভ পূর্ব্বক ভারতাধিকারের চেষ্টা পাইয়াছে। পারসীক, যোন, বাহ্ণিক শক, হুন, আরব্য, তুরকী সকলেই আসিয়াছে, এবং সিন্ধুপারে বা তদুভয় তীরে স্বল্প প্রদেশ কিছু দিনের জন্য অধিকৃত করিয়া, পরে বহিষ্কৃত হইয়াছে। পঞ্চদশ শতাব্দী কাল পর্য্যন্ত প্রবল জাতি মাত্রেরই আক্রমণ-স্থলীভূত হইয়া এতকাল যে স্বতন্ত্রতা রক্ষা করিয়াছে, এরূপ অন্য কোন জাতি পৃথিবীতে নাই, এবং কখন ছিল কি না সন্দেহ।”
পৃথিবীতে যেমন সংঘাত ও প্রতিযোগিতা আছে তেমন সহযোগিতাও আছে। ভারতীয় সংস্কৃতি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোনো সংঘাতের কথা বলে নি।সমাজ কতকগুলি ব্যক্তির সমষ্টি হলেও সমাজ ‘স্বয়ংভূ’।সমাজ কোনো থিসিস , এ্যান্টি থিসিস সিন্থেসিস এর ফল নয়।
ভারতীয় সমাজ অর্থের ভিত্তিতে সমাজকে ভাগ করে বিদ্রোহের কথা বলেনি।সমাজ কে দায়িত্ব অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছিল , যেখানে শুধুমাত্র নিজের অংশ বুঝে নেওয়ার লড়াই ছিল না , ছিল আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমাজের ঐক্য সুদৃঢ় করার আহ্বান।এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বদেশী সমাজ'(আত্মশক্তি) প্রবন্ধের অংশবিশেষ প্রণিধানযোগ্য…..
“……এ কথা আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, আমাদের দেশে সমাজ সকলের বড়ো। অন্য দেশে নেশন নানা বিপ্লবের মধ্যে আত্মরক্ষা করিয়া জয়ী হইয়াছে– আমাদের দেশে তদপেক্ষা দীর্ঘকাল সমাজ নিজেকে সকলপ্রকার সংকটের মধ্যে রক্ষা করিয়াছে। আমরা যে হাজার বৎসরের বিপ্লবে, উৎপীড়নে, পরাধীনতায়, অধঃপতনের শেষ সীমায় তলাইয়া যাই নাই, এখনো যে আমাদের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে সাধুতা ও ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে মনুষ্যত্বের উপকরণ রহিয়াছে, আমাদের আহারে সংযম এবং ব্যবহারে শীলতা প্রকাশ পাইতেছে, এখনো যে আমরা পদে পদে ত্যাগ স্বীকার করিতেছি, বহুদুঃখের ধনকে সকলের সঙ্গে ভাগ করিয়া ভোগ করাই শ্রেয় বলিয়া জানিতেছি,……….সে কেবল আমাদের প্রাচীন সমাজের জোরে। এ সমাজ আমাদিগকে সুখকে বড়ো করিয়া জানায় নাই– সকল কথাতেই, সকল কাজেই, সকল সম্পর্কেই, কেবল কল্যাণ, কেবল পুণ্য এবং ধর্মের মন্ত্র কানে দিয়াছে। সেই সমাজকেই আমাদের সর্বোচ্চ আশ্রয় বলিয়া তাহার প্রতিই আমাদের বিশেষ করিয়া দৃষ্টিক্ষেপ করা আবশ্যক।”
ভারতীয় ‘ধর্মাশ্রিত’ সনাতন সমাজ সর্বদাই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অগ্ৰসর হয়েছে এবং সেই পথই যে আমাদের সমাজ-গঠনের পন্থা হওয়া উচিত তা কবিগুরু ঐ একই প্রবন্ধে বলেছেন এইভাবে….
