বিশ্ববাসীর কাছে কম্যুনিস্ট বেজিং (Communist Beijing) ক্রমশ এক মূর্তিমান বিপদ হয়ে উঠছে। নোবেল করোনার মাধ্যমে এক জোরালো আঘাত পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বশক্তি কমিউনিস্ট বেজিংয়ের বিপদ উপলব্ধি করেনি। বেজিংয়ের ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার চুলচেরা বিশ্লেষণ দেখায় যে বিশ্বশক্তির বদান্যতায় তারা দীর্ঘদিন যেসব অন্যায় সুবিধা পেয়েছে এসব তারই ফল-
লাল চিন ১৯৫০-এ তিব্বত ও ১৯৬২- তে বিশ্বাসঘাতকতা করে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে। এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মনোভাব সত্ত্বেও লাল চিনকে বিশ্বশক্তি ভিটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন উপহার দেয়। প্রকৃত অর্থে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার না থাকাই যেন স্থায়ী সদস্যতার জন্য তার যোগ্যতা হয়ে যায়। এর ফলে চিন মানবতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক সমস্ত কুকীর্তির জন্য এক ধরনের ছাড়পত্র পেয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও গণতন্ত্রের দাবিতে তিয়ান মান স্কোয়ারের শ্বাসরোধকারী ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে চিনা কমিউনিস্টরা সুচতুরভাবে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি অনুসরণে বিদেশি ও বহুজাতিক সংস্থার জন্য নিজের দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সোভিয়েত এর মতো গণতন্ত্রের পথে হাঁটেনি। পাশ্চাত্য শক্তিগুলি এতদিন তাতেই খুশি ছিল। এই প্রেক্ষিতে নিচের আলোচনা দেখায় কীভাবে বেজিং চিনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি না থাকায় বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে আসছে।
(১) ভারত সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক শিল্পোন্নত দেশে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সামূহিক দরকষাকষির মাধ্যমে মজুরি নির্ধারিত হয়। এছাড়াও, সেখানে নির্বাচিত সরকারকে জনস্বার্থে ন্যূনতম মানবিক মজুরি নির্ধারণ করে দিতে হয় যাতে শ্রমিকরা শোষিত না হয়। কিন্তু চিনে শুধুমাত্র কমিউনিস্ট নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনকে তুষ্ট করে যে কেউ নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকদের অকথ্য শোষণের মাধ্যমে খুবই সস্তায় উৎপাদন করতে পারে।
(২) ওষুধ তৈরির ৭০% রাসায়নিক উপাদান বা এ পি আই চিন থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু কেন? এই কারখানা থেকে কম বেশি দূষণ ছড়ায়। গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বহু এন জি ও ( যার মধ্যে অনেকে ভারতবিরোধী চক্রান্তের অঙ্গরূপে ঘুরপথে চিনের অর্থে প্রতিপালিত) দূষণের অভিযোগে ন্যায়ালয়ের আদেশের মাধ্যমে ভারতের অধিকাংশ এ পি আই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বেজিং চিনে ওই কারখানার অনুমতি দিলে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে তা বন্ধ করাতে পারবে ? কারণ, বেজিং পরিবেশ দূষণ, জৈব-বৈচিত্র, জনস্বার্থ- কোনও কিছুকেই পাত্তা দেয় না।
(৩) ২০০৫- এ টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত রেশমি রোশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ” চিনে বিভিন্ন কসমেটিকস কোম্পানি ফাঁসিতে মৃত অপরাধীদের চামড়া ছাড়িয়ে তা থেকে সংগৃহীত এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে লিপস্টিক, কোলাজেন ইঞ্জেকশন ইত্যাদি বার্ধক্য নিরোধক পণ্য তৈরি করে। সেই সময় বিগত এক দশকের পরিসংখ্যান দেখায় যে চিনে প্রতিদিন গড়ে ৬২ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয় এ ধরনের নারকীয় কাজ মানবাধিকারের প্রতি চিনের অবজ্ঞা এবং চিন ব্যবসার পক্ষে ভালো বলে এই কুকীর্তির প্রতি পাশ্চাত্য জগতের গুরুত্ব না দেওয়ার নমুনা মাত্র। ” নাৎসিদের ইহুদী নিধনের মতো বর্তমানে চিনেও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে উইঘুর মুসলিমদের হত্যা করে তাদেরও ফাঁসিতে মৃত আসামীদের কিডনি, লিভার, চামড়া ইত্যাদি অঙ্গ দেশে বিদেশে বিক্রি করা হয়।
