ভারতের নিজস্ব গুগুল, ফেসবুক সম্ভাবনা নাকি মরীচিকা

আমাদের অনেকের মনে হতে পারে ভারতের নিজস্ব গুগুল, ফেসবুকের প্রয়ােজন কেন? আমরা তাে এগুলাে বিনামূল্যে ব্যবহার করি। এখন নতুন করে অর্থ ব্যয় করার কী দরকার। উত্তরের জন্য কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়ােজন।

একবিংশ শতাব্দী হলাে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শতাব্দী। যেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে তারাই হবে আগামী। বিশ্বের পরাশক্তি। অধুনা বিজ্ঞানীরা বলেন ‘Data is the new Oil। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ হলাে ভারত কীভাবে নতুন তেলকে ব্যবহার করবে সেটার উপর নির্ভর করবে বিশ্ব-রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান কোথায় থাকবে। ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলাে যেভাবে প্রথম সারিতে চলে এসেছে নীচের তথ্য থেকে স্পষ্ট।

২০০৬ (শীর্ষ কোম্পানি) ২০১৬ (শীর্ষ কোম্পানি)

এস ও মােবাইল (প্রযুক্তি) অ্যাপেন (প্রযুক্তি)

জেনারেল ইলেকট্রিক (বিদ্যুৎ)। অ্যালফাবেট (প্রযুক্তি)

গ্যাস প্রন (গ্যাস) মাইক্রোসফট (প্রযুক্তি)

মাইক্রোসফট (প্রযুক্তি) বক্সসার

সিটি ব্যাঙ্ক (ব্যাঙ্ক) আমাজন (প্রযুক্তি)

ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (তেল ও গ্যাস) ফেসবুক (প্রযুক্তি)

পেট্রো চায়না (তেল ও গ্যাস) চায়না মােবাইল (প্রযুক্তি)

এইচ এম বি সি (ব্যাঙ্ক)।

আগামী বিশ্বে তথ্য ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

এবার আসল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। আমাদের কারগিল যুদ্ধের কথা মনে আছে। মনে হতে পারে তথ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে কারগিল যুদ্ধের কী সম্পর্ক। হ্যা ঠিকই শুনছেন, ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত যখন পাকিস্তানের জঙ্গি ও সেনাবাহিনীর উপযুক্ত অবস্থান জানার জন্য আমেরিকার কাছে জিপিএস স্যাটেলাইট-এর তথ্য চেয়েছিল তখন আমেরিকা ভারতকে তথ্য দিতে অস্বীকার করে। যার ফলস্বরূপ ভারত নিজস্ব ও স্বতন্ত্রভাবে ৭টি স্যাটেলাইট যুক্তIRNSS তৈরি করে। যার ফলে গােটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া। ভারতের নজরে চলে আসে। ব্রহ্মস মিসাইল ৩০০ কিলােগ্রাম বােমা বহনে সক্ষম। এটা স্পষ্ট যে ভারতীয়দের মেধা কোনাে অংশে কম নয়, প্রয়ােজন শুধু মানসিকতা। যেসব কারণে তথ্যপ্রযুক্তিতে ভারতকে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ার প্রয়ােজন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলাে—

(ক) গুগুল, ফেসবুক-সহ অন্যান্য বিদেশি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলি ভারত থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মােটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে। যেহেতু তাদের কাছে ভারতের বাজার হচ্ছে ১৪০ কোটি মানুষের বাজার, সেজন্য সবার লক্ষ্য থাকে ভারতের এই বাজারকে কবজা করা।

(খ) এই কোম্পানিগুলি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক কোম্পানি। যেহেতু তথ্য( Data) এই সমস্ত বিদেশি কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেইজন্য তারা জনমতামতের উপর প্রভাব তৈরি করতে পারে যেটা ভারতের সার্বমৈত্বের অত্যন্ত ক্ষতিকর।

(গ) তারা জাতীয় বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেসবুককে ব্যবহার করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামে কোম্পানির ২০১৬ সালের আমেরিকার নির্বাচনে তথ্যের অপব্যবহার করা।

(ঘ) ভারতে গুগুল-সহ অন্যান্য বিদেশি কোম্পানিগুলির ব্যবসা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় কোম্পানিগুলির বাজার মূলধন কমতে শুরু করেছে।

