পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) এক অদ্ভুত রাজ্য। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় স্লোগান—’এগিয়ে বাংলা‘। পশ্চিমবঙ্গ যে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে, গোটা দেশের চেয়ে আলাদা ও অন্যরকম, এ ধারণার প্রতিষ্ঠায় সদা সচেষ্ট তিনি। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীও তাই নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান দিয়ে বা অর্ধসত্য তথা সম্পূর্ণ অসত্য প্রকাশ করে হলেও বিবৃতি দিয়ে থাকেন যে ‘বাংলা ফার্স্ট হয়েছে’। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা নিয়েও তার ব্যতিক্রম হয় নি। পশ্চিমবঙ্গ যে করোনা-সংক্রমণ অন্য সকল রাজ্যের চেয়ে ভালোভাবে ঠেকাতে পারছে, তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রথমে করোনা রুগীদের করোনা রুগী বলে স্বীকার করতেই চায় নি। ‘ডেথ কমিটি নামক আজব এক কমিটি গঠন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রথমদিকে বেশ কিছু করোনা রুগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোভিড ইনফেকশনকে দেখাতেই চায় নি। সেইসময় রুগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা ইত্যাদি কোনো কিছুর সরকারি হিসেবই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছিল রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রাতের গভীরে গোপনে মানুষের মৃতদেহ সৎকারের ভিডিও। পুলিশের গাড়িতে করে বিভিন্ন শ্মশানে দাহ করার জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল শবদেহ। ধাপায় দাহ কার্য চলছিল অনবরত। শহরের কবরস্থানগুলিতে দেখা যাচ্ছিল রেনকোট পরিহিত মানুষেরা কবর দিচ্ছেন মানুষের মৃতদেহ, কোনো জায়গায় আবার রাতভর চলছিল মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রক্রিয়া, অথচ সরকারি হিসেবের খাতায় করোনা রুগী অথবা মৃতের সংখ্যা তেমন বাড়ছিল না। এইসব ঘটনা আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল জনমানসে। প্রশ্ন উঠেছিল, তথ্য লুকোনোর মাধ্যমে আদতে কি আড়াল করতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার? শোনা যাচ্ছিল, মধ্য কলকাতার কিছু এলাকায় বাড়ির ভিতরে পড়ে রয়েছে করোনায় মৃত মানুষের সৎকার-না-হওয়া দেহ।

এমন আতঙ্কের পরিস্থিতির ফলশ্রুতি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ পরিদর্শনে আসে ইন্টার-মিনিস্টেরিয়াল সেন্ট্রাল টিম, যার পর ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে এগিয়ে থাকার চিত্র। IMCT‘র অফিসার অরূপ চন্দ্রের কাছ থেকে কড়া ‘চিঠি খেতে’ হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহাকে। সে চিঠিতে ওঠে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ এবং অবশ্যই কোভিড-তথ্য-তছরূপের অভিযোগ। IMCT’র দুই সপ্তাহ ব্যপী পশ্চিমবঙ্গ পরিদর্শনের প্রতিটি ধাপে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে IMCT’র সঙ্গে যে অসহযোগিতা করা হয়েছে এবং বাধা দেওয়া হয়েছে, চিঠিতে সে অভিযোগও দ্বর্থ্যহীন ভাষায় তোলেন IMCT‘র দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। প্রশ্ন উঠে যায়, এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও কি পশ্চিমবঙ্গের বরিষ্ঠ আমলাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে না কেন্দ্রীয় সরকার?

