২১শে জুলাই কলকাতা শহরে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক অভিজ্ঞ অধ্যাপকের। গত ১৬ই জুলাই তাঁকে আসতে হয়েছিল কলেজে, একটি বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য। তার ঠিক তিন দিন বাদেই চলে গেলেন তিনি। কিন্তু এমন মর্মান্তিক, ভয়াবহ খবরটি পেশ করে নি পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলি। সরকারের তরফ থেকেও এ নিয়ে আসে নি কোনো বিবৃতি। অধ্যাপকের মৃত্যুর সঙ্গে কোভিডের সংযোগের বিষয়টি চেপে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার প্র্যাকটিসটি পশ্চিমবঙ্গের ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সাংবাদিক বৈঠকে বিশেষ বিশেষ সাংবাদিককে কড়া তিরস্কারও করেছেন শাসকদল-বিরোধী খবর করার জন্য। এ হেন পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলি দিল্লির কোভিড পরিস্থিতি কতখানি শোচনীয় তা নিয়ে খবর করেছে। গত ২১শে জুলাই, ICMR প্রকাশ করেছে দিল্লীতে তাদের সেরোলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট। তাতে প্রকাশিত হয়েছে যে ২৩.৪৮% দিল্লীবাসীর শরীরেই রয়েছে কোভিড ভাইরাস প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি IgG. এর অর্থ হল, দিল্লীর কমপক্ষে ২৩.৪৮% মানুষ ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড ভাইরাসের দ্বারা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে গত ২৮ শে জুন কলকাতায় ICMR’র সেরো-সার্ভের ফলাফল অনুযায়ী কলকাতার প্রায় ২১ লক্ষ লোকের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল কোভিড-প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি আর জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে দিল্লীর ৪৭ লক্ষ মানুষের শরীরে তা পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং জুলাইয়ের এই সময়ে এসে কলকাতার আরও কতজন মানুষের শরীরে তৈরি হয়েছে IgG অ্যান্টিবডি, অর্থাৎ জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের এই সময়ের মধ্যে কলকাতার আরও কতজন মানুষ কোভিড সংক্রামিত হয়েছেন, সে তথ্য পাওয়া গেলে তুলনা করা যেত যে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী কোভিড সংক্রমণে কোন্ শহর এগিয়ে আছে। কলকাতা? নাকি দিল্লী (Delhi) ?
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে গত এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখের সাংবাদিক বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে কোভিড পজিটিভ লোকেরা এবং তাদের বাড়ির লোকেরা হোম কোয়ারান্টাইনে থাকুন, কারণ লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রীর এমত মন্তব্যে প্রশ্ন উঠেছিল তবে কি পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোক কোভিড পজিটিভ? মুখ্যমন্ত্রীর এমত মন্তব্যের আদত তাৎপর্য বোঝা গিয়েছিল জুন মাসে রাজ্যে ICMR এর সেরোলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্টের পরে। কোনো মানুষের দেহে কোভিড সংক্রমণ হলে সে মানুষটি যদি মারা না যান এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে তাঁর শরীরে কোভিড ভাইরাসের প্রতিরোধে গড়ে ওঠে একটি বিশেষ অ্যান্টিবডি যার নাম ইমিউনোগ্লোব্যুলিন জি বা আইজিজি (IgG)। অর্থাৎ রক্ত বা সিরামের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে কোনো ব্যক্তির শরীরে যদি পাওয়া যায় ঐ IgG অ্যান্টিবডি, তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ঐ ব্যক্তি কোভিড ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে কোভিডের গোষ্ঠী সংক্রমণের মাত্রা বুঝতে রক্ত বা সিরামের এই পরীক্ষাটিই এ রাজ্যে কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, আলিপুরদুয়ার এবং বাঁকুড়া ইত্যাদি ছ’টি জেলায় করেছিল ICMR. ২৮ শে জুন ICMR’র এ হেন সেরোলজিক্যাল সার্ভে সূচকের শীর্ষে পাওয়া গিয়েছিল কলকাতাকে। ছ’টি জেলার মধ্যে কলকাতায় ৩৯৬ জনের মধ্যে ৫৭ জনের শরীরে পাওয়া গিয়েছিল IgG অ্যান্টিবডি। সেরো-সার্ভের এই ফলাফলের বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য হল এই যে, কলকাতার ১৪.