বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস শুরু হয় মাত্র সতেরো অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজির বিশাল গৌড় রাজ্য অধিকারের এক অসম্ভব গল্প দিয়ে। পরবর্তী সাড়ে পাঁচশ বছরের যে ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়, তা মূলতঃ সুলতানি শাসন, মুঘল আমলের সুবেদারি আর নবাবির কাহিনী। সে ইতিহাস থেকে এমনটাই প্রতীত হয় যে, বাংলার ভূমিপুত্ররা সম্পূর্ণ মধ্যযুগ ধরে কৃষিজীবী অথবা মসীজীবীর বৃত্তি অবলম্বন ক’রে, শাসিত ও শোষিত হয়ে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করে গেছেন। রত্নগর্ভা বঙ্গভূমির যেসব কীর্তিমান সন্তানগণ মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিজেদের ছাপ রেখেছিলেন, তাঁরাও খিলজি, হুসেন শাহ, আলিবর্দি বা সিরাজের ছায়ায় চাপা পড়ে বিস্মৃত থেকে গেছেন। বাংলার মধ্যযুগের ঘনঘটাময় আকাশে রাজা সীতারাম রায় এমনই এক অলক্ষিত, অনুদযাপিত জ্যোতিষ্ক, যার হাত ধরে মুঘল শাসিত বাংলায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এক স্বাধীন সার্বভৌম হিন্দুরাজ্য। তাঁর স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরগাথা বাংলার প্রচলিত পরানুবাদী, পরানুকরণপ্রিয় ইতিহাসের অধ্যায়ভুক্ত হয়নি। এই প্রবন্ধ সেই যুগের পৃষ্ঠভূমিতে বীর সীতারামের জীবনবৃত্তে বাংলার ভূমিপুত্রদের পূর্বগৌরব স্মরণ করার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস।
১৬৫৮ সাল। মুঘল শাসনাধীন ভারতের রাজনৈতিক পট খুব দ্রুত রং বদলাচ্ছে। মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণ যুগের স্থপতি সম্রাট শাহজাহান ত্রিশ বছরের রাজত্ব পূর্ণ করে পুত্রের হাতে বন্দী হচ্ছেন আগ্রায়, দিল্লীর ময়ুর সিংহাসনে বসছেন ঔরংজেব। শাহজাহানের এই তৃতীয় পুত্রের মুঘল ‘তখৎ-এ-তাউস’ অবধি পৌছনোর অভিযানে তার হাতে নিহত হয়েছেন জ্যেষ্ঠ অগ্রজ দারা শিকো। সিংহাসনের আরেক দাবীদার শাহ সুজা তখন দিল্লী থেকে দূরে, সুবে বাংলার সুবেদার এর দায়িত্ব নিয়ে বাংলার তখনকার রাজধানী রাজমহলে। সেখানেই কর্মরত আছেন উত্তর রাঢ়ী কায়স্থ বংশজ দক্ষ রাজকর্মচারী উদয়নারায়ণ রায়। তাঁর পৈতৃক আবাস অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার গিধনা গ্রামে। উদয়নারায়ণের স্ত্রী দয়াময়ীর গর্ভে ভূমিষ্ঠ হল তাদের প্রথম সন্তান সীতারাম।
এদিকে দিল্লিতে নিজের আসন নিষ্কন্টক করতে ঔরঙ্গজেবের তৎপরতায় কমতি ছিল না। তারই পদক্ষেপ হিসেবে সুবে বাংলার দায়িত্ব হারালেন শাহ সুজা। নতুন সুবেদার নিযুক্ত হলেন মীর জুমলা। ১৬৫৯-এর খাজুয়ার যুদ্ধে মীর জুমলার কাছে পরাজিত হল শাহ সুজার বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে শাহ সুজা গেলেন বর্মার পথে, আর প্রশাসনে শাহ সুজার প্রভাব নির্মূল করতে মীর জুমলা সুবে বাংলার রাজধানী তুলে নিয়ে এলেন ঢাকায়। উদয়নারায়ণকেও আসতে হল নতুন রাজধানীতে। এই অশান্ত রাজনৈতিক অভিঘাত