একটা সময় ছিল যখন সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করতেন জাতির পরিচয় নিয়ে আলোচনা একটি প্রাগৈতিহাসক বিষয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই ধারণায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। বহু সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করতে থাকেন মানুষের কর্মধারা পরিচালনার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব পরিচয় তাকে অনুপ্রাণিত করে। এই সূত্রে অনেকেইমুম্বাই বা নিউইয়র্কের মতো শহরকে অন্য বহু জাতির মানুষের বৈশিষ্ট্যকে হজম করে ফেলার (meeting pot) বা একটি সংমিশ্রণ তৈরি করে দেওয়ার তত্ত্ব থেকে সরে আসেন। তারা এই মিশ্র সহাবস্থানকে বরং খাবারের সঙ্গে পাশ্চাত্য কায়দায় যে স্যালাড পরিবেশন করা হয় সেই প্রতিতুলনা টানেন। ঠিকই, নতুন মিশ্রণ আখ্যা দেওয়ার অর্থ নানান ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠীর পরিচয়কে সম্পূর্ণ বিলোপ করে একটি নতুন পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু বিভিন্ন বস্তুর পূর্বেল্লেখিত ‘স্যালাড পাত্রে’ অবস্থানের অর্থ ছোটো ছোটো নিজস্ব পরিচয়ের জনগোষ্ঠীও স্বকীয়তা বজায় রাখার যথাযথ সংরক্ষণ পায়। তারা অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান করেও পরিচয় চিহ্ন টিকিয়ে রাখতে পারে।
ভারতের ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রেখেও একই সঙ্গে সহাবস্থানের গুরুত্ব সম্ভবত প্রথম প্রকাশ্যে আনেন বালগঙ্গাধর। তিলক।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই নিজস্ব পরিচয়ের ওপর জোর দিয়েই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী কিছুটা নির্জীব দেশবাসীর মনের মধ্যে প্রবেশ করার সম্ভাবনার কথা। একবার যদি তাদের স্বাভিমান জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে দ্বিধা করবে না। তার ‘স্বরাজ ও স্বদেশীর জন্য আন্দোলনের আহ্বান এই কারণেই।
দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু “স্ব’উদাহরণটি উপস্থিত অর্থাৎ নিজ বা আপন। তিলকের মতে আত্মনির্ভর হওয়ার ভাবনার মধ্যেই সুপ্ত ছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম সোপান। তিলক চেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে যৌথ চিন্তা ও তাকে কাজে পরিণত করার ইচ্ছেকে উজ্জীবিত করতে। মানুষের চিন্তাকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে তিনি প্রচারমাধ্যমকে হাতিয়ার করেন। মরারাষ্ট্রে ‘মারাঠী’ ও ‘কেশরী’ নামে দুটি কাগজ প্রকাশ করেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একতার ভাবনাকে প্রসারিত করতে প্রতিষ্ঠা করেন Deccan Education Society. এই ভাবে শিক্ষিত মনন তৈরি করে তাদের রাজনীতি ক্ষেত্রে সক্রিয় করে তোলার যে ফর্মুলা তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন তা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রচারমাধ্যমের এই যৌথ প্রয়োগ পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী ও বাবাসাহেব আম্বেদকর তার অনুসরণ করেছিলেন।
বাস্তবে তিলক ছিলেন সেই বিরল শ্রেণীর দার্শনিক-রাজনীতিবিদ। স্বরাজ ও স্বদেশী সম্পর্কিত তার সহজ বিশ্লেষণ প্রত্যেকটি ভারতীয়কে তাদের ওপর ইংরেজের চাপিয়ে দেওয়া অপমান ও অবিচারের বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ করে তোলে।‘হোমরুল’-এর দাবি নিয়ে তার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে স্বরাজের আন্দোলনের উর্বর জমি প্রস্তুত করে দেয়। ‘হোমরুলের’জন্য বিক্ষোভের উদ্দেশ্য বিষয়ে তার ভাবনা ছিল স্পষ্ট। তিনি লিখেছিলেন একটি অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও দাবির কথা— “India was like a son who had grown up & attained maturity. It was right now that the trustee or the fathar should give him what was his dul. The people of India must get this effected. They have a right to do so.”
