চতুর্থ পর্ব
বর্তমান নদীয়ার উত্তরাংশে রাণাঘাট – মুর্শিদাবাদ -রেলপথের দেবগ্রাম স্টেশন হতে প্রায় অর্ধ মাইল দূরে এবং অগ্রদ্বীপ হতে তিন ক্রোশ উত্তরে দেবগ্রাম অবস্থিত।
বর্তমান দেবগ্রাম বাগড়ীবিভাগের মধ্যে পড়ে। এর আয়তন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ হাজার বিঘা। এই ভূভাগের উত্তরসীমা পাণিঘাটা ও গোবিন্দপুর , দক্ষিণে সাতবেগে, ভাগা, চাঁদপুর , বনপলাসী, পূর্ব্ব দিকে বরেয়া ও দিক্ববরেয়া , পূর্ব্ব দক্ষিণে জয়নগর, পশ্চিমে সেওড়াতলা ও হাটগাছা। উত্তর সীমার মধ্যে লুপ্ত গঙ্গার খাত পাগলাই চন্ডীর দহ বা পাণিঘাটার দহ , পাণিঘাটার দক্ষিণে ও দেবগ্রামের উত্তরপশ্চিম সীমায় দেবগ্রামের পাড়া পাথর জলা বা নূতনগ্রামের গড়। গ্রামবাসী প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাস যে, গোবিন্দপুর ও গড়ের পার্শ্ব দিয়ে অতীতে গঙ্গা প্রবাহিত হত। সেই গঙ্গার খাদের উপর বর্তমান মীরে গ্রাম। এইখানে শুকুইআরা , ডোখলঘাট, ধোবাঘাট প্রভৃতি স্থান আছে। দেবগ্রামের উত্তর ও পূর্ব্বে যেখানে গঙ্গার গর্ভে জল থাকে , সেই স্থান বর্তমানে দহ বা বিল নামে পরিচিত। শুষ্ক গঙ্গাগর্ভ বর্ষায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেবগ্রামের পূর্ব্বে , বর্তমানে দেবগ্রাম স্টেশনের পার্শ্বে দুর্গাপুর , তার পার্শ্বে গহড়াপোতা, এর মধ্যে নৌকাঘাটা বা #নাঘাটারমাঠ। এখানে বর্ষাকালে ৮ থেকে ১০ হাতের উপর জল চলে।
দেবগ্রাম অতি পূর্ব্বকাল হতে একটি মহাসমৃদ্ধশালী বলে পরিচিত ছিল। পূর্ব্বকালে যখন এর পার্শ্ব দিয়ে গঙ্গার স্রোত প্রবাহিত ছিল, তৎকালে বর্তমান সাঁওতার পূর্র্ব উত্তরে না ঘাটা বা নৌকাঘাটা নামক স্থানে বড় বড় বাণিজ্য পোত এসে লাগত। সাঁওতা ও তার নিকটবর্তী স্থানে সেই সুদূর অতীতে বহু মানুষের বাস ছিল। দক্ষিণে বিক্রমপুর ও উত্তরে মীরে গ্রাম। ভবিষ্য ব্রহ্মখণ্ডে দেবগ্রামের উল্লেখ না থাকলেও মীরে গ্রামের উল্লেখ আছে।
প্রসঙ্গত , এই প্রাচীন স্থানের পরিচয় পূর্ব্বে বড় একটা প্রকাশিত ছিল না। তবে এর প্রাচীনত্বের সন্ধান পেয়ে শ্রদ্ধেয় শ্ৰী নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় ঐস্থানে চারবার পরিভ্রমণ করেন। প্রথম দুবার অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী কৃষকদের নিকট এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বার গ্রামবাসী ভদ্র মোহদয়গণের নিকট স্থানীয় কিংবদন্তি শুনে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এবং পুরাকীর্তিগুলো দর্শন করেন। চতুর্থ বারে , ১৩ ই চৈত্র ১৩২১ বঙ্গাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ও পুরাতত্ত্বানুরাগী শ্ৰীযুক্ত রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় শ্ৰী নগেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে দেবগ্রাম ও বিক্রমপুর পরিদর্শনে যান। সেই সময় অনুসন্ধানের ফলে এবং শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় , শ্ৰীযুক্ত উমেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , শ্ৰীযুক্ত বিভূতিভূষণ মজুমদার প্রভৃতি প্রাচীন গ্রামবাসী ভদ্র মহোদয়েরগণের নিকট হতে যেরূপ কিংবদন্তি সংগৃহিত হয়েছিল ও তাঁরা যা প্রত্যক্ষ দর্শন করেছিলেন ছিলেন তাই নথিবদ্ধ করেছিলেন।
বর্তমান সাতবেগে পূর্ব্বে একটিই বেগে ছিল। পরে তা সাত ভাগ হয়। এই সাত বেগের নাম পূর্ব্ব হতে পশ্চিমে যথাক্রমে ১ চিনিমিনি বেগে, ২ স্থাপন বেগে, ৩ চক বেগে, ৪ গড়ের বেগে, ৫ আড়ার বেগে, ৬ খোরদ বেগে ও ৭ পালিত বেগে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল নগরীর মধ্যেই ছিল। এই অঞ্চলের এখনো বহু স্থানে স্থানে বহু প্রাচীন ইষ্টকাদির নিদর্শন ও বহু সংখ্যক সুপ্রাচীন মজা পুকুর দেখতে পাওয়া যেত একটা সময় পর্যন্ত। দেবগ্রামের সর্ব্বপ্রাচীন স্মৃতি সম্ভবতঃ মঞ্জুশ্রী মূর্তি।
শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই মূর্তিটিকে #মহারাজলীল_মঞ্জুশ্রী বলে নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতে বা বজ্রযানী বৌদ্ধ মতে মঞ্জুশ্রীর যেরূপ সাধন লিখিত আছে , তারসঙ্গে এর কোনো মিল নেই। তবে মূর্তিটি যে হাজার বছরের প্রাচীন তা অনুমান করা সম্ভব হয়েছিল। বর্তমানে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী রূপে ইনি কুলুইচন্ডী নামে পূজা পাচ্ছেন।
দেবগ্রামে যত পুষ্করিণী আছে , তার মধ্যে দেবকুন্ড সর্বাধিক প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ কুন্ড বলে বিবেচিত হয়। অতীতে প্রায় দেড় শত বিঘায় জল থাকত। তার পশ্চিমে ফুলবাগান এবং অপর তিন দিকে মানুষের বাসস্থান ছিল এবং মধ্যে মধ্যে দেবালয়ের অবস্থান ছিল ।এখন দেবকুণ্ডের অধিকাংশই ভরাট হয়ে গিয়েছে। যেটুকু জল আছে তা তিনটি পুষ্করিনী , চারটি জোল এবং দক্ষিণে একটি লম্বা জোলে বিভক্ত রয়েছে। উত্তরাংশ অধিকাংশই ভরাট হয়ে গিয়েছে এবং তার মধ্যে বহু অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে। পুরাতন ফুলবাগান এখন নামমাত্র, একটি পাড়া হয়ে গিয়েছে।
বর্তমান দেবকুন্ডু সংস্কারকালে কুণ্ডের মধ্যে থেকে নানাজন নানা দেব মূর্তি পেয়েছিলেন। তার কতগুলি দেবকুণ্ডের পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণ গৃহে অবস্থান করছেন। কতকগুলি স্থানান্তরে গিয়েছে। এই দেবকুণ্ড হতে কষ্টিপাথরের একটি অতি সুন্দর বাসুদেব মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। সেই মূর্তিটি দেবগ্রামভব স্বনামধন্য ডক্টর উমাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কলকাতায় নিয়ে এসে নিজ গৃহে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সাহিত্য সম্মেলনে সেই মূর্তি প্রদর্শন এবং তৎপরে সাহিত্য পরিষদের রক্ষা করবার জন্য অর্পণ করেছেন ।