(৪) ভারত ও অন্য অনেক দেশের বাজার মূলত রোগীদের ব্যবহৃত ব্যান্ডেজ, তুলা, গজ এবং মহিলাদের ব্যবহৃত ন্যাপকিন দিয়ে তৈরি সস্তা চিনা মোল্ডেড খেলনায় ছেয়ে গেছে। এর ফলে ভারতে বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে ছোট ও কুটির খেলনা শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে।
উপরোক্ত সমস্ত নোংরা এবং অমানবিক কার্যকলাপ কমিউনিস্ট বেজিংয়ের সরকারি নীতি।কারণ, চিনে গণতন্ত্র, পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন, মানবাধিকার, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও বিচারব্যবস্থা, তথ্যের অধিকার ও দায়িত্বশীল বিরোধী পক্ষ কিছুই নেই। ফলে উৎপাদন সস্তা ও বেশি লাভজনক হওয়ায় অধিকাংশ বহুজাতিক ও বিদেশি সংস্থার কাছে নিজের দেশের তুলনায় লাল চিন বেশি প্রিয়। চিন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার না থাকাটা নিছকই তার অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার নয় বরং ক্রমবর্ধমান অনৈতিক আর্থিক শক্তির উৎস। অন্যদিকে ভারত বা অন্য দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক সরকারের পক্ষে এধরনের জঘন্য কাজের মাধ্যমে অন্যায় সুবিধা ভোগ করা সম্ভব নয়।
(৫) এসব জঘন্য ও অমানবিক ব্যবসায়ী কুকীর্তির মাধ্যমে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠা বেজিং বিশাল অস্ত্রভান্ডার গড়ে ভারতের মতো শান্তিকামী দেশকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করছে। প্রকৃত অর্থে চিনের অর্থনীতি শুধুমাত্র সেখানকার ৩৫ থেকে ৪০ কোটি মানুষের জন্য যারা মূলত কমিউনিস্ট নেতা, ক্যাডার, সক্রিয় সমর্থক, কমিউনিস্ট মাফিয়া, পুলিশ, আমলা, খোলা বাজার অর্থনীতির ফলে নতুন গজিয়ে ওঠা ছোট, মাঝারি, বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ী যারা স্বৈরাচারী কমিউনিস্ট শাসনে সব থেকে লাভবান ও তাদের আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি। অবশিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তারা নিপীড়িত, শোষিত। তাদের “কণ্ঠ রুদ্ধ, বাঁশি সংগীতহারা।”
তাই অধিকাংশ সাধারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু আধিপত্যবাদী লিপ্সা পূরণের জন্য চীন তার জাতীয় আয়ের একটা ভালো অংশ অস্ত্রভাণ্ডারের জন্য ব্যয় করতে পারে। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে মানুষের সার্বিক কল্যাণ জলাঞ্জলি দিয়ে তা করা সম্ভব নয়।
অর্থাৎ, বেজিংয়ের সমস্ত অন্যায় সুবিধার উৎস এই গণতন্ত্রহীনতা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিশ্বশান্তির গালে এর থেকেও জোরালো চড় আর কি হতে পারে ?
নিম্নোক্ত প্রক্রিয়ায় চিনের এসব অন্যায় সুবিধা বন্ধ করে তার বিশ্বত্রাস হয়ে ওঠা রোধ করা সম্ভব।
(ক) উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে স্বৈরাচারী চিনা কমিউনিস্টদের অগণতান্ত্রিক ও নির্মম মস্তিষ্কই ‘শয়তানের কারখানা’। তাই গণতন্ত্রহীনতা কমিউনিস্ট বেজিংয়ের ‘দুর্যোধনের উরু’ এবং সেটাকে যেভাবে হোক ভাঙতে হবে। ভারত সহ গণতান্ত্রিক বিশ্বকে কূটনীতি, বাণিজ্যিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির মাধ্যমে চিনকে একঘরে করে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই মর্মে চাপ দিতে হবে যে, যে সরকার নিজের দেশেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার হরণ করে সে কীভাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘ, নিরাপত্তা পরিষদ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, অলিম্পিক সংস্থার সদস্য হতে পারে? সেখানে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে বেজিংয়ের সঙ্গে কোনও বাণিজ্যিক-আর্থিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। যেমন ভারত চিন থেকে আমদানি বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারে (সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে)। একইভাবে অস্ট্রেলিয়া চিনে লৌহ আকরিক রফতানি বহুলাংশে কমিয়ে দিলে সেখানে ইস্পাত শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, লাভজনক ভাবে লৌহ আকরিক আমদানির ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার বিকল্প চিনের সামনে নেই। কিন্তু রফতানির জন্য অস্ট্রেলিয়ার সামনে চিনের অনেক বিকল্প আছে। যদি কমিউনিস্ট বেজিং গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে না হাঁটে তবে এই ন্যায্য কারণ দেখিয়ে তাকে ওই সব সংস্থা থেকে বাদ দিতে হবে। আশার কথা ব্রিটেন ইতিমধ্যেই ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে জি-৭ কে বর্ধিত করার প্রস্তাব রেখেছে।
