রায়সাহেব পঞ্চনন বর্মা (১৮৬৬১৯৩৫) রাজবংশী সমাজে পুনর্জাগরণের যে ঢেউ তুলেছিলেন তা রংপুর, কোচবিহার, অসম, বিহার পর্যন্ত পৌঁছেছিল।১৯৪৬ সালে তুফানগঞ্জের ৩১নং জাতীয় সড়কের পাশে। নদীর তীরে তিনদিন ব্যাপী বিরাট ক্ষত্রিয় মহাসম্মেলন হয়েছিল। এই সম্মেলনে রাজবংশী সমাজের মানুষ দলে দলে যোগ দিয়ে উপবীত ধারণ করেছিলেন। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণও যোগ দিয়েছিলেন এই মহাসম্মেলনে। তুফানগঞ্জের বর্তমান খেলার মাঠে দুর্গাপুজোও শুরু করেছিলেন স্থানীয় জনগণ। এই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রায়সাহেব হিন্দু সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে রাজবংশী সমাজের আলগা হয়ে যাওয়া বাঁধন দৃঢ়ীকরণের যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন তার প্রত্যেক প্রভাব সমাজে নানা ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। যেমন কোচবিহারের ভারতভুক্তির সময় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মহল অসমের মতো স্থানীয়-বহিরাগত ইস্যুতে বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে বিভাজিত করে কোচবিহার রাজ্যকে পাকিস্তান ভুক্ত করাতে গিয়ে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য। হন। কোচবিহারের ইতিহাস পাঠ করলে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের পূর্ববঙ্গে যদি যোগেন মণ্ডলের মতো তপশিলি নেতার জায়গায় রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মার মতো একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বলিষ্ঠ সংগঠক জন্মাতেন তাহলে হয়তো দেশভাগের ইতিহাস অন্যরকম ভাবে লেখা হতো।
৫৬৩টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে ৭টি রাজ্য তাদের ধর্মীয় জনবিন্যাস অনুযায়ী পাকিস্তানে ও বাকি ৫৫৪টি ভারতে যোগ দিয়েছিল।
উত্তরপূর্ব ভারতের মণিপুর, ত্রিপুরা এবং বঙ্গপ্রদেশের কোচবিহারের যোগদানের বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছিল একেবারে শেষের দিকে। দিল্লি থেকে উত্তরপূর্ব ভারতের দূরত্বই যে এইসংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে বিলম্বের কারণ এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ভারত সরকার প্রথমদিকে উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ইতিহাস বলছে সংযুক্তি নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই সমস্ত জটিলতা সামলে সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দেশীয় রাজ্যের ভারপ্রাপ্তমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই। প্যাটেল নজর দিয়েছিলেন উত্তরপূর্ব ভারতের দিকে।
স্বাধীনতার প্রায় দু বছর পরে দেশীয় রাজ্য কোচবিহার নবগঠিত ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। ইতিহাসে স্বল্প আলোচিত হলেও এই দু’বছরে এখানে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় দেশীয় রাজ্য কোচবিহারে রাজ-সরকারের বাইরে কোনো সংবাদ বা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হতো না। এছাড়া রাজতান্ত্রিক বিধি-নিষেধের জন্যও রাজ্যের সংবাদ বাইরে যেতে পারতো না। ফলে এখানে ঘটে চলা ঘটনাবলী কলকাতা কেন্দ্রিক দৈনিক সংবাদপত্রে স্থান পেতনা।তখন প্রতিবেশী জলপাইগুড়ি থেকে জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রিকা ‘জনমত’ প্রকাশিত হতো। ওই সময় জনমত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও চিন্তাবিদ ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল। ডাঃ সান্যাল অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কোচবিহারের সংবাদ প্রকাশ করতেন।