৩৯% মানুষই আদতে কোভিড ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন জুন মাসের মধ্যেই। কলকাতার জনসংখ্যা আনুমানিক প্রায় দেড় কোটি। ICMR সমীক্ষার উক্ত ফলাফল অনুযায়ী শুধু শহর কলকাতায়ই করোনা পজিটিভের সংখ্যা জুন মাসের শেষের দিকে ছিল তার ১৪.৩৯% অর্থাৎ প্রায় একুশ লক্ষ। এ থেকে অনুমান করা শক্ত নয় যে এপ্রিলের শেষের দিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে ‘লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, তাঁরা হোম কোয়ারান্টাইনে থাকুন’ তখন পশ্চিমবঙ্গে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা আদতেই ছিল লক্ষ লক্ষ, জুনে এসে যার কিউমুলেটিভ সংখ্যা হয়ত দাঁড়িয়েছিল ২১ লক্ষে, ICMR এর পরীক্ষায় যা ধরা পড়ে গিয়েছিল। ২৭ শে এপ্রিলের সাংবাদিক বৈঠকে উদ্বেগ ও চাপের মুখে অসাবধানতাবশতঃ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ দিয়ে সেই জন্যই হয়ত বেরিয়ে পড়েছিল সেই মন্তব্য—‘লক্ষ লক্ষ লোকের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়,…’
মানুষের শরীরে IgG অ্যান্টিবডির উপস্থিতি একদিক থেকে যেমন কোভিড ভাইরাস প্রতিরোধী, আর এক দিক থেকে তেমনই কোভিডের গোষ্ঠী সংক্রমণ নির্দেশক একটি সূচক। যে স্থানে যত বেশি লোকের দেহে এই অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবে, সেই স্থানের তত বেশি লোক আদতে ভাইরাসের কবলে পড়েছে। অর্থাৎ সেই স্থানের সরকারি ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক পরিকাঠামো ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার কমাতে তত বেশি ব্যর্থ হয়েছে। যাঁরা সংক্রামিত হয়েছেন তাঁদের অনেকেই হয়ত অ্যাসিম্পটোম্যাটিক রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা ভাইরাসের কবলে পড়েন নি। এ বিষয়ে আরও উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বারংবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মে মাসের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অপ্রকাশিত রেখেছিল ৪০,০০০ এরও বেশি কোভিড পরীক্ষার ফলাফল। ২৯শে মে’র সাংবাদিক সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মানুষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন “করোনাকে পাশবালিশ করা”র। আদতে সেই সময়েই সরকারি ল্যাবরেটরিগুলি থেকে অপ্রকাশিত ছিল ৪০,০০০ এরও বেশি কোভিড পরীক্ষার ফল। বর্তমানে এই অপ্রকাশিত ফলের সংখ্যা কোথায় গিয়ে পৌঁছে থাকতে পারে, তা জল্পনার বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের এই অপ্রকাশিত কোভিড পরীক্ষার রিপোর্টগুলি যথাসময়ে প্রকাশিত হলে নতুন কোভিড কেস রেজিস্ট্রেশনে পশ্চিমবঙ্গ যে দিল্লিকে মে মাসেই টপকে যেত না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় কি? সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কোভিড-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় কে অধিকতর ব্যর্থ হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সংখ্যাতত্ত্ব এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে সে বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতেই পারে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট। দিল্লিতে কোভিডের “বিষ্ফোরণ” ঘটার পর অরবিন্দ কেজরিওয়াল অন্ততঃ দিল্লির কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য নিতে অস্বীকার করেন নি যা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখনও করে চলেছেন। দুই মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের এমত পার্থক্য থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে দিল্লিবাসীর স্বার্থকে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছেন সে বিষয়টি নিশ্চিত। রাজ্যের সামগ্রিক জনস্বার্থকে রাজনৈতিক অহংকারের ঊর্ধ্বে রাখতে না পারাকে যদি রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে গণ্য করার পরিণতমনস্কতা জনসাধারণের থাকে, তবে সেই অর্থে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে কোভিড মোকাবিলায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)