রাখিবন্ধন আজ ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি তে এই সময়ে রক্ষাবন্ধনের উপযোগিতা পর্যালোচনা করার আগে আসুন আমরা এই মঙ্গলজনক ও রক্ষাকর অনুষ্ঠানটির প্রতি একবার আন্তরিক অবলোকন করি। সর্বজন বিদিত রাখীর মন্ত্র টি হল-

যেন বদ্ধ বলিরাজা দানবেন্দ্রমহাবলঃতেন ত্বামনুবধ্নামি রক্ষে মা চল মা চল।।” অর্থাত্ যে রক্ষাসূত্রের দ্বারা দানবরাজ মহাবলশালী বলীকে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছিল। আমি তেমনি সূত্রের দ্বারা তোমাকেও বন্ধন করছি, হে রক্ষা সূত্র তুমি চির অচল হয়ে থাকো।
আসুন একবার অতীতের দিকে ফিরে তাকাই যেখানে রক্ষার উদ্দেশ্যে এমনি আচার গুলি পালিত হয়েছে- দেবরাজ ইন্দ্র দেবাসুর সংগ্রামে যখন বারবার পরাজিত হচ্ছিলেন তখন পতি ইন্দ্রদেবের হাতে রক্ষা সূত্রের বন্ধন করে বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন ইন্দ্রাণী শচীদেবী। আরো পরে দানবরাজ বলী যখন ত্রিভুবন করেছিল পদানত, দান-এর মত উপায়কে অবলম্বন করে বিজিত সাম্রাজ্যে স্থির হতে চাইছেন তখন রাষ্ট্র ও সমাজের উদ্ধারক রূপে এগিয়ে এলেন যে নায়ক, সে যে বিজয়ী বলীর কাছে বামন মাত্র, অবহেলার পাত্র ছাড়া আর কিছুই না। দানগর্বে গর্বিত বলী তাকেও দানের দ্বারা তুষ্ট করতে চাইলেন, নিখুঁত রাজনৈতিক চালে সেই বামনই তাকে বন্দী করলেন পাতালে। এখানেই এই গল্পের শেষ নয়, আর একটু আছে সেটা হল- বামন পত্নীর (লক্ষী দেবী) দ্বারা রক্ষাসূত্রে আবদ্ধ করে, বন্দী বলীকে আনন্দলোকে ফিরিয়ে আনেন। সবাইকে নিয়ে চলা, একিভূত করা, আত্মিকৃত করার সে এক অনন্য নজির। আনন্দের বিষয় একারনে আমাদের সমাজের পৌরাণিক বা ইতিহাসকাররা বলীকে নায়ক না বানিয়ে বামনকেই ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে মর্যাদা দিলেন। আর এখানেই রাখির মত একটি তন্ত্র ও “যেন বদ্ধ…. মা চল।” ইত্যাদির মত একটি অনন্য মন্ত্র আমরা পেলাম। এই পরম্পরার আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেখা য়ায়। যেমন আরো পরে রামচন্দ্র গুহকের মৈত্রী নানা উপাচারে সুশোভিত হয়েছিল, বনফুল লতা ও ফলে। মাতা সবরীর সাথে রামচন্দ্রের স্বাক্ষাত্কার – সেতো কতই না চির আকাঙ্খীত ছিল। সুগ্রীব আর রামচন্দ্রের মৌত্রী তো অগ্নী শাক্ষী পূত। রামচন্দ্রের ও মাতাসীতার দুই পুত্র লব-কুশ কে দূর্বা অথবা কুশের দ্বারা বন্ধন করে তাদের রক্ষা সুনিশ্চিত করেণ বাল্মীকি। মহাভারতেও