থেকে দূরে রাখতে উদয়নারায়ণ তার পরিবারকে সঙ্গে রাখেননি। তাই সীতারামের শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে মামার বাড়ী কাটোয়ায়। তাঁর মাতৃকুল সম্পন্ন কায়স্থ বংশীয়। সেখানেই সীতারাম আয়ত্ত করলেন সংস্কৃত, ফারসি ও বাংলা ভাষা। সঙ্গে চলতে থাকল অস্ত্রচালনা ও অশ্বারোহণের পাঠ। তীক্ষ্ণ প্রশাসনিক প্রজ্ঞা ছিল তাঁর বংশানুক্রমে প্রাপ্ত সহজাত গুণ। কৈশোরে পা দিতে না দিতেই সীতারাম হয়ে উঠলেন এক কুশল যোদ্ধা।
১৬৬৩ সাল। পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে শিবাজীর নেতৃত্বে নক্ষত্রবেগে উত্থান হচ্ছিল মারাঠা শক্তির। শিবাজী আর তার বাহিনীকে দমন করবার ভার পড়ল ঔরংজেবের মামা দাক্ষিণাত্যের সুবেদার শায়েস্তা খাঁর উপর। পুণের লালমহল দুর্গে শিবাজীর অতর্কিত আক্রমণে মারা পড়ল তার প্রিয়পুত্র। খোদার মেহেরবানিতে নিজে জানে বাঁচলেও শিবাজীর শাণিত তরবারির ঘায়ে হারাতে হল হাতের আঙ্গুলগুলো। প্রাণ নিয়ে শায়েস্তা খাঁ সেই যে দাক্ষিণাত্য ছাড়লেন, জীবদ্দশায় আর ওমুখো হননি। এদিকে পূর্ব ভারতে মীর জুমলার মৃত্যুতে খালি পড়ে আছে সুবে বাংলা। তাই একপ্রকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ক’রে ১৬৬৪ সালে মুঘল সম্রাট তার মামা শায়েস্তা খাঁকে পাঠালেন সুবে বাংলায়। বাংলা তখন সম্পদে সমৃদ্ধিতে ভরপুর, মুঘল শাসনের সর্বাধিক রাজস্ব প্রদানকারী সুবাগুলির একটি।
শায়েস্তা খাঁর নিযুক্তির পরে পরেই পদোন্নতি হল উদয়নারায়ণের। ঢাকার কাছে, বর্তমান বাংলাদেশের মাগুরা জেলার মধুমতী নদীর তীরে প্রাচীন জনপদ ভূষণার তহশিলদার নিযুক্ত হলেন। ভূষণার অদূরে একটি তালুক কিনলেন তিনি। স্থায়ী বসবাসও শুরু করলেন সেখানে, হরিহরনগরে। সীতারামের কৈশোর জীবন আবর্তিত হয়েছে ঢাকা, ভূষণা, হরিহরনগরকে ঘিরে। কিশোর সীতারামকে তখন টানছে সুবে বাংলার নিয়ন্ত্রণস্থল ঢাকা। তাঁর কৈশোরের অধিকাংশ সময় কাটতে লাগল ঢাকার প্রশাসনিক অলিন্দে। দ্রুত তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর সমরকুশলতা নজরে পড়ল শায়েস্তা খাঁর।
শাহ সুজার অপসারণের পর থেকে বাংলার পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল, আরও অরাজক হয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহী পাঠানদের বিক্ষিপ্ত অত্যাচার, মগ আর পর্তুগিজদের দস্যুবৃত্তি ও উৎপীড়ন, স্থানীয় ঠ্যাঙ্গাড়ে ডাকাতদের বাড়বাড়ন্ত– সব মিলিয়ে নিম্নবঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণার্ধের অধিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। এইসব উপদ্রবের কোনটির উপরেই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কিছুমাত্র ছিলনা। এমত পরিস্থিতিতে সীতারাম তার সমর কুশলতায় বিদ্রোহী পাঠানদের দমন করলেন। পুরস্কার স্বরূপ শায়েস্তা খাঁর থেকে পেলেন নলদি পরগনার জায়গির। এখান থেকে শুরু হল সীতারামের রাজা হয়ে ওঠার প্রাথমিক যাত্রা। শুরু থেকেই সীতারাম তাঁর এলাকায় দুষ্কৃতীদের অত্যাচার কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করলেন। প্রজা সুরক্ষার জন্য এক শক্তিশালী বাহিনী তৈরীতে মন দিলেন।
