ফ্রান্স থেকে দীর্ঘ আকাশ-পথ পেরিয়ে ভারতে চলে এল অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান রাফাল (Warplane raffle)। অবসান হল দীর্ঘ প্রতীক্ষার। গত সোমবার দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের বর্দোয় অবস্থিত মেরিনিয়াক বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার বুধবার দুপুরেই ভারতীয় আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান। ভারত আসার আগে আরব সাগরে মোতায়েন রণতরী আইএনএস কলকাতা-র সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে রাফাল। আইএনএস কলকাতা ডেল্টা ৬৩-র সঙ্গে রাফাল লিডারের কথোপকথন হয়। রেডিয়ো বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়, ‘‘ভারত মহাসাগরে আপনাদের স্বাগত। আপন গরিমায় আকাশ স্পর্শ করুন। অবতরণ নিরাপদ হোক। আবহাওয়া অনুকূল থাকুক।’’ জবাবে রাফালের তরফে বলা হয়, ‘‘আপনাদের জন্যও আবহাওয়া অনুকূল থাকুক। হ্যাপি হান্টিং। ওভার অ্যান্ড আউট।’’ তারপরই বিকেল তিনটে নাগাদ হরিয়ানার আম্বালায় ভারতীয় বায়ুসেনার ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান, স্পর্শ করে ভারতের মাটি।
আম্বালায় বায়ুসেনা ঘাঁটিতে পৌঁছনোর পর রাফাল যুদ্ধবিমান গুলিকে ‘ওয়াটার স্যালুট’ দেওয়া হয়। বায়ুসেনা সূত্রের খবর, বুধবারই সরকারিভাবে রাফালের অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে না। আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানগুলিকে ভারতীয় বায়ুসেনার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাশাপাশি দ্বিতীয় পর্বে আরও পাঁচটি বিমান অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ আসবে। তার পর ধাপে ধাপে মোট ৩৬টি যুদ্ধবিমান আসবে। ‘বিশেষ অতিথি’-দের আগমণকে ঘিরে বুধবার সকাল থেকেই অম্বালা বায়ুসেনা ঘাঁটি এবং সংলগ্ন এলাকায় উৎসাহ যথেষ্ট ছিল। রাফাল এসে পৌঁছনোর আগেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় অম্বালা বায়ুসেনা ঘাঁটিকে। বায়ুসেনা ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ড্রোন ওড়ানো, ছবি তোলা এবং ভিডিয়ো রেকর্ড করার উপরও নিষেধাজ্ঞা বসানো হয়। অম্বালা বায়ুসেনা ঘাঁটি সংলগ্ন ধুলকোট, বলদেব নগর, গরনালা এবং পঞ্জখোরা গ্রামেও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাদে উঠতে নিষেধ করা হয় গ্রামবাসীদের।২০০৭ সালে ইউপিএ সরকারের আমলেই ফ্রান্সের দাসোঁ এভিয়েশনের কাছ থেকে ১২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দাসোঁর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি হয় ভারতের। ঠিক হয় তাদের কাছ থেকে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা হবে। সেই বাবদ ৫৯ হাজার কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মোদী সরকারের সেই চুক্তি নিয়ে সরব হয় কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা। এমনকি, সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত লড়াই চলেছে। কিন্তু সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে ভারতে এসে পৌঁছল প্রতীক্ষিত রাফাল যুদ্ধবিমান।
জলে-স্থলে-আকাশে শত্রুর উপর হামলার ক্ষমতা
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, রাফাল হাতে পাওয়ার পর ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষমতা ও শক্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে। দুই ইঞ্জিনের মিডিয়াম মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট গোত্রের এই যুদ্ধবিমানে রয়েছে এমন সব অত্যাধুনিক ক্ষমতা ও প্রযুক্তি যাতে শত্রুপক্ষকে সহজেই টেক্কা দেওয়া যায়। নিশানায় যেমন নিখুঁত ও দ্রুত, তেমনই একসঙ্গে অনেকগুলি কাজ করতে পারবে।
রাফালের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২২২ কিলোমিটার
ফরাসি এই যুদ্ধবিমানের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২২২ কিলোমিটার। ৫০ হাজার ফিট পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। তবে স্বচ্ছন্দে উড়তে পারে মাটি থেকে ৩৭০০ কিলোমিটার উপরে। মাঝ আকাশেই জ্বালানি ভর্তি করার ব্যবস্থাও রয়েছে। যে কোনও আবহাওয়ায় সমান স্বচ্ছন্দ রাফাল যুদ্ধবিমান। যুদ্ধবিমানগুলির দৈর্ঘ্য ১৫.২৭ মিটার। প্রতিটি ডানার দৈর্ঘ্য ১০.৮ মিটার। সুখোইয়ের চেয়েও বেশি ওজন বহন করতে পারে রাফাল। সুখোইয়ের বহন ক্ষমতা ৮০০০ কিলোগ্রাম। রাফাল সেখানে ৯৫০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে সক্ষম।
রাফাল যুদ্ধবিমান পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম
রাফাল যুদ্ধবিমান পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। শুধু তাই নয়, প্রায় সব ধরনের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে উড়তে পারে এবং নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে। নেক্সট জেন প্রযুক্তির আকাশ থেকে আকাশ মাইকা, দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশ মেটিওর, দূরপাল্লার স্কাল্প, যুদ্ধজাহাজ বিধ্বংসী এএম ৩৯ এক্সোসেট-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে রাফাল যুদ্ধবিমান। স্কাল্প ক্ষেপণাস্ত্র স্থির লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। আর মাইকা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের অদৃশ্য বস্তুতেও হামলা চালানো যায়।
পদাতিক বাহিনীকে আকাশপথে সুরক্ষা দেওয়া অন্যতম সমরকৌশল
মাটিতে দু’পক্ষের যুদ্ধের সময় পদাতিক বাহিনীকে আকাশপথে সুরক্ষা দেওয়া অন্যতম সমরকৌশল। এতে এক দিকে যেমন সেনার মনোবল বাড়ে, তেমনই চাপমুক্ত হয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাতে পারে। সামরিক পরিভাষায় একে বলা হয় গ্রাউন্ড সাপোর্ট। দুই পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধের সময় মাটির কাছাকাছি এসে শত্রুপক্ষের উপর হামলা চালাতে যে রাফাল পারদর্শী, তার প্রমাণও মিলেছে ইতিমধ্যেই।
শত্রুপক্ষের রেডার জ্যাম করতে পারে রাফাল
শত্রুপক্ষের রেডার জ্যাম করতে পারে রাফাল যুদ্ধবিমান। জল, স্থল হোক বা আকাশ— তিন ক্ষেত্রেই শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করতে পারে এবং নিখুঁত নিশানায় আঘাত করতে পারে।