তারপর ঘটে চিত্রনাট্যের পরিবর্তন। IMCT‘র রিপোর্টের পর বদলে যায় পশ্চিমবঙ্গের কোভিড সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশনের ফর্ম্যাটটি। মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা সংবাদ মাধ্যমের সামনে বিবৃতি দেন তাড়াহুড়োয় কোভিড তথ্য পরিবেশন করতে গিয়ে সরকারের তরফ থেকে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়ে গিয়েছে। তাঁর এমত বিবৃতির পরেই দৈনিক সান্ধ্য কোভিড তথ্য পরিবেশনের সাংবাদিক সভার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। শুধু মুখ্যসচিব নন, ‘এগিয়ে বাংলা’র মুখ্যমন্ত্রীও ‘এগিয়ে’ এসে তড়িঘড়ি বিবৃতি দেন যে ‘ডেথ কমিটি‘ উনি বানান নি, কে বানিয়েছে তা-ও তিনি জানেন না। এমত বিবৃতির কিছুদিনের মধ্যেই অফিসিয়ালি বিলুপ্ত হয় ডেথ কমিটি। নতুন ফর্ম্যাটে সান্ধ্য দৈনিক কোভিড রিপোর্ট পরিবেশনের দায়িত্ব এসে পড়ে স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। কিন্তু নতুন কোভিড রিপোর্ট ফর্ম্যাট প্রথম প্রকাশিত হওয়ার দিনেই দেখা যায় নতুন ফর্ম্যাটেও প্রচুর ভুলভ্রান্তি ও অসাযুজ্য রয়েছে। নতুন ফর্ম্যাটের গাণিতিক ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করে সেইদিনই লিখেছিলাম ঋতম বাংলায় যেদিন কোভিড রিপোর্টের নতুন ফর্ম্যাট প্রথম প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তর থেকে। জনমানসে আবার দেখা দিতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের নতুন কোভিড রিপোর্ট ফর্ম্যাট নিয়েও নানা প্রশ্ন, রয়ে যায় নানা অমীমাংসিত ধন্ধ।

এর কিছু দিনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বোধ করি বুঝে গিয়েছিলেন যে তথ্য-তছরূপ এ রাজ্যে চলতেই থাকবে। ‘নেই-পরিকাঠামো’র পশ্চিমবঙ্গকে যদি জোর করে ‘এগিয়ে বাংলা’ মন্ত্রসিদ্ধ করে তুলতে চাওয়া হয়, তাহলে তথ্য-তছরূপ ছাড়া যে উপায় নেই, তা বুঝতে মানুষকে বেগ পেতে হয় না। IMCT‘র পরিদর্শনের আগে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। ১০ কোটি জনসংখ্যার রাজ্যে কোভিডের মত ড্রপলেট-বাহিত ভাইরাল সংক্রমণ যে আগুনের মত ছড়াতে পারে, তাকে থামাতে গেলে যে প্রথম থেকেই দ্রুত হারে কোভিড পরীক্ষা করে সংক্রামিত মানুষদের চিহ্নিত করে তাদেরকে কোয়ারান্টাইন করা প্রয়োজন, এবং তার জন্য যে রাজ্যে কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা প্রথম থেকেই খুব বেশি রাখা দরকার, ‘এগিয়ে বাংলা’ এসব বোঝার ব্যাপারে ‘পিছিয়ে’ ছিল। সে বিষয়টি নিয়েও রাজ্যকে কড়া বার্তা দেয় IMCT. IMCT‘র নির্দেশিকা পাওয়ার পর কিংবা তার কিঞ্চিৎ আগে থেকেই সে বিষয়টিতে গুরুত্ব সহকারে নজর দিয়েছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের তৎকালীন প্রধানসচিব বিবেক কুমার। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বাড়তে থাকে কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা ও সেইসঙ্গে রুগীর সংখ্যাও। কিন্তু এর পরেই বিবেক কুমারকে বদলি করে দেওয়া হয় পরিবেশ দপ্তরে। পশ্চিমবঙ্গে কোভিড রুগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বিবেক কুমারকে দায়ী করা হয়েছিল কি? নিন্দুকে বলছিল যে ‘এগিয়ে বাংলা’র মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন পরীক্ষা না করে রাজ্যে কোভিড রুগীর সংখ্যা কম রাখতে। পরীক্ষা না করলেই রোগ ও রুগী ধরা পড়ত না। কিন্তু বিবেক কুমারের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড টেস্টের ল্যাবরেটরির সংখ্যা একলাফে অনেকগুলি বেড়ে যাওয়ায় বৃদ্ধি পায় পরীক্ষার সংখ্যা এবং রুগীর সংখ্যাও। তার পরেই বদলি হয়ে যান বিবেক কুমার। IMCT‘র তরফ থেকে মন্তব্য করা হয় যে বিবেক কুমারের এই বদলি আদতে তাঁর ‘ভালো কাজের শাস্তি’। কোভিড সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে ব্যাপক কোয়ারান্টাইন ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসব ব্যবস্থা করে ‘পয়সা নষ্ট’ করতে বোধ করি চায় নি এ রাজ্যের লেজিসলেশন। সে টাকা কি তুলে রাখা হয়েছিল ‘এগিয়ে বাংলা’র ক্লাবের ছেলেদের আনন্দ উৎসবের জন্য?

মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে গোটা ভারতবর্ষ যখন কড়া ভাবে পালন করেছে লকডাউন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় তখন লকডাউনের নামে চলেছে ছেলেখেলা। মুখ্যমন্ত্রী চালু রেখেছিলেন ফুলের বাজার, মিষ্টির দোকান ইত্যাদি। লকডাউনের সময় খোলা বাজারগুলিতে লোকের থিকথিকে ভিড় এবং পুলিশের গা ছাড়া ভাব থেকেও বোঝা গিয়েছিল যে এ রাজ্যে লকডাউন লকডাউনের মত করে পালন করা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ যে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে, গোটা দেশের চেয়ে আলাদা ও অন্যরকম, লকডাউন লকডাউনের মত করে পালন না করেও তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করে নি ‘এগিয়ে বাংলা’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ‘পশ্চিমবঙ্গ বসে আছে একটি করোনা টাইমবোমার ওপর’—এমন একটি রিপোর্ট সানডেগার্ডিয়ানলাইভে বেরিয়েছিল এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন তাতে যথাযথ গুরুত্ব দেয় নি। অথচ এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে কোভিড পজিটিভ লোকেরা এবং তাদের বাড়ির লোকেরা হোম কোয়ারান্টাইনে থাকুন, কারণ লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রীর এমত মন্তব্যে প্রশ্ন উঠেছিল তবে কি পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোক কোভিড পজিটিভ? মুখ্যমন্ত্রীর এমত মন্তব্যের আদত তাৎপর্য বোঝা গিয়েছিল জুন মাসে ICMR এর সেরোলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্টের পরে।‌ ২৮ শে জুন ICMR’র সেরো-সার্ভে সূচকে শীর্ষে পাওয়া গেল কলকাতাকে। কোভিডের গোষ্ঠী সংক্রমণের মাত্রা বুঝতে এ রাজ্যে কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার এবং বাঁকুড়ায় রক্তে IgG অ্যান্টিবডির খোঁজে রক্তপরীক্ষা করেছিল ICMR. ছ’টি জেলার মধ্যে কলকাতায় ৩৯৬ জনের মধ্যে ৫৭ জনের শরীরে পাওয়া গিয়েছিল IgG অ্যান্টিবডি। এই হিসাবে কলকাতার ১৪.৩৯% মানুষের কোভিড ইনফেকশন হয়েছে বলে ধরা যায়। সেই হিসেবে, কলকাতার জনসংখ্যা যদি প্রায় দেড় কোটি হয়, তবে ICMR সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী শুধু শহর কলকাতায়ই করোনা পজ়িটিভের সংখ্যা জুন মাসের শেষে এসে হওয়া উচিত প্রায় একুশ লক্ষ। অর্থাৎ অনুমান করা শক্ত নয় যে এপ্রিলের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা আদতেই ছিল লক্ষ লক্ষ, জুনে এসে যার কিউমুলেটিভ সংখ্যা হয়ত দাঁড়িয়েছিল ২১ লক্ষে। অসাবধানতাবশতঃ ‘এগিয়ে’ মুখ্যমন্ত্রী হয়ত সেটিই বলে ফেলেছিলেন।

তারপর ২৯শে মে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যে লকডাউন বাস্তবতঃ তুলে দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের মানুষকে পরামর্শ দিলেন করোনাকে পাশবালিশের মত জড়িয়ে ধরতে। রাজনীতি-সচেতন মানুষ তাঁর এমত বক্তব্য শুনে অনুমান করেছিলেন যে রাজ্যে কোভিড সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করতে মুখ্যমন্ত্রী হয়ত আর চাইছেন না। পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন ধীরে ধীরে রাজ্যে ঢুকতে শুরু করেছেন, এবং তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড সংক্রমণ যখন অতি দ্রুত গতিতে বাড়বে বলে প্রত্যাশিতই ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই করোনাকে ‘পাশবালিশ’ করতে বলে মানুষকে কি সচেতনভাবেই বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ‘এগিয়ে’ থাকা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চান নি রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ফিরুন। পরিযায়ী শ্রমিক বহনকারী শ্রমিক-স্পেশাল ট্রেনগুলির নাম তিনি দিয়েছিলেন “করোনা এক্সপ্রেস”। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক (প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক কোটির কাছাকাছি) রাজ্যে এসে পৌঁছলে তাঁদের কোভিড টেস্ট, কোয়ারান্টাইন, চিকিৎসা ও খাদ্যদ্রব্যাদির ব্যবস্থা করার দায় নিতে রাজ্য অনিচ্ছুক ছিল বলে ভাবা অযৌক্তিক নয় কারণ পশ্চিমবঙ্গে এই সবকিছুর পরিকাঠামোর চূড়ান্ত অভাব রয়েছে। এই খাতে সরকারি অর্থব্যয়ের সদিচ্ছার অভাবও রয়েছে বলে সন্দেহ করা যায়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ দপ্তর রাজ্যের জনকল্যান প্রকল্পগুলির CAG প্রসেস অডিটে সহযোগিতা করে নি। সন্দেহ করার এটিই প্রধান ও ন্যায্য কারণ। সরকারি তহবিল তছরূপ না হয়ে থাকলে অর্থদপ্তর প্রসেস অডিটে অসহযোগিতা করে অডিট বানচাল করল কেন? মুখ্য প্রশ্ন এটিই। পশ্চিমবঙ্গে পরিকাঠামোর অভাবের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে যখন সংবাদমাধ্যম তুলে ধরেছে যে শ্রমিকদের কোয়ারান্টাইনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে এমনকি টয়লেটের মধ্যেও। এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ ভারতীয় রেলমন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে নেওয়ার বিষয়টি হয়ত পছন্দ হয় নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর। সেই জন্যই হয়ত বা কিঞ্চিৎ ক্ষোভের বশেই রাজ্যে লকডাউন সহসা তুলে দিয়ে মানুষকে আরও দ্রুত করোনা সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি এবং সেই কারণেই বোধ হয় পরামর্শ দিয়েছিলেন করোনার পাশবালিশ নেওয়ার।

এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বারংবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৪০,০০০ এরও বেশি কোভিড পরীক্ষার ফলাফল অপ্রকাশিত রেখেছিল মে মাসের শেষ দিকেই। অর্থাৎ যে সময়ে করোনাকে পাশবালিশ করতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই সময়েই সরকারি ল্যাবরেটরিগুলি থেকে অপ্রকাশিত ছিল ৪০,০০০ এরও বেশি কোভিড পরীক্ষার ফল। তাই বর্তমানে অপ্রকাশিত ফলের সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছে থাকতে পারে, তা নিয়ে জল্পনা চলতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গের অপ্রকাশিত কোভিড পরীক্ষার রিপোর্টগুলি যথাসময়ে প্রকাশিত হলে নতুন কোভিড কেস রেজিস্ট্রেশনে পশ্চিমবঙ্গ যে দিল্লিকে মে মাসেই টপকে যেত না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এমত গোলযোগের অভিযোগেই গত ১২ই জুন সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও তামিলনাড়ু, এই পাঁচটি রাজ্যের রাজ্য সরকারের চীফ সেক্রেটারিদের কাছ থেকে রাজ্যগুলির কোভিড পরিস্থিতি সংক্রান্ত রিপোর্ট তলব করেছিলেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিলেন যে উক্ত রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে রুগীর যত্ন কেমন হচ্ছে, হাসপাতালগুলিতে স্টাফসংখ্যা কত এবং অন্যান্য পরিকাঠামো কেমন ইত্যাদি বিষয়ে। সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলেছিলেন যে প্রতিটি রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ল্যাবগুলিতে যেন কোভিড পরীক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকে যাতে যে কোনো লোক চাইলেই কোভিড পরীক্ষা করাতে পারেন। অর্থাৎ অবাধ ও পর্যাপ্ত কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা রাজ্যগুলিতে রাখার ওপর জোর দিয়েছিলেন মহামান্য উচ্চতম আদালত।