বর্তমানে সেই মূর্তি সাহিত্য পরিষদে আছে বলে জানতে পারা যায় । এই মূর্তির শিল্পনৈপুন্য এবং গঠন দেখলে ৬ ষ্ঠ বা ৭ ম্ শতকের বলে অনুমিত হয় ।
গ্রামের উত্তরাংশে লালদীঘি নামক একটি প্রাচীন পুষ্করিনী আছে। পূর্ব্বে এর নাম পচাদীঘি ছিল। ১২৮০ বঙ্গাব্দ বা ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই দীঘি সংস্কারের সময় ব্রাহ্মণী বা মহেশ্বরীর মূর্তি যুক্ত একখণ্ড প্রস্তর আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই মূর্তির বাহন বা লাঞ্ছনা চিন্হ অস্পষ্ট হওয়ায় এটি নির্ণয় করা হয় নি এটি মহেশ্বরী না ব্রাহ্মণী।
এছাড়াও একটি হস্তীর মস্তক এবং ইষ্টক স্তূপ প্রাপ্ত হয়েছিল। স্তূপ হতে এতই পুরাতন ইঁট উঠেছিল যে, তাতে অনুমান করা গিয়েছিল এই ইঁট কোনো প্রাচীন পাকা কোটা নিৰ্মাণের অংশ হয়েছিল। তাছাড়াও ঐরূপ দেবী মূর্তিশোভিত প্রস্তর ফলক কোনো মন্দিরের বহির্গাত্রে সংলগ্ন থাকে। এই মূর্তি তাই প্রমাণ করে যে মূল মন্দির কি বৃহৎ ছিল।
দেবগ্রামের উত্তর এবং দক্ষিণ পশ্চিমে এখনো সুপ্রাচীন গড়ের চিন্হকিছু বিদ্যমান। উভয়ের প্রায় দৈর্ঘ্যে ১ মাইল, প্রস্থে প্রায় ২০০ ফুট এবং উচ্চতা ৬ ফুট। কারণ বাকি অংশ জঙ্গলে পূর্ণ। এই গড়ের দুই দিকেই পরিখার চিন্হ রয়েছে। দক্ষিণপশ্চিমাংশের গড়টি #বেগের_গড় বা #গড়বেগে নামে পরিচিত। গাঁয়ের মধ্যে কিংবদন্তি আছে যে , এই গড়ে নাকি পাতালঘর আছে। সেখানে নাকি পূর্ব্ব নৃপতিদের গুপ্তধন রক্ষিত আছে।
দেবগ্রামের অবস্থান দেখে প্রাচীন লোকেরা মনে করেন যে এর দুই পার্শ্বে গড় ও দুই পার্শ্বে স্রোতস্বতী এই স্থানকে সুদৃঢ় করে রেখেছিল। এখন এই স্থান বাগড়ীর মধ্যে পড়লেও যে সময়ের এর পূর্ব্ব দিক দিয়ে গঙ্গা বহমান ছিল সেই সময় এই স্থানের কতকাংশ রাঢ় ও কতকাংশ বাগড়ীর সামিল ছিল। রামচরিতে তাই লেখা হয়েছে –
দেবগ্রাম প্রতিবদ্ধ – বসুধাচক্রবাল – বালবলভী তরঙ্গবহল গলহস্ত প্রশস্ত হস্ত বিক্রমঃ
রামচরিত টীকাকারের ভাষ্যেও ‘দেবগ্রাম প্রতিবদ্ধ’ ও ‘বালবলভী তরঙ্গ’, এই দুইটি শব্দ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর অর্থ করেছিলেন যে বিক্রমরাজ দেবগ্রামের রাজা ছিলেন এবং এর চারিপার্শ্ব বালবলভী দেশের নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তাঁর মতে বালবলভী প্রাচীন বাগড়ীর (মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা) নাম। শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক বলেন যে, বালবলভী একটি নদীর নাম এবং বিশাল তরঙ্গ-বহুল নদীদ্বারা বেষ্টিত থাকায় রাজধানী দেবগ্রাম সুরক্ষিত ছিল।