অন্যদিকে দুরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মানুষটির মনে তখনই স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের রূপরেখার স্পষ্ট ছবি ছিল। তাঁর কাছে স্ব-রাজ শব্দটি বোঝাতে স্ব-ভাষা ও স্ব-ভূষা (বেশ) অর্থাৎ মাতৃভাষা ও স্বজাতির পোশাক পরিধান ছিল আবশ্যিক। তিনি প্রথম সর্বভারতীয় নেতা যিনি আলাদা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি বিশদে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে মারাঠী, তেলুগু ও কন্নড় ভাষার ভিত্তিতে আলাদা আলাদা রাজ্য গঠন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তার পরিকল্পনায় শিক্ষার মাধ্যম যে মাতৃভাষাই হবে তা বলাই বাহুল্য। একজন অতি দক্ষ পরিকল্পনাকার হিসেবে এক্ষেত্রে ইংরেজ গণতন্ত্র ও সংবিধান (তাদের) মান্যতা নিয়ে বিশেষ অহংকার করত তিনি সেই ব্যবস্থারই পূর্ণ সদব্যবহার করে জাতির উপকারে প্রয়োগ করেছিলেন।
এই লক্ষ্য পূরণ করতে তার সংবাদপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা ও আবেগের প্রয়োগ করতে প্রভূত সুবিধে হয়েছিল। তার নিজলিখিত সম্পাদকীয় স্তম্ভগুলিতে জ্বালাময়ী তৎকালীন বিষয় উত্থাপিত হলেও তা ছিল নিকষযুক্তিনিষ্ঠ ও আইনসিদ্ধ, যাতে না ব্রিটিশ প্রভু কোনো না কোনো ছিদ্রান্বেষণ করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু না করতে পারে। আরও একটা জিনিস, রেখে-ঢেকে মলম দিয়ে কথা বলা
তিলকের চরিত্রে ছিল না। শিক্ষা দীক্ষায় বিশিষ্ট পণ্ডিত তিলক স্বরাজের লক্ষ্য পূরণে তৃণমূল স্তরে রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও সমাজে প্রয়ােজনীয় মতামতের সমর্থন তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন। এই সময় সরাসরি জনসমক্ষে নিজ বক্তব্য পেশ করতে তার সমসাময়িক বহু কংগ্রেস নেতাই ভেতরে ভেতরে আশঙ্কিত ছিলেন। তার এই ‘স্বরাজের স্বপ্ন কিন্তু কেবলমাত্র ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। জাতির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনার প্রকাশ ঘটানাের স্বাধীনতাও এর মধ্যে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। সেই কারণেই জাতীয় নবজাগরণের জনক হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা একেবারেই সঠিক। তার দুটি অসামান্য প্রচেষ্টা শ্রীগণেশ উৎসব ও ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জন্মজয়ন্তী পালন করার প্রথার প্রবর্তনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য ছিল জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মিলিত হওয়া। এই সূত্রে তার ‘কেশরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমে তিনি লিখেছিলেন, “এই গণেশ উৎসব পালন করার প্রথা বহু প্রাচীন কিন্তু নতুন করে একে জাগিয়ে তােলার উদ্দেশ্য হলাে আগেকার মতাে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এখনকার উৎসবে সকলের অংশগ্রহণ কেউ আটকাতে পারবে না। এটি হয়ে উঠবে হিন্দুদের মিলন ক্ষেত্র। এই নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত।
আর স্বদেশীর ব্যাপক প্রচলনের মধ্যেও ছিল বিশেষত্ব। জাতীয় জীবনে স্বদেশী ব্যবহারের কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে তার সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন লালা লাজপত রায় ও বঙ্গপ্রদেশের বিপিনচন্দ্র পাল। এঁরাই তৎকালীন সময়ে এক ডাকে ‘লাল-বালপাল’ ত্রয়ী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, তাঁর স্বদেশীর পরিকল্পনা কেবলমাত্র বিলিতি দ্রব্য বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সমগ্র জনগােষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও তাদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যই বিলিতি বর্জন ও বিলিতি দ্রব্য পােড়ানাের মতাে সহজ পন্থা চালু করেছিলেন। তার অন্তর্নিহিত ও বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উদ্যোগপতি তৈরি করা। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন বৃদ্ধিকে উৎসাহ দেওয়া ছিল অন্যতম কারণ। প্রারম্ভিক মূলধন তৈরি করার উদ্দেশ্যে তিনি অর্থ সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন এর নাম ছিল ‘পয়সা ফান্ড’!
উদাহরণ হিসেবে তিনি প্রথমেই ঈশ্বরদাস বাষ্ণেয় নামে পুনের এক ব্যক্তির পেছনে দাঁড়িয়ে যান। তার সুরাটে দেওয়া বক্তৃতা এই মর্মে এতটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, বাষ্ণেয় তিলকের পৃষ্ঠপােষকতায় পুনেতে পৈইসা ফান্ড কঁাচ উদ্যোগ’ নামে কারখানা খােলেন। এই একই উদ্দীপনা প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে যখন তিলক জামশেদজী রতনজী টাটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘বােম্বে স্বদেশী সমবায় স্টোর কোম্পানি তৈরি করেন। এখানে কেবলমাত্র ভারতে তৈরি জিনিসই বিক্রি হতাে। টুটিকোরিনে চিদাম্বরম পিল্লাই নামে এক ব্যক্তি বড়াে আকারে প্রথম ১৯০৬ সালে ভারতীয় জাহাজ কোম্পানি খােলেন। এই উদ্যোগের সাফল্য ব্রিটিশের বিখ্যাত British India steam Navigetion কোম্পানিকে ব্যবসা সম্পর্কে আশঙ্কিত করে তুলেছিল। তার স্বদেশী ব্যবহারের ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়ে গেছে মান্দালয় জেলে বসে তার লেখা গীতারহস্য’-এর প্রকাশনা ক্ষেত্রে। তিনি জানিয়েছিলেন এই বই যেন কেবলমাত্র স্বদেশী পেপার মিল D Padnji & Sons-এর কাগজেই ছাপা হয় অন্যথায় নয়।
তাই, আজ যখন আমরা আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলি তা মূলত তিলকের সূচিত উদ্যোগেরই উত্তরাধিকার। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ও বিভিন্ন সংস্কৃতি ও প্রথায় বিশ্বাসী ভারতবাসীকে সামাজিক ভাবে একসূত্রে বাঁধার পরিকল্পনার জনক লােকমান্য তিলকের শততম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁকে প্রণাম।
বিনয় সহস্রবুদ্ধে
(লেখক রাজ্যসভার সদস্য)