সে সময়ের কোচবিহারের উদ্বেগজনক ঘটনাবলী সম্পর্কে যে কোনো ধরনের আলোচনায় ডাঃ সান্যাল কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদগুলি এখন ঐতিহাসিক নথি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ১৩৫৪ সালের ২১ ভাদ্রের ‘কোচবিহারে ধূমায়িত বহ্নি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে ডাঃ সান্যাল লিখেছিলেন, “মাথাভাঙায় স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশ্য ভাবে ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হইয়াছে। দিনহাটা মহকুমার হাকিম আহাম্মদ হোসেন প্রধান কোচবিহারকে পাকিস্তানের সহিত যুক্ত করিতে মুসলমানদেরকে প্রকাশ্য সভায় প্ররোচিত করিয়াছে। ইহাও প্রচার হইতেছে যে হলদিবাড়ি শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত হইবে। কোনো সংবাদ যাহাতে রাজ্যের বাইরে না যাইতে পারে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হইয়াছে।”
কোচবিহার রাজ্যের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চারুচন্দ্র ওই সম্পাদকীয়র শেষাংশে লিখলেন, “পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হউক। হায়দরাবাদের অভিনয় কোচবিহার রাজ্যে যাহাতে ঘটিতে না পারে সে বিষয়ে এখন হইতেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের বল্লভভাই প্যাটেলকে অনুরোধ করি কুচবিহারের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বিশেষ অনুসন্ধান করিতে এবং আবশ্যক মতো বিধিব্যবস্থা করিতে।”
‘জনমত’-এ প্রকাশিত খবরের জের কিনা বলা মুশকিল, তবে এই খবর প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৫ সালের ১৫ কার্তিক ‘কুচবিহার সংবাদ শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী (সে সময় এই নামেই সবাই জানতো) ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের কুচবিহার সফরের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। কোচবিহারের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্যই ড. প্রফুলচন্দ্র ঘোষ সেখানে গিয়েছিলেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে তিনি কোচবিহার পৌঁছান এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওইদিন বিকালেই তিনি রাজ্য প্রজা কংগ্রেসের এক সভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি ‘হিতসাধনী নেতাগণকে এবং সমবেত জনগণকে কুচবিহারী-ভাটিয়া কোনো পার্থক্য সৃষ্টি না করিতে উপদেশ দেন। হিতসাধনীর কোনো নেতাকুচবিহারকে অসমের সহিত যুক্ত করার অভিপ্রায় জানাইলে তাহাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।
১৯ সেপ্টেম্বর স্টেট কংগ্রেসের একটি জনসভায় ড. ঘোষ বক্তৃতা করেন। স্টেট কংগ্রেসের সভাপতি উমেশচন্দ্র মণ্ডল এবং সাধারণ সম্পাদকহীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানান। সভায় বিশ হাজার নর-নারী যোগদান করেছিলেন। কোচবিহারে অবস্থানের কালে হিতসাধনী সভার পৃষ্ঠপোষক, নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রীগণ এবং মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বহিরাগতদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
কোচবিহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল যে হিতসাধনী সভার উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিখ্যাত ভাওয়াইয়া সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদ আত্মজীবনীতে (আমার শিল্পী জীবনের কথা, সৃষ্টি প্রকাশন, কলিকাতা-৯) হিতসাধনী সভার উল্লেখ রয়েছে। আব্বাসউদ্দিন লিখেছেন, “যখন আমরা থার্ড ক্লাশে পড়ি তখন ফয়েজউদ্দিন একদিন তুফানগঞ্জে এল। স্কুলে যে কয়জন কুচবিহারী হিন্দু-মুসলমান ছিলাম সবাইকে খবর দিয়ে রায়ঢাক নদীর ওপাড়ে কুলক্ষেতে গিয়ে মিলিত হলাম। ফয়েজ বলল, “দেখ আমরা কুচবিহারে কুচবিহারী ছাত্রদের দিয়ে ‘কুচবিহার হিতসাধনী সভা’করেছি। উদ্দেশ্য আমাদের দাবি দাওয়ার উপরে জোর দেব, সর্বত্র সেবা সদনের শাখা খুলব এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাতে কুচবিহারী ছাত্রদের দাবি উপেক্ষিত না হয় তার ব্যবস্থা করব এবং আমাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হবে—কুচবিহার কুচবিহারবাসীদের জন্য, অর্থাৎ বহিরাগত ভাটিয়াদের প্রভুত্ব আমরা এ রাজ্য থেকে উচ্ছেদ করবো। এটা হচ্ছে শাখাসভা প্রধানসভা কুচবিহারে। কাজ হবে আমাদের খুবই গোপনে। বৎসরে একবার সভা হবে, যথাসময়ে খবর পাবে।
