কমিউনিস্ট কুৎসার হাত থেকে রেহাই নেই অমিতাভ বচ্চনেরও

প্রথমে একটা ছােট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। অমিতাভ বচ্চন করােনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এক শ্রেণীর মানুষের উল্লসিত অভিব্যক্তি দেখা গেল সােশ্যাল মিডিয়ায়। যার প্রধানতম একটা নমুনা হলাে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে করােনার বিরুদ্ধে জীবনপণ বাজি রেখে যাঁরা লড়ছিলেন, বিশেষ করে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী , তাঁদের মনােবল বাড়াতে ও সার্বিকভাবে করােনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারতের বার্তা দিতে কসর বাজিয়েছিলেন বলিউডের ওই প্রবীণ ও জনপ্রিয় অভিনেতা। এতে করে করােনায় আক্রান্ত হওয়ার দরুন তার দিকে ছুটে এল কটাক্ষের নিদারুণ সব বাণ। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট যে, এত কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে কী লাভ হলাে? পরবর্তী বক্তব্যে আসার আগে এই বিষয়টা স্পষ্ট করে নেওয়া যাক।।

প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে করােনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারতের বার্তা পৌঁছে দিতেই কাঁসর-ঘণ্টা বাজানাের কৌশল নিয়েছিলেন, আর কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। হরেককিসিমের বামপন্থীরা প্রত্যেকেই তাতে ‘হিন্দুত্বে’র গন্ধ পেয়েছিলেন, কারণ কাঁসর-ঘণ্টা বাজানাের প্রথা নাকি কেবলমাত্র দেব-দেবীর পুজোতেই দেখা যায়। কোনও সন্দেহ নেই কমিউনিস্টদের, বিশেষ করে ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটি প্রবল সিম্পটম হলাে হিন্দুত্বফোবিয়ায় ভােগা, সেই কারণে সব বিষয়ে হিন্দুত্বের ভূত তারা দেখে থাকেন। আরও একটা বিষয়, দেশভাগজনিত দাঙ্গার সময় মুসলমানরা যখন আজান বাজিয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলার সাংকেতিক নিদান দিত, তখন অনেক জায়গায় হিন্দুরা কাসর বাজিয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিত। যার ফলে ৪৬-৪৭-এর দাঙ্গায় যত হিন্দু প্রাণ হারিয়েছেন, সেদিন প্রতিরক্ষার এই ব্যবস্থাটুকু না নিলে দাঙ্গায় নিহত হিন্দুর প্রকৃত সংখ্যাটা আরও কতটা হতে পারত তা ভাবলেও ভয় করে। এই ‘আরও’হিন্দুকে কচুকাটা না করতে পারার দুঃখ মুসলমানদের থেকেও বােধহয়। হিন্দুনামধারী কমিউনিস্টদের প্রাণে আরও বেশি বেজেছিল এবং আজও বাজে। যে কারণে সেদিন হিন্দুদের প্রতিরক্ষার এই পদ্ধতিকেও তারা সম্পূর্ণ ভুল ও অপব্যাখ্যা। করে, প্রধানমন্ত্রীর কাঁসর-ঘণ্টা বাজানাের আহ্বানের সঙ্গে এক করে সােশ্যাল মিডিয়ায় মিলিয়ে দিতে তাদের বাধেনি এবং এর মাধ্যমে দাঙ্গা লাগানাের মরিয়া চেষ্টা তারা করেছিল। কয়েকমাস আগে ঘটে যাওয়া কাঁসর-ঘণ্টার এহেন বিতর্ক এবং সম্প্রতি অমিতাভ বচ্চনের করােনায় আক্রান্তের ঘটনায় তাকে আবার টেনে আনাকে পাশাপাশি রাখলে দুয়ে দুয়ে চার করতে কোনও সমস্যা হবে না।

অমিতাভ বচ্চন যতদূর জানি তিনি কংগ্রেসি ঘরানার লােক, একবার ভােটেও দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যা জনিত কংগ্রেসের পক্ষে প্রবল সহানুভূতি ভােট ও নিজস্ব ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে রেকর্ড ভােটে তিনি জেতেন এলাহাবাদ লােকসভা কেন্দ্র থেকে। তার স্ত্রী অভিনেত্রী জয়া বচ্চন সমাজবাদী পার্টির রাজ্যসভার চারবারের সাংসদ। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে বচ্চন-পরিবার বিজেপি মতাদর্শের বিরােধী। তবুও দেশের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার প্রয়ােজন অমিতাভ বচ্চন মনে করেছিলেন। কারণ নরেন্দ্র মােদী কোনও একটি দলের প্রধানমন্ত্রী নন বা ভারতীয় গণতন্ত্রে কোনও বিশেষ দলের প্রতিনিধিত্ব তিনি করছেন না; তিনি বিশ্বের দরবার সমগ্র দেশের তরফ থেকে প্রতিনিধি — এই সহজ-সরল তথ্যটা বচ্চনসাহেব বুঝতে পারলেও বামপন্থীরা অবুঝ। কেন অবুঝ, মতাদর্শের তাগিদে নাকি বিদেশি রাষ্ট্রের দালালির কারণে নাকি পেট্রোডলারে পুষ্ট হওয়ার জন্য, এইসব জটিল প্রশ্নের উত্তরে যাচ্ছি না; সময়ে ধর্মের কল ঠিক বাতাসে নড়বে। কিন্তু দেশ-বিরােধিতা আর বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর বিরােধিতা এক নয় বলে বাম্পন্থীদের তরফ থেকে মাঝেমধ্যে যে ঢক্কানিনাদ ওঠে সেটা আসলে তাদের নগ্ন দেশদ্রোহী রূপটা আড়াল করবার জন্য।।

