ভগবান বৃন্দাবনবিহারী লাল শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত বল্লভাচার্য। আকুল হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ডাকেন। দেখা দাও প্রভু, দেখা দাও। ভক্তের কাতর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন দিলেন বল্লভাচার্যের সামনে। তাঁর দর্শনে অভিভূত বল্লভাচার্যের মুখ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এল এক স্তুতিগান। ভগবানের কোন বর্ণনা হয় না। তাঁর সবই মধুর। মধুরাষ্টক নামে পরিচিত সেই স্তোত্রটি সাড়ে পাঁচশ বছর পরেও চিরনতুন। তার আবেদন কখনও মলিন হয়নি।
বলা হয়, ঋষিরা যা দর্শন করেন সেগুলিই মন্ত্র। সত্যদর্শনের মুহূর্তে বল্লভাচার্যের মুখ থেকে শ্রীভগবানের যে বর্ণনা অনায়াস উদ্গীত হল, সেটিও মন্ত্রোপম। বড় সরল সেই স্তুতি। তাতে শব্দের আড়ম্বর নেই, রূপের চাকচিক্য নেই, অলঙ্কারের ঘনঘটা নেই– আছে কেবল সত্যের সহজ, সরল অভিব্যক্তি। সেজন্যই যুগের পর যুগ ভক্তদের কণ্ঠে কণ্ঠে ঘোরে সেই স্তুতি। এর শব্দ সংযোজনা অত্যন্ত সহজ।
অধরং মধুরং বদনং মধুরং নয়নং মধুরং হসিতং মধুরম্। হৃদয়ং মধুরং গমনং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥১॥ | অধর মধুর তাঁর বদন মধুর নয়ন মধুর তাঁর হাসিটি মধুর। হৃদয় মধুর তাঁর গমনও মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
বচনং মধুরং চরিতং মধুরং বসনং মধুরং বলিতং মধুরম্। চলিতং মধুরং ভ্রমিতং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥২॥ | বচন মধুর তাঁর চরিত মধুর বসন মধুর সঞ্চারও মধুর। চলন মধুর তাঁর ভ্রমণ মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। (বলিতম্ শব্দের অর্থ সঞ্চরণ বা সঞ্চার) |
বেণুর্মধুরো রেণুর্মধুরঃ পাণির্মধুরঃ পাদৌ মধুরৌ। নৃত্যং মধুরং সখ্যং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৩॥ | বেণুও মধুর তার, রেণুও মধুর হাতও মধুর তার, চরণও মধুর। নৃত্য মধুর তার, সখ্য মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
গীতং মধুরং পীতং মধুরং ভুক্তং মধুরং সুপ্তং মধুরম্। রূপং মধুরং তিলকং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৪॥ | গানও মধুর তার পানও মধুর, ভোজনও মধুর তার, নিদ্রা মধুর। রূপ মধুর তার তিলক মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
করণং মধুরং তরণং মধুরং হরণং মধুরং রমণং মধুরম্। বমিতং মধুরং শমিতং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৫॥ | করণ মধুর তার, তরণ মধুর চুরিও মধুর তার, খেলাও মধুর। বমন মধুর তার, শান্তি মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
গুঞ্জা মধুরা মালা মধুরা যমুনা মধুরা বীচী মধুরা। সলিলং মধুরং কমলং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৬॥ | গুঞ্জা মধুর তার মালাটি মধুর যমুনা মধুর, তার ঢেউও মধুর। সলিল মধুর, তাতে কমলও মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
গোপী মধুরা লীলা মধুরা যুক্তং মধুরং মুক্তং মধুরম্। দৃষ্টং মধুরং শিষ্টং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৭॥ | গোপীও মধুর আর লীলাটি মধুর মিলন মধুর, বিরহও যে মধুর। দৃষ্টি মধুর, ব্যবহারও মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
গোপা মধুরা গাবো মধুরা যষ্টির্মধুরা সৃষ্টির্মধুরা। দলিতং মধুরং ফলিতং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥৮॥ | রাখাল মধুর, গরুগুলিও মধুর লাঠিটি মধুর তাঁর, সৃষ্টি মধুর। ধ্বংস মধুর, সফলতাও মধুর মধুরাধিপতির সে যে সকলই মধুর। |