মাতা যশোদা, মাতা কুন্তী দের দেখেছি আপন পুত্রের রক্ষা ও মঙ্গল কামনায় রক্ষা সূত্র পরিয়ে দিতে। দ্রৈপদী একদিন আহত কৃষ্ণের বাহুতে নিজ বস্ত্রখণ্ডের দ্বারা বন্ধন করেছিলেন, অপর দিকে কৃষ্ণ ও দ্রৌপদীকে বিপদে রক্ষা করেছিলেন। শ্রাবণ মাসে বৈদিক ঋষিরা প্রবাস রহিত হয়ে আশ্রমে অবস্থান করেন ও যাগ-যজ্ঞ করতে থাকেন। শ্রাবণী পূর্ণিমাতে সেই কর্মকাণ্ডের পূর্ণাহুতি প্রদত্ত হলে- বৈদিক ঋষিগণ তাদের শিষ্যদের দক্ষিণ হস্তের মণিবন্ধে বেঁধে দিতেন রক্ষা সূত্র। আজো পুরহিতরা তাদের যজমানদের মঙ্গল ও রক্ষার ভাবনায় পরিয়ে দেন রক্ষা সূত্র ঐ শ্রাবণীপূর্ণিমার পুন্য তীথিতে। অন্যদিকে মঙ্গলজনক কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত হতে সঙ্কল্প কালেই পুরোহিতরা আজও যজমানকে কুশাঙ্গুরীয়ক অথবা দর্ভের তাগা পরিয়ে দেন। বিপ্তারিণী অথবা মন্দির বা দরগার তাগা গুলিরও ভাবনা, রক্ষা ও মঙ্গল বৈ আর কিছু নয়। কেবল এই সাধনটির রূপ পরিবর্তিত হয়েছে, ভাবনা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মোটামুটি একই থেকেছে।
পরাধীনতার কালে সেই প্রাচীন প্রথাটি, আচারটি যেন নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে, কর্ণাবতীর ঘটনাতে দেখলাম – রাজনৈতিক সহায়ক রাজার কাছে, সহায়তা ও রক্ষার প্রার্থনা করে প্রেরিত হচ্ছে ‘রাখী’। ১৯০২ সালে ইতিহাসে আবারও একবার রক্ষা সূত্রের দর্শণ করল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। শিক্ষাসংস্কার ও রাজ্যগুলির সীমা পুনর্বিন্যাসের দ্বারা, ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের মত জাতীয়তাবাদী ঘটনার অনুবর্তনের পথরোধ করাই ছিলো, রেসলের ষড়যন্ত্রে বাংলা প্রসিডেন্সির বিভাগের পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। সেটা কর্যকর করতে মাঠে নামে কার্জন। প্রবল বিরোধ বক্তৃতা সভাসমাবেশ সব যেন উপরে উপরে চলছিলো, জনআন্দোলনে রূপ নিচ্ছিল না। এই পরিস্থিতি সামলাতে অবতীর্ণ হলেন কবিগুরু ১৯০৫ এর অক্টোবরে তিনি রাখীবন্ধনের অকালবোধন করলেন। জাগরণ ঘটালেন জনগণের। গঙ্গার ঘাট থেকে সেদিন যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিলো তাতে মোটামুটি ভাবে বাঙালি পায়ে-পা মিলিয়ে ছিলো বলা যায়। কন্ঠেছিলো রাষ্ট্রীয়তার জয়গান। সম্বোধন করলেন আপামর জনসাধারণকে। সেই প্রচেষ্টার ফল আমরা জানি কার্জনের সেটেল ফ্যাক্ট আনসেটেল হয়ে গিয়েছিল।