এইসব কিছুর সম্মিলিত ফলশ্রুতিতেই মুখ্যমন্ত্রীর সেই ‘পাশবালিশ’ এখন ফেটে গিয়েছে। এমনভাবেই ফেটেছে যে গোটা ভারত যখন আনলক করছে, পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় তখন নতুন করে কড়া লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে প্রশাসন। গত ৭ই জুলাই পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় কন্টেন্টমেন্ট জোনগুলির সঙ্গে বাফার জোনগুলিকে মিলিয়ে নিয়ে সেই এলাকাগুলিতে কঠোর লকডাউনের নোটিফিকেশন জারি করেন। অথচ আদতে গোটা দেশ যখন কড়া নিয়মে লকডাউন করছিল, পশ্চিমবঙ্গের উচিত ছিল তখনই সংক্রমণের বিস্তারকে কনটেইন করা। রাজ্যে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, মাইল্ডলি সিম্পটোম্যাটিক রুগীর সংখ্যা এপ্রিল ও মে মাসের গোড়ার দিকে ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তাদেরকে তৎক্ষণাৎ কোয়ারান্টাইন করে কনটেইন করতে পারলে হয়ত জুলাই মাসে এসে ‘পাশবালিশ ফেটে যাওয়া’ ঠেকানো যেত এবং নতুন করে লকডাউনেও যেতে হত না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যে যথাসময়ে কোভিড ইনফেকশন কনটেইন করতে পারে নি, ২৮ শে জুন ICMR‘র সেরো-সার্ভের ফলাফল তার আর একটি পরোক্ষ প্রমাণ। এই ফলাফল অনুযায়ী শুধু শহর কলকাতায়ই করোনা পজ়িটিভের সংখ্যা হওয়া উচিত প্রায় একুশ লক্ষ। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা পশ্চিমবঙ্গেই কোভিড পজিটিভ রুগীর সংখ্যা মাত্র তিরিশ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কোভিডের আদত বাস্তব চিত্র আর সরকারি রেকর্ডের চিত্রে আকাশ পাতাল ফারাক বরাবরই ছিল ও আছে।

প্রশ্ন উঠে গিয়েছে যে কোভিড ইনফেকশন এতখানি অ্যাডভান্সড্ স্তরে পৌঁছে যাওয়ার পর জুলাই মাসে টানা লকডাউন কি আদৌ এ সমস্যার কোনো সমাধান? লকডাউন ইনফেকশন ছড়ানোর গতি কমাবে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে গোটা বিষয়টি কি আরও দীর্ঘায়িত হয়ে পড়বে না? আরও বহু দিন ধরে যদি পশ্চিমবঙ্গবাসীকে লকডাউনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বাজার, যা এমনিতেই ধুঁকছে, তা তাহলে কার্যতঃ অচল হয়ে পড়বে না কি? ‘এগিয়ে বাংলা’র অরাজকতা সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গবাসীকে শুধু প্রাণে নয়, ধনেপ্রাণে শেষ করে দেবে।

কোভিড ইনফেকশনের পশ্চিমবঙ্গে বোধ করি ঘনিয়ে উঠছে আরও দুর্নীতির মেঘ। যেমন, বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলিতে কোভিড পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি এবং হাসপাতালগুলিতে ভর্তি-প্রত্যাখ্যান-দুর্নীতি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলিকেও যেহেতু কোভিড পরীক্ষার অনুমতি দিতে হয়েছে, ফলে বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলির তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে হু হু করে বাড়ছে কোভিড রুগীর সংখ্যা। সরকারি ল্যাবরেটরিগুলির কোভিড পরীক্ষার ফলাফল পশ্চিমবঙ্গ সরকার অপ্রকাশিত রেখে দিতে পেরেছে এবং তার দ্বারা রাজ্যে কোভিড ইনফেকশনের বাস্তব চিত্র লুকোনোর চেষ্টা করতে পেরেছে। কিন্তু বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলির রিপোর্টের ওপর যেহেতু সরকারের সেই নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলি থেকে হু হু করে বাড়ছে কোভিড পজিটিভ রুগীর সংখ্যা আর তার দায় বর্তাচ্ছে সরকারের ওপর। প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে কোভিড ঠেকাতে সরকারি ব্যর্থতা। ফলে, সন্দেহ হয়, যে শাসক দলের তরফ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, বিশেষতঃ ওয়াটস্যাপের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে কিছু গোপন প্রচার যে বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলির কোভিড রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা কম। মেডিনোভা ডায়াগনস্টিকের একটি কোভিড রিপোর্ট সংক্রান্ত একটি প্রচার