আমরাও সহমত যে দেশ-বিরােধিতা ও বিজেপি বিরােধিতা দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু যখন কেউ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন তিনি আর বিশেষ দলের থাকেন না, তিনি সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, দেশের সংবিধান। ও গণতন্ত্রের কাছে তিনি দায়বদ্ধ।তার নীতির সমালােচনার অধিকার সবার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা” প্রবাদবাক্য মেনে তাঁর বিরােধিতা করাটাই হবে একমাত্র লক্ষ্য, তাতে দেশের স্বার্থ চুলাের দোরে যায় তাে যাক।। বহুবার বলেছি, আবারও বলি এই প্রবণতা নতুন নয়। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ নিয়ে ‘মতাদর্শগত’ আখ্যা দিয়ে বহু ঝড়, বহু ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে এগুলাে আসলে বৈদেশিক কমিউনিস্ট-তকমাধারী দেশের দালালি করতে, কখনও-বা স্রেফ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

আরও একটা বড়াে কারণ ছিল, সেটা হলাে হিন্দু-ফোবিয়া। হিন্দু-ফোবিক কমিউনিস্টদের এখন মূল টার্গেট যে শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় সেটা আগের সংখ্যাতেই লিখেছি, তাতে দেখানাের চেষ্টা হয়েছে কীভাবে হিন্দুফোবিয়া থেকে তারা বাঙ্গালি হিন্দুর পরিত্রাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কদর্য প্রচার চালিয়েছে। সােশ্যাল মিডিয়ায়। ভারত-কেশরীর অপরাধ তিনি ইসলামিক স্বাধীন বাংলাদেশ করতে না দিয়ে একক কৃতিত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ছক বানচাল করে দিয়েছিলেন। তাতে ব্রিটিশ প্রভুদের যত না গায়ে গেলেছিল তাদের ভৃত্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বুকে তা বেজেছিল শতগুণ। সেই একই হিন্দু-ফোবিয়া থেকে সােশ্যাল মিডিয়ায় তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিগৃহীত করছে। গােধরায় করসেবকদের নারকীয় হত্যা হিন্দুফোবিক কমিউনিস্টদের যার পর নাই আহ্লাদিত করেছিল। কিন্তু গােধরা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তারা বুঝেছিল এ ভীষণ কঠিন ঠাই। তাদের স্বাভাবিক মিত্র সােনিয়া গান্ধীর ‘মওত কা সওদাগর’ একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে, এ তাদের দুঃস্বপ্নেও ঠাই পায়নি। তাই যখন চিন্তাভাবনায় বিজেপির বিপরীত ঘরানার মানুষ হয়েও দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কেউ প্রয়ােজন মনে করেন তিনি যে কমিউনিস্টদের সফট টার্গেটে পরিণত হবেন সে তাে বলাই বাহুল্য।

কঁসর-ঘণ্টা বাজানাের ঘটনাটা তাে একটা সামান্য উদাহরণ মাত্র। ভারতের জাতীয় পশু বাঘ, জাতীয় পাখি ময়ূর দেখানাের পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চনকে দেশের জাতীয় কোভিড পেশেন্ট হিসেবে দেখানাে হয়েছে। একে নিছক ফেসবুকীয় মিম বা রসিকতা ভাবলে খুব ভুল হবে। এই ‘মিম’গুলির জন্মদাতারা জাতে আসলে কমিউনিস্ট। এই মিমগুলির লক্ষ্য প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে হয়তাে অমিতাভ বচ্চনকেই, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সেই নরেন্দ্র মােদী, হিন্দু-ফোবিয়া থেকে যার প্রতি কমিউনিস্ট বিদ্বেষের জন্ম। যিনি এই করােনাকালে বারবার কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, তাদের নােংরামির শিকার হয়েছেন। এই কমিউনিস্টদের পিতৃভূমি থেকে ‘বায়ােলজিক্যাল ওয়ে পন’ হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে এই মারণরােগ বিশ্বে ছড়াল। কেন্দ্রীয় সরকার শুধু নিজেদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে এই মারণ রােগ যাতে প্রতিরােধ করা যায় তার জন্য তৎপর হলাে। তার মধ্যে কমিউনিস্টদের পিতৃভূমি আবার তাদের জারিজুরি বিশ্বের দরবারে ফাস হচ্ছে দেখে তাদের স্বাভাবিক প্রকৃতিবশত গালােয়ানে ভারতের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া আরম্ভ করল। তখন দেশবাসীর করের টাকা ধ্বংস হচ্ছে বলে কমিউনিস্টরা দেশ বিরােধিতার নয়া নজির গড়ল। আপনি প্রতিবাদী হলে আপনাকে ‘চাড্ডী’, ‘সঙ্ী’, চাঁই কী ‘ভক্ত’বলে দেগে দেবে। অমিতাভ বচ্চন সেলিব্রিটি’ বলে তারটা নজরে পড়েছে। এমন কত লক্ষ লক্ষ নন-সেলিব্রিটি রয়েছে সেগুলাে নজরেও আসে না। কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মােদীকে একইভাবে উপলক্ষ্য করে প্রাক্তন ক্রিকেট-অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পেছনে সােশ্যাল মিডিয়ায় লেগেছিল। কমিউনিস্টরা। বাঙ্গালি’ বলে তাকেও কমিউনিস্ট মতাবলম্বী ‘পক্ষবাদী’রা রেয়াত করেনি। অমিতাভ বচ্চনের পক্ষে ওকালতি করাটা ‘স্বস্তিকা’র উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক কমিউনিস্ট দেশ-বিরােধী ট্রেন্ড বােঝাতে আমরা এই উদাহরণ টানতে বাধ্য হলাম।

