ছেচল্লিশের সেই ভয়াবহ দিনগুলির কথা হিন্দু বাঙ্গালি ভুলতে পারে না

অযোধ্যায় গত ৫ আগস্ট রামমন্দিরের ভত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর জনসাধারণের উদ্দেশ্য এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ভাষণের মধ্যে দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন, “ভয় বিনু হোইন প্রীতি’ এটাই শ্রীরামের নীতি। রামচরিত মানসে তুলসীদাস লিখেছেন, রামচন্দ্র চেয়েছিলেন লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সাগর নিজেই তাদের রাস্তা করে দিক। কিন্তু তিন দিন কেটে গেলেও সমুদ্র গা করেনি। তখন বিরক্ত হয়ে শ্রীরাম বলেন, ভয় ছাড়া প্রীতি হয় না। সমুদ্রকে শুকিয়ে দেওয়ার জন্য রাম ধনুর্বাণ তোলার পরেই সমুদ্র হাতজোড় করে হাজির হয় তার কাছে।

রামমন্দির আন্দোলন নিয়ে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই ভাষণ, স্বাধীনতা দিবসের ৭৩ বছর পর হিন্দু বাঙ্গালির কাছে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে আনে। সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে যে ধ্বংসলীলা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বোধহয় সময় এসেছে এবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের।

ইতিহাস আমাদের অনেক কিছু শেখায়। ৪৬-এর ১৬ আগস্ট কলকাতায় প্রকাশ্য রাজপথে মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ মদতে হাজার হাজার জোহাদি মুসলমানের হাতে নিরীহ হিন্দু বাঙ্গালির হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নি সংযোগ, এরপর গান্ধীজীর অহিংসার বাণী, “অহিংসা পরমো ধর্ম’ এটি বাঙ্গালির কোনো কাজে এল না, বরং সেদিন মহাভারতের ওই উক্তির দ্বিতীয় চরণ বাঙ্গালিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল—‘ধর্মহিংসা তদৈব চ’। অহিংসাই পরম ধর্ম। তবে, ধর্মরক্ষার স্বার্থে হিংসা করা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। পরের দিন গোপাল মুখোপাধ্যায়, যুগল ঘোষ ভানু বোস, বিজয় সিংহ নাহার থেকে শুরু করে তৎকালীন কলকাতার সমস্ত ব্যয়মাগার আখড়া থেকে দলে দলে হিন্দু যুবক সেদিন হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

গান্ধীবাদী অহিংসা সেদিন কোনো কাজেই এল না। পাঁচজন বিশিষ্ট গান্ধীবাদী বাঙ্গালির শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে খুন হন—ভূদেব সেন, স্মৃতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন্দ্র মিত্র, সুশীল দাশগুপ্ত, লালমোহন সেন। লালমোহন ছাড়া এই চারজনই কলকাতায় খুন হন। লালমোহনবাবুকে হত্যা করা হয় নোয়াখালিতে। নোয়াখালির সন্দ্বীপে গণহত্যার সময়। এর বাইরেও বহু সুশীল বাঙ্গালি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সেদিন অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

অভিনেতা ছবি বিশ্বাস থেকে গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী, রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক থেকে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস এন মুখার্জি কেউই সেদিন রেহাই পাননি। ক্যানিং স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, কর্পোরেশন স্ট্রিট, ধর্মতলা স্ট্রিট, মানিকতলা রোড, বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। বিখ্যাত দোকান কমলালয় স্টোর্স, ভারতকলা ভাণ্ডার, লক্ষ্মী স্টোর্স লুঠ হয়। উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দুপাড়াগুলি আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হয় গড়পাড়, নারকেলডাঙা, ফুলবাগান, বেলেঘাটা, পার্ক সার্কাস, কলুটোলা, চিৎপুর প্রভৃতি অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি হিন্দু বাঙ্গালির বাড়ি। ক্যানেল ওয়েস্ট স্ট্রিট, গ্যাস স্ট্রিট, ফিরার্স লেন, মোটিয়াবুরুজ, লিচুবাগান প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর পরেও কী বাঙ্গালি ঘুমিয়ে থাকতে পারে? বাঙ্গালির এই আখড়াগুলোই তো ছিল ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের ট্রেনিং সেন্টার।

স্বাধীনতা আসন্ন বুঝে, মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষির খেলায় পুরো বাঙ্গলাকে কবজা করবার জন্য নিজেদের শক্তিকে জাহির করতে নেমে পড়েছিল। এর কদিন আগেই, ২৯ জুলাই বোম্বাইতে মুসলিম লিগের অধিবেশনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন জিন্না। বলেছিলেন, “আমি নীতিকথার আলোচনায় যেতে চাই না। আমাদের হাতে বন্দুক আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে প্রস্তুত৷তারা তা ব্যবহার করেছিল।

বাঙ্গালি বীরের জাত। স্বাধীনতা আন্দোলন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পাল, সেন রাজাদের বীরত্বের কথা কি ইতিহাস ভুলে গেছে ? মহারাজা শশাঙ্ক, প্রতাপাদিত্য, চাঁদ রায়, কেদার রায়ের হাত ধরেই উঠে এসেছেন সূর্য সেন, বাঘাযতীন, বিনয়-বাদল-দীনেশেরা। তাই সেদিন বীর বাঙ্গালির উত্তরাধিকারী গোপাল পাঁঠা, যুগল ঘোষ, ভানু বসুদের সমবেত প্রচেষ্টায় উন্মত্ত মুসলমানদের প্রতিহত করা ও যোগ্য জবাব দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