স্তোত্রটির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে প্রথমে বলা হয়েছিল যে, এটি সত্য-উপলব্ধি জাত একটি স্বচ্ছন্দ প্রকাশিত স্তোত্র। মহাপ্রভু শ্রীবল্লভাচার্য যখন প্রথম তাঁর দর্শন পাচ্ছেন তখন সর্বপ্রথম তাঁর নজর গেল প্রভু শ্রীকৃষ্ণের নয়নাভিরাম মুখমণ্ডলটির দিকে। তার পরে কৌস্তুভ-শ্রীবৎসলাঞ্ছিত বক্ষঃস্থলে, তার পরে তার মৃদুমন্দ চালে এগিয়ে আসাকে লক্ষ্য করলেন ভক্ত। (প্রথম শ্লোক) এর পরে তাঁর নজর গেল প্রভুর মধুর কথা বলা, চলন, বলন, বসনের দিকে। (দ্বিতীয় শ্লোক) এবার প্রভুর হাতের বাঁশীটির দিকে নজর গেল, তার পরে প্রভুর চরণের দিকে নজর দিয়ে প্রভুর পদরজঃ দেখলেন। দেখলেন, কেমন ভক্তের সামনে এসে প্রাণপ্রিয় সখার ছোট ছোট পায়ে নৃত্য করছেন প্রভু। (তৃতীয় শ্লোক) এগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক অপ্রযত্নসাধ্য ক্রিয়া– বিশেষ প্রয়াস ব্যতীতই এই সমস্ত ক্রিয়া এবং গুণের দিকে দৃষ্টি যায়। এর পরে ভক্ত দেখছেন প্রভুর ভোজন, পান, গানের দিকে। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। তাঁর মধুর রূপটিকে খুঁটিয়ে দেখছেন। তাঁর তিলকের দিকে নজর যাচ্ছে। তাঁর খুঁটিনাটির দিকে নজর যাচ্ছে। (চতুর্থ শ্লোক) আবার ভক্ত বিহ্বল চিত্তে দেখছেন প্রভুকে। প্রভুর সমস্ত কাজ মধুর। তাঁর সাঁতার কাটা, তাঁর ননী-মাখন চুরি, তাঁর খেলা এমনকি তাঁর বমন পর্যন্ত মধুর। এবং এই নিত্য চঞ্চল ছোট্ট বালকটি যখন শান্ত– নিদ্রায় বা সমাধিতে– তখন সেই রূপটিও অতীব মধুর। (পঞ্চম শ্লোক) বিহ্বলচিত্ত ভক্ত এবার ভগবানের পারিপার্শ্বিককে দেখছেন। বৃন্দাবনের কৃষ্ণসলিলা যমুনা ও তার ঢেউ। যমুনার পবিত্র জল এবং পদ্ম। তার মধ্যেই কুঁচফলের মালা পরে বসে আছেন ব্রজবিহারী। (ষষ্ঠ শ্লোক) তাঁকে ঘিরে রয়েছেন গোপীরা, গোপীদের সঙ্গে লীলারত শ্রীকৃষ্ণ– তাঁর মিলন ও বিরহ দুই-ই মধুর। তাঁর চঞ্চল অথচ শান্ত সমাহিত দৃষ্টি, তাঁর অনুশাসনবদ্ধ মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার সমস্তই মধুর। (সপ্তম শ্লোক) আবার ব্রজের রাখাল বালক এবং গরুগুলিও তাঁকে ঘিরে বিরাজমান। তাঁর হাতের লাঠিটিও মধুর।
তিনিই এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির রচয়িতা, তিনিই সৃষ্টিকে সংহার করেন। এই সত্য দর্শনেই জীবনের সফলতা। সেই সৃষ্টি, সংহার এবং তাঁকে দর্শনে জীবনের যে সার্থকতা সমস্তটাই মধুর।
এই স্তোত্রে ভক্তের সামনে প্রভুর নিত্য বৃন্দাবন বিরাজিত রূপটি প্রকট। প্রভু নিত্যই বৃন্দাবনে বিরাজিত। তাঁর ভক্তরা সেই নিত্য বৃন্দাবনের মধুরিমা আস্বাদন করতে পারেন। মহাপ্রভু বল্লভাচার্যের সামনে ভগবান সেই নিত্য বৃন্দাবন সহ আবির্ভূত হয়েছেন। প্রথম দর্শনের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে বল্লভাচার্য সেই লীলাময় আনন্দঘন বৃন্দাবন ধাম দর্শন করছেন। এবং তিনি অনুভব করছেন *শিষ্টং মধুরম্*, প্রভু এই নিত্য লীলাতে উপস্থিত থেকেও কতটা পবিত্র এবং মর্যাদিত। এই পবিত্রতা এবং মর্যাদাই তাঁর মাধুর্যের মূল। ভগবদ্দর্শনে কৃতার্থ ভক্ত অনুভব করছেন *সৃষ্টির্মধুরা দলিতং মধুরম্* এই সমস্ত সৃষ্টিতে তিনি বিরাজিত। এই সমস্ত সৃষ্টি তাঁতেই লয়প্রাপ্ত হয়। সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে একাত্মতার ভাবটি জেগে উঠছে ভক্তের হৃদয়ে। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করলে বোঝা যায় যে, ভক্ত ব্যক্তি কৃষ্ণের মধুরিমাকে উপলব্ধি করার পরে সমষ্টির মাধুর্য উপলব্ধি করেছেন। কেবল কৃষ্ণ নয়, তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ– গোপ, গোপী, গরু, নদী, জল, ঢেউ, ফুল– সমস্ত কিছুর মধ্যেই প্রভুর মধুরিমার বিস্তার। ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে চেতনার সঞ্চার– সেই এক থেকেই বহু হওয়া। এবং তার পরে সমগ্র সৃষ্টিতে সেই মধুরিমার অনুভব। সৃষ্টি থেকে পরমেষ্ঠিতে যাত্রা– সমগ্র সৃষ্টিই প্রভুর মধুরিমায় মধুময়। স্তোত্রটি অদ্ভুত মাধুর্যের সঙ্গে সমগ্র সৃষ্টির একাত্মতা এবং আনন্দময়তাকে পরিস্ফুট করে। ভারতবর্ষের চির প্রবহমান আদর্শের ধারাটিকে এই আটটি সহজ, সরল, সুন্দর শ্লোকে বেঁধে ফেলেছেন মহাপ্রভু বল্লভাচার্য। মধুরাধিপতি ভগবান ও তাঁর এই অদ্ভুত ভক্ত– দুজনকেই প্রণাম।
রাকেশ দাশ (RakeshDas)