রাজধর্ম — এই বহুল প্রচলিত শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু এই ধর্ম যাদের যথাযথ পালন করতে হয় তাদের অসহায়তা আমরা কেউ বাইরে থেকে বুঝে উঠতে পারিনা, যতক্ষণ না আমরা কেউ সেই অবস্থার মধ্যে পড়ি। শুধু রাজধর্ম কেন? কোনো কিছুই আমরা অনুভব করতে পারিনা যতক্ষণ না আমাদের সাথে বিষয়টি ঘটে। ছোটবেলায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত “মেঘনাদ বধ” কাব্য পড়ে তারপর থেকেই মনে অনেক প্রশ্নের মেঘ জমতে থাকে। তখন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের বদান্যতায় তৎকালীন বামপন্থী সরকারের চিরাচরিত উদ্দেশ্য বপনের চেষ্টার ফলস্বরূপ শ্রী রামচন্দ্র ও তার চরিত্র সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সহপাঠী থেকে কতিপয় শিক্ষক ও শিক্ষিকাগণের কাছ থেকে শোনা এক নিত্যঘটনা হয়ে উঠেছিল। তার কিছু বছর পরেই এলাহাবাদ যা বর্তমানে প্রয়াগরাজ, হাইকোর্ট যখন রামজন্মভূমি নিয়ে রায়দান করেন, তখনও একটা স্রোত উঠেছিল পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রকে বাঙালিদের থেকে দূরে রাখা। আধুনিক নারী ও নারীবাদীদের কাছে তাকে নারীর প্রতি অবিচারকারী এক রাজা রূপে তুলে ধরার চেষ্টা হল। তবুও এক অমোঘ আকর্ষণে দিদা, ঠাকুমা ও মায়েদের কাছে ভক্তি ভরে রামকথা, রামায়ন শুনতাম। কি আশ্চর্য ভক্তি আর শ্রদ্ধা তাঁদের ভগবান রামচন্দ্রের প্ৰতি! ওই প্রজন্মই শ্রীরামচন্দ্রের মানস-মূর্তিকে অন্তরে রক্ষা করেছিলেন। ঠাকুমা বলতেন আগে কারো বাড়িতে পুত্র সন্তান হলেই রাম সংক্রান্ত নাম রাখার ধুম লেগে যেতো, আর কন্যা সন্তান জন্মালে লক্ষ্মী বা সীতা সংক্রান্ত নাম। এসব শুনে অদ্ভুত লাগতো বেশ। প্রশ্ন আসতো, এরা কি নারী ও নারীবাদের বাইরে? নাকি এরা কিছুই জানেন না, অশিক্ষিত? কেন এরা নারীর প্রতি অবিচারকারী রাজাকে ভগবান মেনে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে রামায়ণ শোনাতেন? পরে একটু পড়াশুনা করে জেনেছিলাম, তাঁরাই প্ৰকৃত জ্ঞানী ছিলেন এবং অর্ধসত্য নয়, সম্পূর্ণ সত্য জানতেন। হয়তো তর্কের খাতিরে সেভাবে ব্যাখ্যা করতেন না।

প্রসঙ্গে আসা যাক, আগামী ৫ই আগষ্ট, ২০২০ — এই দিনটি রামমন্দির–ভূমিপূজনের দিন রূপে ঘোষণা হতেই চিরাচরিত ধারা অনুযায়ী শুরু হয়ে গেছে শ্রী রামচন্দ্রকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের ঝড়। তাতে এগিয়ে আছে অব্যশই নারীর প্রতি অবিচারের বিষয়টি। নানান মন্তব্য; এ যেন এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে রাম-বিরোধী শিবির, এক অদ্ভূত প্রোপাগান্ডার আয়েজন ভারতের সংস্কৃতি বিরোধী শিবিরের। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, ‘রাম কখনও আদর্শ পুরুষ হতে পারে না’, ‘রাম সীতার প্রতি অবিচার করেছে, যোগ্য মর্যাদা দেয় নি’, এবং ‘বাঙালির কাছে ভগবান রাম নয় রামমোহন হোক, যিনি স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা তে নয়, অগ্নিদহন থেকে রক্ষা করেছিলেন’। এই সময়ে এই ধরনের কথাগুলি সেকুলার, কমিউনিস্ট ও ছদ্ম নারীবাদীদের কাছে অমৃত সমান। অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্র কে ছোট করো, রামমোহন কে হিন্দু বিরোধী রূপে তুলে ধরো। একটি বাস্তব কথা হলো, অর্ধসত্য মিথ্যার থেকেও ভয়ংকর। আর ঠিক তাই ঘটে চলেছে। যারা এসব প্রচার করেন তারা রামায়ণ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখেন না। ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্বন্ধেও কোনো ধারণা নেই। নারী স-শক্তিকরণের বিরুদ্ধে আমরা কেউই নই, কিন্তু অব্যশই ছদ্ম-নারীবাদ ও তার অর্ধসত্য প্রচার আমাদের নির্মম আঘাত করেছে।

