শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীরাম-সাধনা সত্ত্বেও বাঙালি বোঝেনি রাম বাঙালির দেবতা।

শ্রীরামকৃষ্ণের, রানী রাসমণির শ্রীরাম সাধনার ধারা ভুলে গেছে বাঙালি। একই দেহে রাম আর কৃষ্ণ মধুর; একতারাতে দোঁহে বাঁধা। অথচ অবতার-বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রকাশের মধ্যে কিছু বিদ্যাবিদ যেভাবে তাঁর শ্রীরাম সত্তাকে লুকিয়ে রাখতে চান, তা অত্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হয়।

গদাধর শ্রীরামকৃষ্ণের পিতামহ মানিকরামের দিন কাটতো রঘুবীরের সেবায়। পিতা ক্ষুধিরাম রঘুবীরের পুজো না করে জলস্পর্শ করতেন না। বাসভূমি ‘দেড়ে’ গ্রাম ছেড়ে জমিদারের অত্যাচারে যখন কামারপুকুর আসতে হল, তখন প্রায় কর্মহীন ক্ষুদিরামের সিংহভাগ কাটতো আরাধ্য রঘুবীরকে নিয়ে। রামই তখন তাঁর একমাত্র শান্তি, প্রাণের আরাম।

মানিকরাম সহ শ্রীরামকৃষ্ণের বংশের বহু মানুষের নামের মধ্যে ‘রাম’ কথাটি যুক্ত। নিশ্চয়ই অচেতন ভাবে নয়। মানিকরামের বড় ছেলে গদাধরের পিতা ‘ক্ষুদিরাম’। মানিকরামের অন্য দুই ছেলে ‘নিধিরাম’, ‘কানাইরাম’, মেয়ের নাম ‘রামশিলা’। রামকৃষ্ণের বড়ভাই ‘রামকুমার’, মেজোভাই ‘রামেশ্বর’। কানাইরামের বড় ছেলে ‘রামতারক’। রামশীলার বড় ছেলে ‘রামচাঁদ’। রামশীলার দৌহিত্র ও দৌহিত্রীর নাম ‘রাঘব’, ‘রামরতন’, ‘হৃদয়রাম’, ‘রাজারাম’।

শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম এক গ্রীষ্মের দুপুরে দূর গ্রামে গেছেন। ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। পথে বড় এক গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখলেন বিচিত্র স্বপ্ন। এক শ্যামলা ছেলে সঙ্গে যেতে চায়। ক্ষুদিরামের তখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু এ যে শ্যামলসুন্দর! এ যে বালক রঘুবীর! দেবসেবার সামর্থ্য কোথায়? বালক বলে, যেভাবে রাখবে, সেভাবেই থাকবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর।
স্বপ্ন নির্দেশে পাশের ধানক্ষেতে গেলেন। মাটির ঢিপি, পাশে শালগ্রামশিলা। তারও পাশে ফণীধর সাপ। তিনি যেতেই সাপ সরে যায়। আনন্দে মাথায় তুলে নেন শিলাখণ্ড। চিনতে ভুল হয় না তাঁর। এ যে রঘুবীর শিলা! এই রঘুবীরই হয়ে উঠলেন আদরের রামলালা, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতা।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাসমণির ঘরেও ছিল রঘুবীর। একবার গ্রীষ্মে এসে হাজির এক অপরিচিত সন্ন্যাসী। তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের সাক্ষাৎ চান। পীড়াপীড়ি করছেন দেউড়িতে, অবশেষে অনুমতি পেলেন দারোয়ানের। দোতালায় গেলেন সন্ন্যাসী রাজচন্দ্রের কাছে, “আমার কাছে রঘুনাথজিউ শিলা আছেন। আপনাকে দেবো। আপনি সেবা করবেন। আপনার মঙ্গল হবে। আমি বহুদূর তীর্থদর্শনে যাবো; ফিরবো কিনা সন্দেহ।” সন্ন্যাসী রাজচন্দ্রকে শিলা অর্পণ করলেন। বিনিময়ে কিছুই নিলেন না, বিদায় নিলেন। সেই থেকে রঘুনাথজীর প্রতিষ্ঠা হল রাসমণির ঠাকুর ঘরে। রাজচন্দ্র পাশে রুপোর হনুমান মূর্তি গড়ে দিলেন। মাহিষ্য জমিদার পরিবারে কুলদেবতা হলেন রঘুনাথজিউ৷

শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার কেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেবাকাজের ভার পেলেন? নানান কারণের মধ্যে অন্যতম হল দুজনেই রঘুবীরের উপাসক, এক আশ্চর্য সমাপাতন। রাসমনি কী চান নি শ্রীরাম ঘরানার কোনো পুরোহিতই আদ্যাশক্তির ভার নিন! রাম যোদ্ধা, ক্ষত্রিয় বীর। মা-কালী অসুর-দলনী। দেশপ্রেমী জমিদার গিন্নীর নেপথ্য ভাবনা কী ছিল না, বাঙলায় বীর সাধনার পীঠ তৈরি হোক! সমন্বয় হোক রাম-কালীর!

শ্রীরামকৃষ্ণ জটাধারী রামাইত সাধুর কাছ থেকে রামলালা পেয়েছিলেন। অষ্টধাতুর শৈশব মূর্তি৷ ১২৭০ বঙ্গাব্দ। রামলালাই হল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। শিশুমূর্তিতে প্রেমাকূল তিবি। অনুভূতি হল, জ্যোতির্ময় শ্যামবর্ণ শ্রীরাম নিত্য পুজো নিচ্ছেন তাঁর। রামাইত সাধু রামপূজন করেন, করেন সাধন-ভজন-আরাধন। শ্রীরামকৃষ্ণ দেখছেন। মন চাইলো, মায়ের স্নেহে রামলালাকে তিনি সেবা করেন। আগ্রহ দেখে সাধু রামলালার মন্ত্র দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ রামের অনুসারী হলেন। অবশেষে আবির্ভূত হলেন দশরথ-তনয় রঘুপতিরাম। সাধনায় হলেন সিদ্ধ। দিব্যলীলা দেখে সাধু শ্রীরামকৃষ্ণকেই দিয়ে গেলেন বিগ্রহ। এক উপযুক্ত উত্তরাধিকার। বাঙালিকে এইসব ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রামকে অবাঙালির দেবতা করে রাখলে যে মন্দির-মসজিদ বিতর্কের সুবিধা! বাংলায় আটকানো যায় রামরথ!

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.