“আমরা আমাদের অতিদূরসম্পর্কীয় নিঃস্ব আত্মীয়দিগকেও পরের ভিক্ষার প্রত্যাশী করিয়া দূরে রাখি নাই– তাহাদিগকেও নিজের সন্তানদের সহিত সমান স্থান দিয়াছি; আমাদের বহুকষ্ট-অর্জিত অন্নও বহুদূর-কুটুম্বদের সহিত ভাগ করিয়া খাওয়াকে আমরা একদিনের জন্যও অসামান্য ব্যাপার বলিয়া কল্পনা করি নাই– আর আমরা বলিব, আমাদের জননী জন্মভূমির ভার আমরা বহন করিতে পারিব না?……….স্বদেশের ভার আমরা প্রত্যেকেই এবং প্রতিদিনই গ্রহণ করিব– তাহাতে আমাদের গৌরব, আমাদের ধর্ম। এইবার সময় আসিয়াছে যখন আমাদের সমাজ একটি সুবৃহৎ স্বদেশী সমাজ হইয়া উঠিবে।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির কথা স্মরণ করিয়ে সমাজ কে ,স্বদেশ কে ‘মাতা’ রূপে সেবা করার আহ্বান জানিয়েছেন……
“আমাদের দেশ তো একদিন ধনকে তুচ্ছ করিতে জানিত, একদিন দারিদ্র্যকেও শোভন ও মহিমান্বিত করিতে শিখিয়াছিল– আজ আমরা কি টাকার কাছে সাষ্টাঙ্গে ধূল্যবলুণ্ঠিত হইয়া আমাদের সনাতন স্বধর্মকে অপমানিত করিব? আজ আবার আমরা সেই শুচিশুদ্ধ, সেই মিতসংযত, সেই স্বল্পোপকরণ জীবনযাত্রা গ্রহণ করিয়া আমাদের তপস্বিনী জননীর সেবায় নিযুক্ত হইতে পারিব না?…….
………..আমি নিশ্চয় জানি, ভারতবর্ষের সুগম্ভীর আহ্বান প্রতি মুহূর্তে আমাদের বক্ষঃকুহরে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে; এবং আমরা নিজের অলক্ষ্যে শনৈঃশনৈ সেই ভারতবর্ষের দিকেই চলিয়াছি। আজ যেখানে পথটি আমাদের মঙ্গলদীপোজ্জ্বল গৃহের দিকে চলিয়া গেছে, সেইখানে, আমাদের গৃহযাত্রারম্ভের অভিমুখে দাঁড়াইয়া “একবার তোরা মা বলিয়া ডাক্’! একবার স্বীকার করো, মাতার সেবা স্বহস্তে করিবার জন্য অদ্য আমরা প্রস্তুত হইলাম; একবার স্বীকার করো যে, দেশের উদ্দেশে প্রত্যহ আমরা পূজার নৈবেদ্য উৎসর্গ করিব; একবার প্রতিজ্ঞা করো, জন্মভূমির সমস্ত মঙ্গল আমরা পরের কাছে নিঃশেষে বিকাইয়া দিয়া নিজেরা অত্যন্ত নিশ্চিন্তচিত্তে পদাহত অকালকুষ্মাণ্ডের ন্যায় অধঃপাতের সোপান হইতে সোপানান্তরে গড়াইতে গড়াইতে চরম লাঞ্ছনার তলদেশে আসিয়া উত্তীর্ণ হইব না।”
‘অখন্ড ভারত’ এক নিশ্চিত লক্ষ্য
দীর্ঘদিন বৈদেশিক শত্রুর শাসনাধীন থাকলেও ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতা হারিয়ে যায় নি।
অখন্ড ভারতবর্ষের ভিত্তি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বোঝাতে পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় ‘একাত্ম মানবদর্শন’ পুস্তকে এইভাবে বুঝিয়েছেন—-
“একদিন এক খরিদ্দারের দাড়ি কামাইবার সময় এক নাপিত গর্ব করিয়া বলিতেছিল যে তাহার খুরটির বয়স ষাট বৎসর।খরিদ্দার বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল “খুরটির হাতলটি তো খুব চকচকে। তুমি ষাট বৎসর কেমন করে এমন চকচকে করে রাখলে?” নাপিত কৌতুকবোধ করিয়া বলিল তাও কি সম্ভব ? হাতলটা ছয় মাস পূর্বে বদল করা হয়েছে।”
খরিদ্দার তখন কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছে। সে প্রশ্ন করিল ,”ইস্পাত টি কতদিনের?”উত্তর হইল ,”তিন বৎসর পূর্বের”। অর্থাৎ হাতল বদলাইয়াছে , ইস্পাত বদলাইয়াছে কিন্তু ক্ষুরের পরিচয় বদলায় নাই। ঠিক সেইরকম প্রত্যেক জাতির একটি আত্মা আছে ইহার একটি বিশিষ্ট নাম আছে।”
পন্ডিত দীনদয়াল এই বৈশিষ্ট্য কে জাতির ‘চিতি’ অর্থাৎ চৈতন্য রূপে অভিহিত করেছেন যা তার নিজস্ব প্রকৃতি এবং কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার পরিণতি নয়। স্বাধীনতার সময় দেশভাগ হলেও সনাতন অখন্ড ভারতবর্ষের সেই ‘চিতি’ আজো অক্ষুন্ন। শুধু আমাদের মনের মধ্যে সেই চেতনা কে পালন করা প্রয়োজন।দেশবাসীর মনে অখন্ড ভারতের চেতনা কে জাগ্ৰত করতেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিবছর ১৫ ই অগাষ্ট ‘অখন্ড ভারত দিবস’ রূপে পালন করে।”
জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বেদনা ইহুদীরা কখনো ভুলে যায়নি। তাদের এই ব্যথা কে তারা এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল। এজন্য তারা একটি সুন্দর পন্থা অবলম্বন করেছিল। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কে নববর্ষের শুভেচ্ছা পত্র ইহুদীরা লিখতো ‘আগামী বছর জেরুজালেমে দেখা হবে’।আজ থেকে ৫০০ বছর আগে যখন তারা লিখতেন আগামী বছর জেরুজালেমে দেখা হবে তখন কি জানতেন না যে আগামী বছর কেন তার জীবদ্দশাতেই পরের বছর জেরুজালেমে তাদের দেখা হবে না? তারা তা ভালোভাবেই জানতেন এবং তবুও মনের মণিকোঠায় তুষের আগুনের মতো স্বদেশ-স্পৃহা জ্বালিয়ে রাখতে লিখতেন।আরব দেশগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল ইহুদীদের একটি স্বাধীন দেশ বলে ঘোষিত হয়েছে।
ভারতবাসীর মনেও যে ভারত মাতার ছবি আছে তা একদিন অখন্ড ভারত কে রাজনৈতিক রূপদান অবশ্যই করবে।
‘অখন্ড ভারত’ এর পথে পদক্ষেপ
যে কমিউনিস্টরা ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ কে অস্বীকার করেন , তারা গণতন্ত্রীয় কাঠামো কে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে চান কিন্তু সেই গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ সংসদে হামলাকারী আফজাল গুরুর ফাঁসির বিরোধিতা করেন। কাশ্মীরের জিহাদীদের বিরুদ্ধে তারা একটিও বাক্যব্যয় করেন না। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ শ্লোগান তুলে ছাত্রসমাজ কে বিচ্ছিন্নতাবাদ এর পথে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতবর্ষের একতা ও অখন্ডতার পক্ষে বিপজ্জনক এইরকম কাজ দেশবিরোধী। ভারতবর্ষ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে অখন্ড ভারতের সংস্কৃতির ধ্বজাধারীদের প্রতি আমাদের কর্তব্য পালিত হচ্ছে , দীর্ঘ ৭৩ বছরের প্রতীক্ষার পর।’নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ এর বিরোধিতার সুযোগে উত্তর-পূর্ব ভারতকে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করার কথা বলে শারজীল ইমাম আজ আইনের ঘেরাটোপে।
শুধু তাই নয় , আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দিয়ে কাশ্মীরে হিন্দুদের প্রতি দীর্ঘদিনের দ্বিচারিতা, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রের অখন্ডতাকে বলশালী করা হলো । কাশ্মীরের ঐতিহ্যকে কয়েক শতক ধরে সযত্নে লালন পালন করা বিতাড়িত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘরে ফেরার পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে।
একসময় মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের যে ভ্রাতৃত্ববোধ ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ পূর্ব এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিকে এক সূত্রে গেঁথে ছিল, ভারতীয় সংস্কৃতির সেই প্রাণ পুরুষের জন্মভূমি অযোধ্যা তে ‘রাম মন্দির’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভূমি-পূজন অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে অখন্ড ভারতের সেইরূপ ফিরে পাওয়ার দিকে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
তথ্যসূত্র—-১)’চিন্তাচয়ন‘-শ্রী গুরু জী
২)’একাত্ম মানবদর্শন‘—পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়
৩) রবীন্দ্র রচনাবলী
……’ভারত মাতা’র চরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে
পিন্টু সান্যাল
সহকারী শিক্ষক (পদার্থবিদ্যা)