প্রথমে আসি হিন্দু বিরোধী রূপে রাজা রামমোহন রায়কে তুলে ধরার চেষ্টার বিষয় নিয়ে। তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ মহাপন্ডিত। তাঁর শাস্ত্র, দর্শন, সভ্যতা ও ইতিহাস বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা ও অধ্যয়ন ছিল। সতীদাহ প্রথা একটি বিকৃত রূপ বা যা কিনা যবনদের লালসা ও অত্যাচারের হাত থেকে নারী সম্ভ্রম রক্ষার্থে কোনো কোনও সময় স্বেচ্ছায় তাঁরা অগ্নিতে নিজেদের বিসর্জন দিতেন। আমরা বীরাঙ্গনা রাণী পদ্মিনীর জহরব্রত সম্পর্কে অবগত। কিভাবে লালসা ও যৌনখিদে মেটাতে হিন্দু নারীদের গ্রাস করত যবনরা, তা আমরা জানি। সেই নারী নিজ-সম্ভ্রম ও সতীত্ব রক্ষায় স্বেচ্ছায় অগ্নিতে বিসর্জন দিতেন নিজেদের। এই বিষয়টি যখন বিকৃত হয়ে বাধ্যতামূলক করে এর অপব্যবহার শুরু হল এবং তা চলতেই থাকল, তখন তার বিরুদ্ধে একজন প্ৰকৃত শাস্ত্রজ্ঞ প্রতিবাদ শুরু করলেন।