পরের বছর ড. শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাঙ্গালির জন্য একখণ্ড জমি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগে সমবেত প্রয়াসও আমরা লক্ষ্য করেছি। নয়তো মুসলিম লিগের চাহিদামতো এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও শরৎ বসুর মতো অর্বাচীন নেতাদের ভ্রষ্ট রাজনীতির ফলে সম্পূর্ণ বঙ্গপ্রদেশই চলে যেত পাকিস্তানের গর্ভে।

পশ্চিমবঙ্গ কেবলমাত্র একটি প্রদেশ নয়, বরং বলা চলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। এ রাজ্যের অস্তিত্ব সংকট হলে, ভারতবর্ষের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারকেই খর্ব করবে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন যদি পশ্চিমবঙ্গের আত্মপ্রকাশ না হতো তাহলে আজ কোটি কোটি হিন্দু বাঙ্গালি হয় ধর্ম পরিবর্তন করে ভীরু কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকতো, নয়তো সিন্ধি অথবা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মতো যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াত।

বাঙ্গালির দুর্ভাগ্য— শ্যামাপ্রসাদ, হরিপদ ভারতীর পর অন্তত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব বাঙ্গালি সমাজে রয়েছে। ডাঃ বিধান রায়ের পর তেমন বাঙ্গালি প্রশাসক চোখে পড়েনি। কিন্তু বসিরহাট, দেগঙ্গা, ধুলাগড় আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। হিন্দু বাঙ্গালি প্রতিহত করা ভুলে যায়নি।

কলকাতকেনা পাবার বেদনা পাকিস্তান আজও ভুলতে পারেনি। সেদিন যদি শ্যামাপ্রসাদ না আসতেন, তাহলে পুরো বঙ্গপ্রদেশ-সহ সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানে চলে যেত। অরুণাচল চলে যেত। চীনের দখলে। পূর্ব পাকিস্তান কখনই বাংলাদেশ হতো না। রাওয়ালপিণ্ডি বা করাচী নয়, পাকিস্তানের মূল কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতো পূর্ব দিকে।

সত্তর বছর ধরে এই বেদনা বুকে নিয়ে আরব সাম্রাজ্যবাদীরা খুঁটি সাজাচ্ছে। চোরাগোপ্তা মেরে বারবার অশান্ত করার চেষ্টায় তারা প্রতি মুহূর্তে সজাগ। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির জনবিন্যাস যেমন বদল করিয়ে দিয়েছে, তেমনি দীর্ঘ বছর ধরে সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের উৎকোচের প্রলোভন দেখিয়ে এদের সমস্ত অপচেষ্টা, দুবৃত্তি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ছেচল্লিশের ভয়াবহ দাঙ্গার পর দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে ভিটেমাটি হারিয়ে, চরম অত্যাচারিত হয়ে যেভাবে কয়েক কোটি হিন্দু বাঙ্গালি ওপার থেকে এপারে এসে স্থিতু হয়েছে, এই অবস্থানের বদল তারা সহজে মেনে নেবে না।

ছেচল্লিশে কলকাতার গণহত্যা সংঘটিত করবার জন্য সেদিন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত জুটেছিল। লালবাজারে কন্ট্রোল রুম খুলে পুলিশ প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে কয়েক হাজার নিরীহ হিন্দু বাঙ্গালিকে হত্যা করেছিল। তারই পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখলাম নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোনলের নামে। চতুর্দিকে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন উপড়ে, রেলের ইলেকট্রনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে উত্তর দক্ষিণের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আটকে দিয়ে সেদিনের মতো আবার তাদের হুংকার শোনা গেল—“অসুবিধা করার একশো উপায় আমাদের জানা আছে। এবারও প্রশাসন চুপ। মিডিয়া চুপ। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মোমবাতি মিছিল কেন, কোনো অসন্তোষসূচক বাক্যও চোখে পড়েনি।

তবে, আরব সাম্রাজ্যবাদীরা যতই মদত জোগাক, সমাজ কিন্তু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম উদাসীন হয়ে থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়া এই বর্বরতার ছবি গোটা দুনিয়ায় রাষ্ট্রকরেছে। কমিউনিস্টদের আর কোনো প্রভাব নেই। সুবিধাবাদী উৎকোচভোগী বুদ্ধিজীবীদের মুকোশ খুলে গেছে। জনতা জেগে উঠেছে।

ষাট সত্তরের দশকের একটি কবিতার লাইন এখন হিন্দু বাঙ্গালির মুখে মুখে ফিরছে— “জমি কারো বাপের নয়, জমি হইল গিয়া দাপের”। প্রেম প্রীতি উদারতা ভ্রাতৃত্ব অনেক হয়েছে। ভবি ভুলবার নয়। তাই, অন্যায় অত্যাচারের ভয়ে মুখ লুকিয়ে বসে না থেকে রুখে দাঁড়াবার ১৬ আগস্টের শিক্ষাই বাঙ্গালিকে বারবার মনে করিয়ে দেবে।

তুলসীদাস তো যথার্থই লিখেছেন

বিনয়া ন মানতো জলধি জর গয়ে তিনি দীন বীতি।

বোলে রাম সকোব তব ভয়া বিনু হোই না প্রীতি।

লছিমানা বান সরায়েন আনু সৌষোবরিধি বিসিখা কৃষাণু।

শঠ সানা বিনয় কুটিল সানা প্রীতি, সহজে কৃপানা সানা সুন্দর নীতি।

প্রবীর ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.