যদি এই চাপ বজায় থাকে তবে চিনের শিল্প, ব্যবসা ও অর্থনীতি লাটে উঠবে, বহু মানুষ কাজ হারাবেন, বহু শিল্পপতি ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন এবং এর ফলে শুধু তিব্বত, হংকং, ঝান জিয়ান প্রদেশেই নয় সারা দেশের অবহেলিত, শোষিত মানুষ, অবহেলিত প্রাক্তন সেনা ও তাদের পরিবার, বাজার অর্থনীতির ফসল স্বাধীনচেতা শিল্পপতি- ব্যবসায়ী, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী যারা কফিনে শেষ পেরেক গাঁথার ক্ষমতা রাখেন, অবশ্যই গণতন্ত্রের দাবিতে বিদ্রোহ করবেন এবং সোভিয়েতের মতন চিনা কমিউনিস্টদেরও পতন হবে।
করোনা পরবর্তী বেজিং বিরোধী আবহকে কাজে লাগিয়ে ভারত যদি চিনা কমিউনিস্টদের আঘাত করতে না পারে, অন্তত “হাতে নয় ভাতেও মারতে না পারে ” তবে অদূর ভবিষ্যতে আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে চিন ভারতের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে এবং ভারতকে প্রতিমুহূর্তে নীচতা দেখাবে, ভারতের উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে। শুধু তাই নয় পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমন কি নেপালের মতো দেশের সরকারও চিনের বলে বলিয়ান হয়ে ভারতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সাহস দেখাবে। ইতিমধ্যেই নেপাল সরকার বাড়বাড়ন্ত শুরু করেছে। তাই চিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ভারতের জন্য অনেক দিক থেকে লাভজনক। এবং যুদ্ধ ছাড়া উদ্ধত বেজিংকে বাগে আনার এটাই সব থেকে ভালো উপায়।
(খ) নেহরুর পঞ্চশীল, জোট নিরপেক্ষতা ও অহিংস নীতিকে বিশ্বশক্তি নপুংসকতা মনে করে। যদি শান্তি, সৌহার্দ্য, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইত্যাদিকে বিশ্বশক্তি সামান্যতম গুরুত্ব দিত তবে চিনের পরিবর্তে ভারতই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হত। কিন্তু এখন অহিংসার স্বঘোষিত স্বত্ত্বধারী ভারত স্থায়ী সদস্যতার জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা চিনের জন্য আটকে আছে। এর থেকে বড় অপমান আর কি হতে পারে ?
প্রধানমন্ত্রী সদ্য লে – তে বলেছেন বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। তাই এখন ভারতের সামনে নিজেই নিজের ভাগ্য স্থীর করার সময় এসেছে। বিশ্বশক্তি, রাষ্ট্রসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদকে নীরব দর্শক রেখে চিনের তিব্বত দখলের মতো ভারত পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করলেই বিশ্বশক্তি উপলব্ধি করবে যে ভারতীয় বাঘ চিনা ড্রাগনকে প্রতিহত করতে পারে এবং তাকে বিশ্বশক্তি রূপে স্বীকৃতি দেবে।
(গ) গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষভাবে ভারতকে চিনের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের খিদে ” মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক” ও ” সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ” মাধ্যমে উসকে দিতে হবে। কারণ, সাধারণ চিনের হাজার হাজার বছর ধরে ভারতকে তাদের ‘সাংস্কৃতিক গুরু ‘ বা কমপক্ষে ‘বন্ধু’ মনে করে।
ভারতের গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বিশ্বকল্যাণে বিশ্বাসী ও চিনের স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্রী ও আধিপত্যবাদী – সম্পূর্ণ বিপরীতপন্থী দুই সরকারের মধ্যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। চিনে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তার মধ্যে ভারতের প্রতি সেই দেশের সাধারণ জনগণের প্রেম ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব অবশ্যই প্রতিফলিত হবে। দুই সরকার মানসিকভাবে কাছাকাছি হলে তাদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়বে, বৈরিতা কমবে যা বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়ো