তবে রামচরিত হতে এই তথ্য প্রাপ্ত হয় যে , খ্রিস্টীয় ১১ শ ও ১২ শ শতকে দেবগ্রামে পালবংশ রাজত্ব করতেন এবং দেবগ্রাম একটি অতিপ্রসিদ্ধ স্থান বলে বিবেচিত হত।
বর্তমান দেবগ্রামের পূর্বভাগে গহড়াপোতার নিকট দমদমা। এখানে একটি উচ্চ স্তূপ বা ঢিবি আছে। স্থানীয় মানুষ ,সাবেক অধিবাসী মাত্রই কি ঢিবিকে #বল্লালসেনেরবাড়ি বা #বল্লালের_ভিটা বলে থাকেন । এই স্থানে এবং এর উত্তর পূর্ব্বে ছিল ভীষণ জঙ্গল। অনেক এখানে এসে মৃগয়া করতেন। অল্প দিন হল জঙ্গল পরিষ্কার হয়েছে। পার্শ্বেই সাঁওতা দীঘি। এর ওপর দিয়ে ডিস্ট্রিক্টবোর্ডের যত্নে বহরমপুর রোড হবার পূর্ব্বে বল্লাল সেনের ঢিবি ও সাঁওতা দীঘি পাশাপাশি ছিল । এজন্য প্রাচীন লোকেরা ওই দীঘিকে বল্লাল সেনের অন্তঃপুরস্থ দীঘি বলেই মনে করেন।
দেবগ্রাম ও বিক্রমপুরের অনেক বনিয়াদী মানুষই এই দীঘিকে #বল্লাল দীঘি বলে অভিহিত করেন বলে শোনা গিয়েছে। এই সাঁওতা হতে দুটি প্রাচীন জাঙ্গাল বা রাস্তা বাহির হয়ে একটি পশ্চিমদিক দিয়ে বরাবর ভাগা , চাঁদপুর, বরগাছী হয়ে বিক্রমপুরের জিতের মাঠ দিয়ে যথাক্রমে ভবানীপুর, সুখপুকুর , রাজাপুর হয়ে বিল্ব গ্রামের দক্ষিণ দিয়ে নবদ্বীপের অভিমুখে চলে গিয়েছে ।অপর জাঙ্গাল বা রাস্তা পূর্ব্ব দিক দিয়ে চাঁদপুর কালীনগর, ধুবি ও সেনপুর হয়ে ঘুনীর দক্ষিণ ও মালুম গাছার পার্শ্ব দিয়ে গবীপুর পর্যন্ত গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। গবীপুরে প্রাচীন লোকেরা বলে থাকেন ওই জাঙ্গাল পূর্ব্বে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । কিন্তু জনবসতি বৃদ্ধির কৃপায় সে সমস্ত লুপ্ত হয়েছে।
উক্ত উভয় জাঙ্গালই #রাজারজাঙ্গাল বা #বল্লালসেনেরজাঙ্গাল নামে স্থানীয় অধিবাসীগণের নিকট সুপরিচিত ছিল। সেই রাজার জাঙ্গাল বা বল্লাল সেনের জাঙ্গালের ধারে ধারে তিন থেকে চার ক্রোশ অন্তর বড় বড় পুরনো পুষ্করিণী দেখা যায়। তন্মধ্যে সাঁওতা, ভাগা , বড়গাছী, বিক্রমপুর, ভবানীপুর রাজাপুর, নবদ্বীপের অপর পারস্থ পুষ্করিণী প্রসিদ্ধ। ভবানীপুর ও নবদ্বীপের পুষ্করিণী গুলি আজও বল্লালের দিঘী নামে পরিচিত। আজও কেউ কেউ এসব স্থানের মজাপুকুর গুলোকে বল্লালসেনের নামের অপভ্রংশ #বললামসেনেরকীর্তি বলে মনে করে থাকেন।
পূর্ব্বে এই স্থান বর্দ্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অধীন ছিল। বহু বছর আগে কাটোয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঁঈশ্বরচন্দ্র মিত্র মহাশয়