ওয়াটস্যাপের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। গোটা বিষয়টিতে রয়েছে দুর্নীতির গন্ধ। দুর্নীতি শাসক দল কিংবা বেসরকারি ল্যাবরেটরি, যে কোনো দিক থেকেই থাকতে পারে, অথবা থাকতে পারে দুই দিক থেকেই। রিপোর্ট কেমন হলে কোন্ পক্ষের কতখানি ‘লাভ’ হবে, তা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হতেই পারে ব্যবসায়িক বোঝাপড়া। কিন্তু দুর্নীতি যে দিক থেকেই থাকুক, মূল্য দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকেই। কেউ হারাবেন প্রাণ, কেউ দেবেন অর্থদণ্ড। একই সঙ্গে উঠে এসেছে কলকাতার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির দিক থেকে রুগী প্রত্যাখ্যানের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের চিত্র। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইছাপুরের ১৮ বছরের শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর দক্ষিণ বারাসাতের ২৬ বছরের অশোক রুইদাসের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলির সম্মিলিত এই ষড়যন্ত্র। হাসপাতালে পরিকাঠামোর অভাব, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব এবং অমানবিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন—তিনের ফলশ্রুতিতেই হয়ত শহর কলকাতার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির দিক থেকে নাগাড়ে চলেছে রুগী প্রত্যাখ্যান। জ্বর নিয়ে কেউ ভর্তি হতে গেলে পরীক্ষা না করেই হাসপাতালগুলি তাদেরকে চিহ্নিত করছে কোভিড রূগী হিসেবে এবং তারপর শুরু হচ্ছে রিলে-প্রত্যাখ্যানের পালা। এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতাল, অফিসিয়ালি সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করছে রুগী ভর্তি আর কেড়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রাণ। উপরোক্ত দুই যুবকের কেউই আদতে কোভিড আক্রান্ত ছিলেন না। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই একাধিক সরকারি হাসপাতাল তাঁদেরকে ভর্তি করে নি তাঁদেরকে কোভিড রুগী সন্দেহ করে। মরনাপন্ন দুই যুবককে নিয়ে তাদের মা বাবা হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরেও শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন শুভ্রজিতের মা। দুই ঘটনার সাদৃশ্য ও দুই ক্ষেত্রেই সরকারি হাসপাতালগুলির একইরকম অসংবেদনশীল আচরণ এই সন্দেহের জন্ম দিয়েছে যে সরকারি হাসপাতালগুলি এই ভর্তি-প্রত্যাখ্যান ষড়যন্ত্রটি করছে হয়ত বা সরকারের নীরব সম্মতিতেই যাতে রাজ্যের মানুষ হাসপাতালে যেতে ভয় পায়। এই ভয় সৃষ্টি করতে পারলে চাপ কিছু কমবে সরকারি হাসপাতালগুলির ওপর, সেই সঙ্গে হয়ত কমবে কোভিড রুগী ভর্তি হওয়ার ঘটনাও। তাতে পশ্চিমবঙ্গে রিপোর্টেড কোভিড রুগীর সংখ্যা কমবে, যা হয়ত মুখ্যমন্ত্রী চান। “করোনা-পাশবালিশ” ফেটে পশ্চিমবঙ্গে দ্রুতগতিতে কোভিড রুগীর সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্বকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করেছে। হাসপাতালের রুগী-ভর্তি-প্রত্যাখ্যান-ষড়যন্ত্র সেই ক্ষোভজনিত কারণে সাধারণ মানুষকে ‘শায়েস্তা’ করার উদ্দেশ্যে হওয়া অসম্ভব কি? রাজ্যের এত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলেই রেকর্ড খারাপ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের আর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকের। সেই ক্ষোভে হাসপাতালগুলির রুগী-ভর্তি-প্রত্যাখ্যান-ষড়যন্ত্র মানুষের ওপর শাসক দলের সন্ত্রাসের অপর এক পরিকল্পিত পদ্ধতি হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বলে সন্দেহ হয়। তবে যা-ই হোক্, দুর্নীতিতে ‘এগিয়ে বাংলা’র এই নৈরাজ্যের শিকার কেবলমাত্রই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.