১৬৭৮ সাল। গোঁড়া ধর্মান্ধ ঔরংজেব দেশজুড়ে চালু করল ইসলামী শরিয়ত বিধি। তার অত্যাচারে হিন্দুদের তখন নিদারুণ দুর্দশা। কাশী-মথুরা সহ হিন্দুসমাজের আস্থাকেন্দ্র দেবালয়গুলি একে একে বিধ্বস্ত হচ্ছে তার হাতে। এদিকে মুঘল শাসনের ‘দাক্ষিণাত্যের ক্ষত’ ততদিনে অঙ্গহানি ঘটিয়েছে। চার বছর হয়ে গেল শিবাজী সেখানে স্বাধীন সার্বভৌম ‘হিন্দুপদপাদশাহী’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার বিস্তার ক্রমশঃ গ্রাস করছে মুঘল শাসনাধীন এলাকাগুলোকে। দক্ষিণ থেকে রাজস্ব তো আসছেই না, উপরন্তু সেখানকার দীর্ঘ সৈন্য অভিযানের বিপুল খরচ যোগাতে রাজকোষ নিঃশেষ হচ্ছে। ওদিকে পশ্চিম ভারতে সংহত হচ্ছে শিখ সম্প্রদায়। পরপর তাদের দুই ধর্মগুরুকে হত্যা ক’রেও খালসা বাহিনীকে বাগে আনতে পারেনি ঔরংজেব। এই বিষম অবস্থার প্রতিহিংসা থেকে শুরু হল অত্যাচারের আরেক দিক– হিন্দুদের উপর চাপানো হল জিজিয়া কর। শরীয়তি আইন আর জিজিয়া করের সাঁড়াশি চাপ থেকে সেদিন বাঁচতে পারেনি বাংলাও। একদিকে প্রশাসনিক বৈষম্য আর অন্যদিকে অস্বাভাবিক করের বোঝায় বাংলার মানুষের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। হিন্দু ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরও করুণ, তাদের উপর ধার্য বাণিজ্য-কর মুসলিমদের করের দ্বিগুণ। শিবাজীর হিন্দুরাজ্যের সঙ্গে প্রলম্বিত যুদ্ধে মুঘল বাহিনীকে তখন রসদ জোগাচ্ছিল বাঙলার হিন্দুদের করের টাকা। এসব দেখে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন ধর্মপ্রাণ সীতারাম। কিন্তু একে তাঁর সামর্থ্য সীমিত, উপরন্তু মুঘল শাসনের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করলে তাঁর রাজকর্মচারী পিতাকে রাজদ্রোহের অপমান ও অত্যাচার সহ্য করতে হবে। সীতারাম তাই নিঃশব্দে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন সঠিক সময়ের।
এই সময় সীতারাম মন দিয়েছিলেন শক্তিশালী এক সৈন্যদল নির্মাণে। সামান্য এক জায়গিরদারের পক্ষে প্রকাশ্যে সৈন্য সংগ্রহ মুঘল আইন বিরুদ্ধ। তাই সেনাদল তৈরীতে সীতারামের কৌশল ছিল অভিনব। প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট দূর করতে এলাকা জুড়ে প্রচুর জলাশয় খনন করতে শুরু করলেন। সেই কাজের শ্রমিক নিয়োগের অছিলায় চলল সেনা সংগ্রহ। দিনে জলাশয় খনন করত একদল শ্রমিক, আর রাতে সামরিক প্রশিক্ষণ চলত আরেক দলের।
১৬৮৪ সাল। স্বল্প ব্যবধানে মাতা এবং পিতাকে হারালেন সীতারাম। পিতৃশ্রাদ্ধের পর তীর্থ দর্শন সম্পন্ন ক’রে পৌঁছে গেলেন দিল্লীর রাজদরবারে। নিম্নবঙ্গের অরাজকতার কথা তুলে ধরলেন সেখানে। এই অবস্থার প্রতিকার কল্পে, আর বাংলার দক্ষিণে রাজ্যের সীমা বাড়ানোর অধিকার দিয়ে তাঁকে রাজা উপাধি দিল মুঘল সম্রাট।