অবাক হতে হয়, বিশ্বের প্রথম তিনটি কোম্পানি। মাইক্রোসফট, আমাজন, আপেল-এর মােট বাজার মূলধন ভারতের মােট জিডিপি-র থেকে বেশি। এই কোম্পানিগুলির বাজার মূলধনে বড়াে অংশ ভারত থেকে আসে। এরা চীন থেকে সুবিধা করতে না পেরে ভারতকে তাদের ব্যবসায়িক এলাকায় পরিণত করতে শুরু করে। চীন সেন্সরের অজুহাত দেখিয়ে গুগুলকে বের কবে দেয়, জায়গা করে নেয় চীনা কোম্পানি। বাইডু। চীনা কোম্পানি আলিবাবার কাছে আমাজোনের মতাে কোম্পানিকে ধরাশায়ী হতে হয়। উবের চীনা কোম্পানি দিদি। চুজিংয়ের কাছে প্রতিযােগিতায় টিকে থাকতে না পেরে ভারতে ঘাঁটি তৈরি করে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলাে চীনা কোম্পানি আলিবাবা, টেনসেন্ট-এর মতাে কোম্পানি বিশ্বের প্রথম দশটি কোম্পানির মধ্য উঠে আসা। আলিবাবা, টেনসেন্টও ভারতের বাজারকে দখল করতে মরিয়া। চীনের মতাে সর্বগ্রাসী দেশের কাছে আমাদের দেশের জনগণের তথ্য চলে যাওয়া কতটা বিপজ্জনক সেটা পরিষ্কার। চীন Artificial intelligence (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ডিপ লার্নিং, মেশিন লার্নিং-এর মতাে নতুন প্রযুক্তিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়ােগ শুরু করেছে বিগত কয়েক বছরে। এই সমস্ত প্রযুক্তির মূল আধার। হচ্ছে তথ্য বা Data। চীনের কাছে এই তথ্য চলে যাওয়ার অর্থ হলাে ওরা এইসমস্ত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভারতের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এগিয়ে আসবে ভারতের নিজস্ব গুগুল, ফেসবুক তৈরি করতে ,ভারতীয় কোম্পানি না ভারত সরকার ? ভারতের তিনটি প্রধান কোম্পানি টিসিএস, উপপ্রাে এবং ইনফোসিসের বাজার মূলধন মাইক্রোসফটের বাজার মূলধনের থেকে কম। এর কারণ হলাে ভারতের কোম্পানিগুলি ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয়। তারা নতুন প্রযুক্তিতে অর্থ বিনিয়ােগ করতে চায় না। এ রকম চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের কোম্পানিগুলির বাজার মূলধন তলানিতে গিয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং এই কাজের জন্য ভারত সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। যে

কাজে মােদী সরকার অনেকাংশেই সফল। মূলত পাঁচটি বাজারকে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত যে বাজারগুলি দখল করতে পারলে আগামী দশবছরের মধ্য ভারত বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হওয়ার দিকে অনেকখানি এগিয়ে যাবে সেগুলাে হলাে—

(ক) সামাজিক নেটওয়ার্কিং যেমন- ফেসবুকের মতাে ভারতীয় নিজস্ব সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট তৈরি করা।

(খ) বৈশ্বিক নাগাল পেতে গুগুলের মতাে ভারতীয় সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করা।

(গ) অনলাইন ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য আমাজন, আলিবাবার মতােই কোম্পানি তৈরি করা।

(ঘ) মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার-এর মতাে ভারতীয় মাইক্রোব্লগিং সাইট তৈরি করা।

উপরের বাজারগুলিকে লক্ষ্য করে যদি কাজ করা যায় তাহলে চাকরি সৃষ্টি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তির দিকে ভারতকে। নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, ভারত ক্রেতাভিত্তিক বাজার থেকে মালিকানা-কেন্দ্রিক বাজারে পরিণত হবে।

এই সমস্ত পদক্ষেপগুলি নরেন্দ্র মােদীর মতাে একজন শক্তিশালী ও দেশপ্রেমী নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব যিনি ভারতকে বিশ্বগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। এস্তোনিয়ার মতাে ছােটো দেশ যদি সাইবার নিরাপত্তায় বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হতে পারে তাহলে মেধাসমৃদ্ধ ভারত তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব-শক্তি হতে পারবে না কেন?

জ্যোতিপ্রকাশ চ্যাটার্জি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.