কার্যাগতিকে একবার দেবগ্রামে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন। সে সময় তিনি স্থানীয় জমিদার ঁবামনদাস মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সাহায্যে বল্লালসেনের ভিটা খনন করেছিলেন। দেবগ্রামের প্রাচীন লোকেরা বলে থাকেন খনন কালে ওই স্তূপ থেকে নানা কাটা পাথর, ভগ্ন পাথরের মূর্তি , ভাস্কর কার্য যুক্ত পাথরের চৌকাঠ, পদ্ম ও নরনারী মূর্তি যুক্ত পাথর, ৪ /৫ হাত প্রস্থের লিপি যুক্ত পাথর, পাথরের মকর মুখ পয়ঃ প্রণালী , দৈর্ঘ্যে তিন হাত এবং প্রস্থে দুই হাত লিপি যুক্ত একখন্ড প্রস্তর ফলক , এবং কটি হতে জানু পর্যন্ত মালকোচা করে কাপড় পরা মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল।
ঁঈশ্বরচন্দ্র মিত্র মহাশয় লিপি যুক্ত প্রস্তর ফলক ও কতকগুলি ভাঙ্গা মূর্তি মিউজিয়ামে পাঠাবার জন্য কাটোয়া নিয়ে যান । বামনদাস মহাশয় অনেক পাথর তার একডালার কাছারীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় এখানকার মডেল স্কুলের শিক্ষক ঁঁদীননাথ ন্যায়ালঙ্কার মহাশয় তাঁর স্বগ্রাম সালুগাঁ দোগাছিয়া গ্রামে এখান থেকে কয়েকটি মূর্তি এবং মকরমুখ পয়ঃপ্রণালীটি নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাকি পাথর খন্ড গুলি গ্রাম বাসীরা স্ব সেবা গৃহে নিয়ে গিয়ে আপন আওয়ান কাজে ব্যবহার করছেন। তবে সেই মালকোঁচা কাপড় পরা ভগ্ন মূর্তিটি বহুদিন কুলাইচন্ডী তলায় পড়েছিল। লোকে একে #বল্লালসেনেরবুক বা #বল্লালসেনেরধড় বলতেন। অনেকেই চন্ডী তলায় এসে সেই মূর্তি তুল স্ব স্ব শক্তি পরীক্ষা করতেন। যা হোক , পরে সেটি বৈরামপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ধড়টির এখন কি অবস্থা আমার জানা নেই।
এখনো যদি বল্লাল সেনের ভিটা ভালো করে খনন করা হয় তবে বঙ্গের এক প্রাচীন ইতিহাস আবিষ্কৃত হবে। যখন বহরমপুর রোড নিৰ্মাণ হয় নি তখন এই ভিটার ধ্বংসাবশেষ সাঁওতা দীঘির উত্তর পাড় হতে সূচিত হয়ে বরাবর অর্ধ মাইল বিস্তৃত ছিল। এখনো এসব স্থান খনন করলে বহু বহু প্রাচীন ইঁট প্রাপ্তি ঘটে বা ঘটবে । পূর্ব্বে সাঁওতা দীঘি ছিল ৪০ বিঘা। তার উপর দিয়ে গিয়েছে বহরমপুর রোড।
বল্লালসেনের ভিটার ডাঙ্গা পাড়ার পশ্চিমাংশে যে পুরাতন পুষ্করিণী আছে , তাকে লোকে এখন ফলুপুকুর বলে।তার উত্তর পার্শ্বে দেবগ্রাম বয়োবৃদ্ধগণ বেশ বেশ কিছু বছর আগেও চারি হাত মোটা চৌক থামের গোড়া দেখতে পেতেন। এখন হয়ত চাপা পড়েছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে।
দেব গ্রামের প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাস সাঁওতার উচ্চ ভূমিতে একসময় বহু মানুষের বাস ছিল। পরে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বৈদেশিক আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য সেই স্থান ত্যাগ করে দেবকুণ্ডের তীরে বসতি গড়ে তোলেন।