আজো প্রত্যন্ত গ্রামে রাখিবন্ধন উৎযাপনের জন্য ক্লাব, সামাজিক সংস্থা, ছাত্র-যুবা নানা বর্গের মানুষদেরকে পথে নামতে দেখা যাচ্ছে- রক্ষা সূত্র হাতে নিয়ে, রক্ষা ও মঙ্গলের সংকল্প নিয়ে। ব্যক্তিগত ,পারিবারিক, সামাজিক, ধার্মিক এমন কি রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রয়োজনেও এর প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে একই প্রয়োজনকে সামনে রেখে। কালে কালে সেই অনুষ্ঠানের আচারে রূপে কিছু পরিবর্তন ঘটলেও মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকে গেছে অপরিবর্তিত।

স্মরণ করি সেই ঘটনা যেখানে বন্দি বলী কে উদ্ধার করে রক্ষা করা হল, গ্রহণ করা হল, আশ্রয় দেওয়া হল। আজ আমাদের সামনে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে এক সূত্রে গাঁথতে রক্ষা সূত্রের জুড়ি নেই। ব্যক্তি ব্যক্তিকে রক্ষা করবে, মর্যাদা দেবে, কাছে টেনে নেবে তবেই রক্ষিত হবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। আমাদের মনীষীরা উচ্চারণ করেছেন
‘দেশরক্ষা সমং পুন্যং দেশরক্ষা সমং ব্রতং। দেশরক্ষা সমং যজ্ঞং দৃষ্টং নৈব নৈব চ’
সত্যই তো দেশ রক্ষার চেয়ে বড় পুন্য-ব্রত-যজ্ঞ আর কিছুই নাই। রাষ্ট্র রক্ষার জন্য সংস্কৃতি রক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বার্তায় যা আবার চর্চায় উঠে এসেছে। এদেশের সংস্কৃতি সবাইকে ঠাঁই দিয়েছে, আত্মীকরণ করেছে, কাউকে দুরে সরিয়ে রাখেনি। কখনো কখনো পতন এসেছে আবার উত্থিতও হয়েছে। ঋগ্বেদের মন্ত্রে বলা হলো-
“পশ্চাসন্তং পুরস্কৃধি”-পিছিয়ে পড়েছে যে তাকে এগিয়ে আনো (ঋক্ – ১০.১৭১.৪)।
তেমনি অথর্ববেদের একটি মন্ত্রে বলা হলো-
উত দেবা অবহিতম্ উন্নয়থা পুনঃ”-দিব্য পুরুষেরা ! পড়ে আছে যারা তাদের উন্নয়ন কর (অথ- ১.১০.২)
কর্মের ভিত্তিতে রচিত বর্ণাশ্রম, পতনের কাল থেকে মানতে শুরু করি যে বর্ণাশ্রম জন্ম গত, আমরা ভুলে গেলাম বর্ণাশ্রমের উদ্যেশ্য সমাজের কর্মকুশলতা বর্ধন।সমাজের যে নিম্নবর্ণকে এতদিন দুরে ঠেলে রেখেছিলো সমাজ, তাকে কাছে টানতে হবে। যেমন করে শ্রীরাম চন্দ্র যাদের বিকল্পে নর অর্থাত্ বানর বলে দুরে ঠেলে রেখেছিলো তাদের কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। হিন্দভিস্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপদের সহযোগী মাদারীকেও শিবাজী মহারাজ তাকে তার পছন্দমত কর্মে নিয়োগ করলেন, কাছে টেনে নিলেন সমাজের শেষ পংক্তির ব্যক্তিকে। চৈতন্য, নানক, শ্রীরামকৃষ্ণ, ঠাকুর গুরুচাঁদ-হরিচাঁদ, প্রণবানন্দ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, আচার্যপ্রফুল্লচন্দ্র, স্বামীবিবেকানন্দ… প্রভৃতির মত মহামানব তেমন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। অথচ পণ্ডিত ভীমরাও আম্বেডকরের মত মহান ত্যাগী পণ্ডিত মানুষকেও অস্পৃশ্যতার পীড়া সহন করতে হয়েছে। আমরা আজো কি আমাদের আশেপাশের সকল সহায়ক ব্যক্তিকে সম্মানের আসন দিয়েছি ? নগরে গ্রামে সেবা বস্তি গুলিতে এমন কোন অভিযান চালিয়েছি কি ? নইলে কিভাবে সার্থক করবো বেদের আদেশ –
জীবনানাং লোকমুন্নয়”- প্রাণীসমুহের (সামান্ন) উন্নয়ন করো(অথ ১.৯.১)
নারী সমাজের অর্ধেক অংশ, সেই মায়েদের বোনেদের প্রতি আমাদের রক্ষার ভাবনা কি সঠিক ভাবে সজাগ- লাভজেহাদের করুণ পরিণতি আমরা জানি, সে বিষয়ে আমাদের কাছের বোনটিকে কি সজাগ করেছি, সমাজে সকলের জন্য এমন কোন সচেতনতা মূলক প্রচার অভিযান চালিয়েছি কি ? বোনকে ভাই রক্ষা করবে কিভাবে, যদি এমন বিষয় গুলি সম্পর্কে সচেতন না করতে পারে। বিশ্ব চরাচরে বিদ্যমান প্রতিটি অংশের রক্ষা করতে হবে, তাই পরিতঃ আবরণ যা, সেই পর্যাবরণের রক্ষা করতে হবে। এই সংসারের প্রতিটি জীবের উদ্ভিদের প্রতি রক্ষার এই ভাবনা আমাদেরকেও দীর্ঘকাল এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখবে।
মাপো মৌষধী হিংসীঃ”-জল ও বৃক্ষদের সাথে হিংসা করো না (যজু ৬.২২)
সেই ভাবনা থেকেই জল সংরক্ষনের প্রচেষ্টাও করতে হবে, পানীয় জলের অপচয় বন্ধ করতে হবে। খাদ্যে বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে জৈবকৃষির ও গো সংরক্ষণের প্রতি উৎসাহ দিতে হবে। আর সেটা সম্ভব হবে আমাদের সংস্কৃতি রক্ষণের দ্বারা, রাষ্ট্র রক্ষণের দ্বারা। এভাবে বিশ্ব কল্যাণ ও জগত কল্যাণ সাধিত হবে। এই ভাবেই রক্ষিত হবে বিশ্ব মানবতা। তখনই রাখীবন্ধনের এই মহান লক্ষ্য সার্থক হবে যখন এই রক্ষার প্রচেষ্টা- আমাদের এই সংস্কৃতি জ্ঞানের দ্বারা সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে একসূত্রে বন্ধন করতে সমর্থ হবে। এই ভাবে ব্যক্তিকে পরিবারের সাথে, পরিবারকে সমাজের সাথে, সমাজকে রাষ্ট্রের সাথে এবং রাষ্ট্রকে বিশ্বচরাচর এর সাথে জুড়তে সমর্থ হবো। পরস্পর পরস্পরকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট হোক

(লেখক পশ্চিম মেদিনিপুর জেলার ঘাটাল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।)

ডঃ প্রণব কুমার বর (Dr. Pranab Bor)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.