১৬৮৮ সাল। সীতারাম যখন মুঘল সম্রাটের সনদ নিয়ে ফিরে এসে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন, আড়াই দশকের সুবেদারি ছেড়ে শায়েস্তা খাঁ তখন ফিরে যাচ্ছেন দিল্লীতে। সুজলা সুফলা বাংলায় তার সিকি শতকের বাস বড় সুখের ছিল। স্ত্রী,পুত্র, পৌত্রাদি মিলিয়ে তার পরিবার তখন তিন অংকে পৌছেছে। অষ্টআশি বসন্ত পার করা খাঁ সাহেবের কনিষ্ঠ পু্ত্রের বয়স তখন পাঁচ বছর। শায়েস্তা খাঁর বাংলা ত্যাগ সীতারামের পথকে প্রশস্ত করল। রাজ্য স্থাপন করলেন তিনি। নিজের রাজত্বে শরীয়তি আইন অস্বীকার ক’রে সনাতন ঐতিহ্য ভিত্তিক সমান আইন ও শাসন ব্যবস্থা চালু করলেন। প্রাথমিকভাবে রাজত্বের কাজ চলছিল হরিহরনগর থেকে। পরে সুষ্ঠু রাজ্যচালনা ও সামরিক সুরক্ষাকে বিন্যস্ত করতে মধুমতী নদীর তীরে তিনদিকে নদী আর পরিখা দিয়ে ঘেরা মহম্মদপুরে দুর্গ নির্মাণ ক’রে রাজধানী স্থাপন করলেন। অত্যাচার ক্লিষ্ট বাংলায় সগৌরবে মাথা তুলল স্বাধীন সার্বভৌম হিন্দুরাজ্য ‘ভূষণা’।
একজন আদর্শ রাজার সমস্ত গুণাবলী ছিল সীতারামের মধ্যে। প্রজাপালন, আইনের রক্ষা, দুষ্টের দমন, রাজ্যবিস্তার, বাণিজ্যের সম্বর্ধন সব দিকের সন্তুলিত সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাঁর রাজ্য। রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশে বনাঞ্চল ও নদীর আধিক্য থাকায় সেখানে মগ ও পর্তুগিজদের উপদ্রব ছিল। তার উপর স্থানীয় ডাকাতদলগুলিও গৃহস্থের ত্রাসের কারণ হয়ে উঠেছিল। সীতারাম তাঁর বলিষ্ঠ নৌবাহিনীর সাহায্যে মগ আর পর্তুগিজদের নিজের রাজ্যসীমা থেকে দূর করলেন। লুঠতরাজ চালাতে থাকা বিক্ষিপ্ত পাঠান ও স্থানীয় ডাকাতদের নিজের সেনাদলে নিয়োগ করে, একদিকে তাদের উপার্জনের ব্যবস্থা করলেন, অন্যদিকে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলায় স্থিতাবস্থা আনলেন। সেই সময়ে তাঁর রাজত্বে লোকমুখে ফিরত এই ছড়া, যা আজও মাগুরা, যশোর অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে–
ধন্য রাজা সীতারাম বাংলা বাহাদুর,
যার বলেতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেল দূর
এখন বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে
রামী শ্যামী পোটলা বেধে গঙ্গাস্নানে যাবে।
সীতারামের সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও পরাক্রম তৎকালীন বাংলার এক গৌরবের বিষয়। তাঁর সামরিক সাফল্যের মূল কারিগর ছিলেন তাঁর বন্ধু ও সেনাপতি রামরূপ (মৃণ্ময়) ঘোষ। প্রবল শক্তি আর শৌর্যের মিশেল এই সেনায়াকের কিংবদন্তী আজও ফরিদপুর, যশোর, খুলনার লোকসমাজে বেঁচে আছে। খালি হাতে, একটি কাঠের পিঁড়ি দিয়ে একটি উন্মত্ত হাতীকে মেরে তিনি লোকমুখে বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘মেনাহাতী’ নামে। সীতারামের সেনাদল সমৃদ্ধ ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লড়াকু সেনায়। রূপচাঁদ ঢালি, ফকির মাছকাটা, বখতিয়ার খান, আমল বেগ, গোবর দলন প্রমুখ তাঁর সেনার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিল। সীতারাম নিপুণ অস্ত্র নির্মাণকারীদের এনে দুর্গের ভিতর অস্ত্র, কামান ও গোলা তৈরীর কারখানা স্থাপন করেন। তাঁর গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলির মধ্যে ‘ঝুমঝুম’ ও ‘কালে’ নির্ভুল নিশানায় আঘাত হেনে শত্রুশিবির ধ্বংস করে বিখ্যাত হয়েছিল।