প্রসঙ্গত উত্তরের দেবগ্রাম ও দক্ষিণের দেবগ্রাম এক নয়। শ্রদ্ধেয় শ্ৰী নগেন্দ্রনাথ বসুর সেকথা তাঁর রচনায় পরিষ্কার করে বলেছেন। কেউ কেউ দেবগ্রামকে দেবলরাজার রাজধানী , গড় এবং প্রত্ন দ্রব্য সমূহকে দেবল রাজার বস্তু বলে মনে করেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় শ্ৰী নগেন্দ্রনাথ বসু বিশেষ অনুসন্ধানে জেনেছিলেন এই স্থানের সঙ্গে দেবলরাজার কোনো সম্পর্ক নেই। নদীয়া জেলার মধ্যে বতর্মান রাণাঘাট- বনগ্রাম লাইনে গাংনাপুর স্টেশন হতে প্রায় ১ ক্রোশ দূরে আরো একটি প্রাচীন দেবগ্রাম বা দেবগ্রামের গড় আছে। সেই গাঁয়ের যেসব ধ্বংসাবশেষগুলি প্রাপ্ত হয় তা এই গাঁ ও পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের মানুষজন #দেবলরাজারগড় বা #দেপালরাজার_রাজধানী বলে জানেন।
সম্ভবত নদীয়ার এই দক্ষিণাংশস্থিত দেবগ্রামের নানা প্রবাদাদি নদীয়ার উত্তরাংশস্থিত দেবগ্রামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। বাস্তবিক নদীয়ার দক্ষিণের দেবগ্রাম উত্তরের দেবগ্রাম অপেক্ষা অধিক প্রাচীন বলেই ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকগণের অনুমান হয়।
রাঢ়ীয় এবং বঙ্গ সমাজে দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণদের কুলগ্রন্থে এই স্থান একটি প্রধান সমাজ বলে গণ্য হয়েছে। এখন অবশ্য এই দেগাঁ বা দেবগ্রামে ৩/৪ ঘর মাত্র তেমন প্রাচীন লোকের বাস। সেইসব প্রাচীন মানুষদের থেকে জানা যায় যে বেশ কিছু সময় পূর্ব্বেও এখানে ৫০/৬০ ঘর ব্রাহ্মণদের বাস ছিল।
খ্রিস্টীয় ১০ ম শতাব্দীতে গুরবমিশ্রের গরুড়স্তম্ভলিপিতে বর্ণিত হয়েছে –
দেবগ্রামভবা ধন্যা দেবীসু তুল্যবলয়ালোকসন্দীপিতরূপা।
দেবকীব তন্মাদগোপালপ্রিয়কারকমসূত পুরুষোত্তম।।
এই শিলালিপি প্রমাণেও আমরা বলতে পারি যে, খ্রিস্টীয় ১০ ম শতাব্দীর পূর্ব্ব হতেই দেবগ্রাম প্রসিদ্ধ ছিল। এই স্থানে গৌড়েশ্বর নারায়ণপালের প্রধানমন্ত্রী গুরবমিশ্রের মাতুলালয় ছিল বলে ছিল বলে তাঁর প্রশস্তিকার সগৌরবে এই দেবগ্রামের উল্লেখ করেছেন।
নদীয়ার দক্ষিণের দেবগ্রামের প্রাচীনতা ও প্রসিদ্ধি অবগত হয়ে অনেকেই একে রামচরিতোক্ত দেবগ্রাম বলে ধরে নেন। কিন্তু এই দেবগ্রাম বলবলভী বা বাগড়ী ভূভাগের অন্তর্গত নয়। তাই অনুমান এই দক্ষিণের দেবগ্রাম রামচরিতের দেবগ্রাম নয়। ফলত, রামচরিতের দেবগ্রাম পলাশীর দক্ষিণে অবস্থিত বাগড়ীর অন্তর্গত প্রবন্ধে আলোচ্য নদীয়ার উত্তরের দেবগ্রাম এবং নদীয়ার দক্ষিণেরটি হল দেবল রাজার গড়।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১) বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি
২) বর্দ্ধমানের কথা : বর্দ্ধমানের পুরাকথা ও বর্তমান বর্দ্ধমান