বহিরাগত বা ভাটিয়াদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ হিসেবে আব্বাসউদ্দিন লিখেছেন, “কুচিবাহারবাসী হিন্দু-মুসলমান বহিরাগত বর্ণ হিন্দুদের দ্বারাই একরকম শাসিত। উকিল হাকিম, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, প্রফেসর, মাস্টারসব লাইনেই এদের কতৃত্ব। ভগবতী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মহারাজা হরেন্দ্রনায়ণের সময় (১৭৮৪-১৮৩৯) থেকে মূলত দক্ষিণ দেশীয় বর্ণ হিন্দুরা রাজার নামে দেশ শাসন করতেন। এই সময় বাঙ্গালিবাবুরা এ রাজ্যের প্রধান প্রধান কর্মচারী পদে নিযুক্ত ছিল। ইতিহাস বলছে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারয়ণের (১৮৮৩-১৯১১) রাজত্বকালে কোচবিহারকে ঢেলে সাজানোর কর্মযজ্ঞে কর্মসংস্থানের প্রশ্নেও বাঙ্গলার শিক্ষিত সমাজের প্রাধান্য অব্যাহত ছিল। মনীষী পঞ্চানন বর্মা (এমএবিএল) রাজবংশী সমাজের মধ্যে প্রধম সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি হয়েও রাজদরবার থেকে উপযুক্ত সম্মান পাননি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত কোচবিহার থেকে বহিষ্কৃত পর্যন্ত হতে হয়েছিল। সে সময় রাজপরিষদের কাজকর্ম ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনোরকম ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ ছিল না। কারণ কোনোরকম প্রতিবাদ বিক্ষোভের আভাস ইঙ্গিত পাওয়া গেলেই তা কঠোর হস্তে দমন করা হতো। এই কারণেই রাজশাসিত কোচবিহার কোনো রকম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেনি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে অবদমিত ক্ষোভকে ভিত্তি করে হিতসাধনী সভার মতো গোপন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পরিচালিত সংগঠন গড়ে ওঠা হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।
গায়ক আব্বাসউদ্দিনের জন্ম ২৭ অক্টোবর ১৯১০ সালে কোচবিহারের বলরামপুরে। ১৯১৪ কিংবা ১৯১৫ সাল নাগাদ তিনি হয়তো থার্ড ক্লাস অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। সেই হিসেবে বলা যায়। ১৯১৪-১৫ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গোপন সংগঠন হিসেবে হিতসাধনী সভা ক্রিয়াশীল ছিল। এই ঘটনার তিন দশক পরে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সময় হিতসাধনী সভা কুচবিহার লাইনের মাঠে (বর্তমান রাসমেলার মাঠ) বিরাট সভার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। জনচেতনার প্রেক্ষাপটে এই সভাই ছিল কোচবিহার রাজ্যে প্রথম রাজহীন সভা এবং এখানে যেহেতু আর কোনো রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি ছিল না সেজন্য হিতসাধনী সভাই ছিল একমাত্র রাজকীয় রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত সংস্থা। গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীদের একাংশ এই সভার সদস্য ছিলেন।
কমলকান্তি গুহ তাঁর ‘আমার জীবন আমার রাজনীতি’ (দীপ প্রকাশন ,পৃঃ ১০) গ্রন্থে লিখেছেন, “হিতসাধনী সভার উদ্দেশ্য হলো— বহিরাগত বা ভাটিয়াদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের সঙ্ঘবদ্ধ করো, ক্ষেপিয়ে তোলো। স্বাধীনতার আন্দোলন, শোষিত মানুষের মুক্তির আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনাশ করো। বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দাও। বিচ্ছিন্নতাবাদের বিষে অবশ করে দাও ভূমিপুত্রদের চেতনাকে। এরইনাম হিতসাধনী সভা। মজার কথা, যারা রাজস্থান, বিহার বা অসম থেকে এসে কোচবিহার রাজ্যের অর্থনীতিকে কুক্ষিগত করেছে, শোষণের হালটি ধরে আছে বা গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে থাবা বসিয়েছে তারা কিন্তু হিতসাধনী সভার লক্ষ্য নয়।”