সম্প্রতি জনৈক ব্যক্তি অমিতাভ বচ্চনের করােনায় মৃত্যু কামনা করেছেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা মতাদর্শগত ভাবে কমিউনিস্ট কি না জানা নেই। সম্ভবত নয়। কিন্তু কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিষবাষ্পটা তার মধ্যে প্রবেশ করেছে। যেটা সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে। বিষয়টা বুঝিয়ে বলি, মানুষের অসুস্থতার সময়ে তার মৃত্যু কামনার নােংরামি কমিউনিস্ট সংস্কৃতির পক্ষেই সম্ভব। পরিস্থিতির সুযােগ সন্ধানী কমিউনিস্টরা গত বছর এক প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুর পর, শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক পরিচয়ে বিজেপি হবার কারণে নগ্ন উল্লাসে মেতেছিল। ভারতের পূর্বতন প্রধান মন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রয়াত হবার পর মানুষ মারা গেলেই মহান হয়ে যায় না’ এই যুক্তি সাজিয়ে তার মৃত্যুর দিনেই তাঁকে আক্রমণ করেছিল কমিউনিস্টরা।

অমিতাভ বচ্চন যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তা অসহিষ্ণুতার পরিচয় সন্দেহ নেই। আমরা অমিতাভ বচ্চনের পক্ষে ওকালতিও করছি না। সে করার দায়ও নেই। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে মুখােশধারীদের চিনিয়ে দেওয়ার দরকার আছে। তাঁর মন্তব্যকে হাতিয়ার করে আগমার্কা ছােটো-মেজো-বড়াে সব সাইজের বিপ্লবীরা। মাঠে নেমে পড়েছেন অমিতাভ কতটা নীচ, কতটা অসংবেদনশীল তা বােঝাতে। কিন্তু বিপ্লবীরা এটা বুঝতে পারছে যে, অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যু কামনা কোনাে সুস্থ রুচির পর্যায়ে পড়ে না। অ্যারিস্টটল একটা কথা বলেছিলেন – মানুষ প্রকৃতিগত ভাবে রাজনৈতিক জীব। এদেশের কমিউনিস্টরা এই তত্ত্বকেই ব্যবহারিক ভাবে কাজে লাগিয়েছে। আমাদের এই ফাদটাকে বােঝা দরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর সমালােচনা করার মুখােশের। আড়ালে এদের দেশদ্রোহিতার যে বীজ লুকিয়ে আছে সেটা এখনাে না বুঝলে এরা দেশের আরও বড়াে ক্ষতি করে দেবে। ভারতবর্ষের মানুষের যে সাংস্কৃতিকমনন তাকে রাজনৈতিক করে না তুলতে পারলে কমিউনিস্টরা জানে তাদের কার্যসিদ্ধির আশা নেই। সেই ঘৃণ্য প্রচেষ্টা তাদের রাজনৈতিক প্রচেষ্টারই অঙ্গ, এটা বােঝা দরকার।

মনে রাখতে হবে, ১৯৬২-র মতাে এখন কমিউনিস্টরা একটি বা দুটি সংগঠিত কমিউনিস্ট-নামধারী গােষ্ঠীতে বিভক্ত নয়। রাজনৈতিক ধান্দায় ও দেশদ্রোহীমূলক সুবিধালিঙ্গায় একাধিক রাজনৈতিক ও আপাত-অরাজনৈতিক দলে তারা মুখােশের আড়ালে মিশে রয়েছে। অর্থাৎ তাদের চিহ্নিত। করার প্রক্রিয়াটা আর আগের মতাে সরল নয়। সুতরাং এই লড়াই জাতীয়তাবাদীদের জন্য কঠিনতর চ্যালেঞ্জ কোনও সন্দেহ নেই। কারণ লড়াইটা দলগত সেইসঙ্গে মতাদর্শেরও, যে মতাদর্শ দেশের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব এমনকী জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক।

অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.