কিন্তু এর ফলে এটা কখনই প্রমাণ হয় না, তিনি হিন্দুদের বা হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করেছিলেন বা হিন্দু বিরোধী ছিলেন। এই বিকৃত কুপ্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি উচিত কাজই করেছিলেন। হিন্দুধর্মে বারবার সমাজে স্বপ্রচলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে সমাজ সংস্কারক হয়ে উঠে এসেছিলেন। এবং এটাই সবথেকে বড় গ্রহণযোগ্যতা হিন্দুধর্মের।
এবার আসি অগ্নিপরীক্ষার বিষয়টিতে আর তথাকথিত অবিচারের ঘটনায়। আজকাল খুব শুনছি, শ্রী রামচন্দ্র নাকি একজন আদর্শ পুরুষ নন। তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, কেমন পুরুষ চান আপনারা? ধরুন পাঁচ হাজার বছর আগে আপনি উত্তর ভারতে বাস করেন, সেখানে জঙ্গল থেকে আপনাকে কেউ হরণ করে নিয়ে গেল। আপনার স্বামী পায়ে হেঁটে দক্ষিণ ভারতের শেষে এসে এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিজের জীবন বাজি রেখে বানর সেনা নিয়ে বিদেশীদের সাথে যুদ্ধ করে আপনাকে উদ্ধার করে আনলো। নাকি, জঙ্গলে কোনো বন্যপ্রাণীর শিকার বলে চালিয়ে পুনরায় একজন মহিলাকে বিবাহ করে নিতেন। এই দুটো উপায়ই রামচন্দ্রের কাছে ছিল, তিনি তাঁর পত্নী সীতামাতাকে এতটাই ভালোবাসতেন যিনি কিনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সুতরাং একজন আদর্শ পুরুষ ও স্বামী হিসাবে তাঁর কর্তব্যে কোনো খামতি রাখেননি। জীবনভর তিনি কোনো দ্বিতীয় নারীকে কল্পনা পর্যন্ত করেন নি। পদ্মপুরাণে উল্লেখ আছে যে, রামায়ণে দুইজন সীতা ছিলেন। একজন প্ৰকৃত সীতামাতা এবং একজন মায়াসীতা। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসকালে সীতামাতাকে অগ্নিদেবের কাছে সুরক্ষিত রেখেছিলেন এবং তাঁর ছায়া স্বরূপা মায়াসীতামাতা কে প্রকট রেখেছিলেন। এটা কখনো ভুলবেন না যে শ্রী রামচন্দ্রের জন্মই হয়েছিল রাবণবধের উদ্দেশ্যে, তাই এমনটা যে হবে তা স্বয়ং বিষ্ণুদেবের মনুষ্যাবতার ভালো ভাবেই জানতেন। তাই লক্ষ্মী-স্বরূপা সীতামাতাকে তিনি কখনই রাবণকে হরণ করতে দেননি। তাই রাবণ বধের পরেই তিনি অগ্নিপরীক্ষার লীলা রচনাকরে অর্থাৎ এর আশ্রয়ে তিনি অগ্নিদেবের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন প্ৰকৃত সীতামাতাকে এবং অযোধ্যায় এসে রাজসিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। তার পরের ঘটনাবলী অর্থাৎ সীতার পাতালপ্রবেশ বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়া যায় না। আমরা যদি ধরেও নিই, এই ঘটনা গুলি ঘটেছিলো তাহলে বলা যায় একজন মানুষ তাঁকে আমরা মর্যাদা পুরুষোত্তম মানি কেন? কারণ তাঁর পত্নীর প্রতি তার অগাধ প্রেম, সম্মান, ফিরিয়ে আনার জন্য সবটুকু করা, পুত্র হিসাবে পিতা দশরথের আজ্ঞা বিনা প্রশ্নে মানা ও একজন রাজা হিসাবে রাজধর্ম পালনে কঠোর হওয়া — এ মর্যাদা পরুষোত্তম আদর্শ রাজার পরিচয় ছাড়া আর কি? একজন রাষ্ট্রপ্রেমী সৈনিক যখন কর্তব্যপালনে যান, তখন তার কাছে মুখ্য থাকে রাষ্ট্র, পরিবার থাকে গৌণ। তাই পিতৃবিয়োগেও মুখাগ্নি করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনই শ্রীরামচন্দ্র যখন রাজা, তার রাজ্যে গড়ে ওঠা অপবাদ ও বিশৃঙ্খলা, তাঁর প্রাণপ্রিয় সীতাকে অপমানে বাধ্য করেছিল রাজধর্ম পালনের মধ্যে। যুগের মূল্যবোধ বা ভ্যালু সিস্টেমে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন অসহায়, কারণ রাজসিংহাসনে রাজার কাছে রাজধর্মই হল প্রধান, তাতে পরিবার কিংবা স্বয়ং আপনি বলেও কিছু হয় না। কিন্তু আজকাল রাজরাজরা পরিবার বৎসল, অঢেল সম্পদ পরিবারের জন্য লুকিয়ে রাখেন, দুর্নীতি করেন। যাইহোক, রাজা হিসাবে রাজধর্ম পালন শ্রীরামচন্দ্রের কর্তব্য ছিল, তিনি সেটাই করেছেন। তাই সীতার পাতাল প্রবেশে সমাজের ঘৃণ্য-চিন্তা-ভাবনা ও নারীর প্ৰতি অবিচারের প্রশ্ন উঠেছিল, রামচন্দ্রের প্রতি নয়। কারণ তিনি ভরা রাজসভায় বারবার সীতা মাতাকেকে পবিত্র বলেছিলেন এবং মেনেও নিয়েছিলেন সর্বদা। কিন্তু প্রজা বৎসল রাজা, স্বামী হিসাবে হৃদয় ভেঙে চৌচির হলেও, রাজা হিসাবে বাধ্য হলেন কঠোর হতে। এটাই হলো রাজ ধর্মের কঠোরতা। এর ফলে কখনই মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কে নারীর প্রতি অবিচার কারী হিসাবে দেখানো যায় না। যদিও এই ঘটনা, অর্থাৎ পাতাল প্রবেশ বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়া যায়না। তাই আমাদের উচিত সম্পূর্ণ জেনে কাউকে কোনো অভিযোগ করা। রামের প্রতি তাদের মনোভাব আসলে অন্য একটি সম্প্রদায়কে খুশি করার চেষ্টা। শ্রীরামকে বিদায় করতে পারলে তাদের অশেষ উপঢৌকন পাওয়া যাবে, ভোটব্যাঙ্কই তাদের চালিকা শক্তি। সেই শক্তিতে প্রবল পরাক্রমে শ্রীরামের ইমেজকে কালিমালিপ্ত করতে তার উদ্যত

শ্রী রামচন্দ্র হিন্দু তথা মানব জাতির অস্মিতা, মর্যাদা, স্বাভিমানের এক আনন্দঘন আদর্শ। তিনি এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর ধর্মপালনে অবিচল ছিলেন। তাই তো আজও রাম রাজ্যের উদাহরণ দেওয়া হয়। তাই আসুন ভ্রান্ত ধারণা ঝেড়ে ফেলে, সীতামাতার প্রতি প্রাণপাতকারী, সীতাপতি রঘুনন্দন মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের জয়গান করি। তাঁর জন্মস্থানে মন্দিরনির্মাণ এক নতুন যুগের সূচনা করবে তা বলাই বাহুল্য। শ্রী রামচন্দ্র যেহেতু ভারত পিতা-স্বরূপ তাই প্রত্যেক ভারতীয় এই উৎসব পালন করি, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। আর সবাই জয়ধ্বনি করি – বোলো সিয়াবর রামচন্দ্র কি জয়। জয় শ্রী রাম।

রাজদীপ চ্যাটার্জী (Rajdeep Chatterjee)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.