আনুষ্ঠানিক ভাবে কোচবিহারের ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়া যতই কাছাকাছি আসছিল হিতসাধনী দলে দুটি উপদল ততই প্রকট হয়ে উঠছিল। এই দলের মুসলমান সদস্যরা কোচবিহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কোচবিহার রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও অ্যাকাউন্টটেন্ট আসমত আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর জেলার লালমণির হাটে পাকিস্তানের লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন’(আনন্দ গোপাল ঘোষ ও শেখর সরকার প্রণীত কোচবিহার রাজ্যে রাজনৈতিক ‘ আন্দোলনের রূপরেখা, মধুপর্ণী- কোচবিহার জেলা সংখ্যা-১৩৯৬)।
ডাঃ চারচন্দ্র সান্যাল ২৩.৫.৪৯-এ ‘জনমত’পত্রিকায় লিখেছিলেন, “কুচবিহারে হিতসাধনী সভা নামে একটি দল আছে। ইহারা চিরকাল ‘ভাটিয়া খেদা’ আন্দোলন করিয়া আসিয়াছে। বর্তমানে এই দলটিতে পাকিস্তানিদের পুরুমাত্রায় উস্কানি আছে। পূর্ব পাকিস্তান হইতে কয়েকজন মুসলিম লিগ নেতা এই দলে অংশগ্রহণ করিয়াছে। ইহাদের উদ্দেশ্য স্টেট কংগ্রেসকে ধ্বংস করা।”
হিতসাধনী সভার প্রথম লক্ষ্য ছিল, ‘বহিরাগত ভাটিয়াদের’রাজ্য শাসনের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া। এই কাজে সার্বিকভাবে সফল হওয়ার পর হিতসাধনী সভারমুসলমান লবি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি করণের ষড়যন্ত্র করেছিল। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভূ পবাহাদুর যখন ইংল্যান্ড সফররত ছিলেন তখন কোচবিহারের রাজস্বমন্ত্রী আমানতউল্লা খানচৌধুরী গোপনে পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তানে যোগদানের কাগজপত্র তৈরি করে ফেলেন। এই মারাত্মক ষড়যন্ত্রের কথা ভারত সরকার টের পেয়ে যায়। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তড়িঘড়ি কোচবিহারের মহারাজাকে দিল্লিতে ডেকে আনেন’ (সুকল্যাণ ভট্টাচাৰ্য্য ‘উন্নয়নের জন্য নতুন রাজ্য সৃষ্টি কোনো সমাধান নয়, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ১৮.১০.২০০৫)। হিতসাধনী সভার লিগপন্থী নেতারা যখন কোচবিহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে প্রাণপাত করছেন সেই সময় মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ নিজেই ২৮ আগস্ট, ১৯৪৯ নিঃশর্ত ভাবে রাজ্যের শাসনভার ভারত সরকারকে তুলে দিলেন।
১৯৪৭ সালের মে মাসে প্রকাশ্য সভার মাধ্যমে হিতসাধনীসভার আত্মপ্রকাশের দিনই গায়ক আব্বাসউদ্দিন গেয়ে উঠেছিলেন, ‘ও ভাই মোর কুচবিহারীরে/ চতুর্দিকে দেখং সবুজ বাতি/ তোমার এলা ক্যানে আন্ধার রাতি?/ নিজের টোপলা নিজে নেও/ হাসিমুখ তোমার পরাদেও/ পরদেশি কী হয় আপনারে ও ভাই মোর কুচবিহারীরে। সন্দেহ নেই গানের মাধ্যমেই আব্বাসউদ্দিন কুচবিহারের মাটিতে দেশি ভাটিয়া বিভাজনের বিদ্বেষ বীজ বপন করেছিলেন। আব্বাসউদ্দিন সাহেব নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “গানটা গাওয়ার পর সভায় অপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি হলো। সেই গান সারা কুচবিহারে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু আব্বাসউদ্দিন সাহেব যখন দেখলেন হিতসাধনীর ভাইয়েরা কোচবিহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে ব্যর্থ হলেন তখন তিনি নিজেই তার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে, ‘ও ভাই মোর কুচবিহারীদের’ ছেড়ে পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে গেলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ঢাকার। পাকিস্তান রেডিয়োতে আব্বাসউদ্দিন সাহেব সর্বপ্রথম গেয়ে উঠলেন, “সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা/ দুনিয়াতে ভাই সে কোন স্থান?/ পাকিস্তান সে পাকিস্তান।” ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক ক্রিয়াকলাপের জন্য ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সাল কোচবিহারের সিভিল সেসন জজ বজলে রহমান, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। হোসেন মহাম্মদ এরশাদের পিতা ও আইনজীবী মকবুল হোসেন, কোচবিহার রাজ্যের অর্থসচিব আনসারউদ্দিন আহমেদ, কোচবিহারের অর্থমন্ত্রী আমানতউল্লা খান চৌধুরী কোচবিহার থেকে বহিষ্কৃত হলেন। ‘গজেন্দ্রনাথ বসুনিয়ার নেতৃত্বে অপর একটি। অংশ ‘ভাটিয়া তাড়াও’ মন্ত্র সম্বল করে বিচ্ছিন্নতাবাদী পথ ধরে এগুতে থাকেন। এঁদের প্ররোচনায় ১৯৫২ সালে বাইশগুড়িতে দাঙ্গা হয়। তাতে অনেক মানুষ খুন হন। গজেন্দ্রনাথ বসুনিয়া গ্রেপ্তার হন’ (সুকল্যাণ ভট্টাচার্য ‘উন্নয়নের জন্য নতুন রাজ্য সৃষ্টি। কোনো সমাধান নয়, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ১৮.১০.২০০৫)। বিলুপ্ত হয় হিতসাধনী সভা। কংগ্রেস কমিউনিস্ট, কুচবিহার প্রজা মণ্ডল ওকুচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের কিছু ব্যক্তিত্ব কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। দুজন বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব ব্যবহারজীবী গান্ধীবাদী। উমেশ চন্দ্র মণ্ডল ও রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মার স্নেহধন্য জলপাইগুড়ির বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী। উপেন্দ্রনাথ বর্মনও সে সময় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহারের সংযুক্তি করণের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সেসময় কলকাতায় ‘কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তোলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তারাপদ চক্রবর্তী, পুলকেশ দেসরকার প্রমুখ। দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক ব্যারিস্টার অতুল চন্দ্র গুপ্তের উপস্থিতিতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে এই সংস্থার উদ্যোগে একটি সভাও হয়েছিল। এই সময় জওহলাল নেহরু কলকাতায় এসে একটি জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি কোচবিহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন প্রয়োজনে কোচবিহারে গণভোট নেওয়া হবে। তখন কোনো দেশীয় রাজ্যের সংযুক্তিকরণ নিয়ে গণভোট হয়নি। ইতিহাস বিশ্লেষকদের ধারণা কোচবিহার অসমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে এই টানাপোড়েন প্রসঙ্গেই হয়তো নেহর গণভোটের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছিলাম। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল গণভোটের প্রসঙ্গ তোলেননি; বরং জরুরি ভিত্তিতেই ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কোচবিহার রাজ্যের সংযুক্তকরণের কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। এই সংযুক্তিকরণের শেষ পর্বে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট সংযুক্তির পর মাত্র চার মাস ‘সি’ ক্যাটেগরি রাজ্য হিসেবে শাসিত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ইতিহাস বিশ্লেষকদের ধারণা হিতসাধনী সভার মুসলিম লিগ পন্থীদের কুচবিহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার তৎপরতা না থাকলে এই রাজ্য এত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গের জেলায় পরিণত হতো কিনা সন্দেহ।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে, হিতসাধনী সভার মুসলমান সদস্যরা দেশি-ভাটিয়া (স্থানীয় ও বহিরাগত) বিদ্বেষের বীজ বপন করে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের মধ্যে সাময়িক ভাবে ফাটল ধরানোর প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষকে সঙ্গে পেলেও পাকিস্তানের সঙ্গে কোচবিহারের সংযুক্তির প্রশ্নে নমঃশূদ্র নেতা যোগেন মণ্ডলের মতো কাউকে পাশে পাননি। এর কৃতিত্ব অবশ্যই উত্তরবঙ্গের প্রাণপুরুষ পঞ্চানন বর্মাকেই দিতে হবে। কারণ তিনি হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতার ছোবলের বিষ নীলকণ্ঠের মতো কণ্ঠে ধারণ করে রাজবংশী সমাজকে হিন্দু সমাজের অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। দেশ ভাগের সময় রায়সাহেব বেঁচে না থাকলেও তার কালজয়ী চিন্তা রাজবংশী সমাজকে পথভ্রষ্ট হতে দেয়নি।
সাধন কুমার পাল