অমিতবিক্রম সৈন্যদল ও কুশলী কূটনীতির বলে সীতারাম তাঁর রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার করেছিলেন। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর, তেহট্ট, রানাঘাট মহকুমা, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমা, বাংলাদেশের পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, খুলনা ও মাগুরা জেলার চুয়াল্লিশটি পরগনায় সাত হাজার বর্গ মাইলে বিস্তৃত ছিল তাঁর রাজ্য। সেই সময়ে তাঁর রাজস্বের আয় ছিল ৭৮ লক্ষ টাকা।
ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে সীতারাম তাঁর রাজস্ব প্রজাহিতে ব্যয় করতেন। ভূষণা রাজ্য জুড়ে বিদ্যাচর্চার পরিবেশ তৈরী হয়। প্রচুর চতুস্পাঠী স্থাপিত হয়। পণ্ডিত ও অধ্যাপকগণ রাজবৃত্তি পেতেন। আয়ুর্বেদ চর্চার দিকে সীতারামের বিশেষ নজর ছিল। ভূষণা রাজ্যে আইন বা কর নির্ধারণ– কোনো ব্যাপারেই সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্য ছিলনা। উপরন্তু তিনি নিজ উদ্যোগে ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগরদের তাঁর রাজ্যে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত করতেন। ভুষণার রাজধানী মহম্মদপুর তৎকালীন বাংলার উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়।
সীতারাম রাজ্যজুড়ে অসংখ্য জলাশয় ও মন্দির নির্মাণ করেন। হরিহরনগর, মহম্মদপুর, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর জুড়ে ছড়িয়ে আছে তাঁর তৈরী রাধাকৃষ্ণের পঞ্চরত্ন মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণের অষ্টকোণ মন্দির, দশভুজার মন্দির, দোলমঞ্চ, জোড়বাংলা মন্দির, কৃষ্ণমন্দির ও শিবালয়গুলি। সীতারামের তৈরী ১৫০০ ফুট x৬০০ ফুট বিস্তৃত বিশাল রামসাগর, কৃষ্ণসাগর, সুখসাগর আজও মাগুরা জেলার উল্লেখযোগ্য জলাশয়গুলির মধ্যে পড়ে।
সীতারামের রাজ্যস্থাপনের সময় বাংলার সুবেদার হয়ে পর পর আসে ইব্রাহিম খাঁ ও আজিম্-উস্-সান। তাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা সীতারামের রাজ্যবিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু শেষোক্ত জনের আত্মীয় আবু তোরাব সেই সময় নিম্নবঙ্গ জুড়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কর আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর নৃশংস অত্যাচার তো ছিলই, কর খেলাপীদের বলপূর্বক ইসলাম কবুল করানোতেও তার ব্যাপক কুখ্যাতি ছিল। ১৬৯৯ সালে বারাশিয়া নদীতীরে আবু তোরাবকে পর্যুদস্ত করল সীতারামের বাহিনী। দখলে এল তার দুর্গ। সেনাপতি মৃণ্ময়ের প্রহারে নিহত হল আবু তোরাব। পরকালে সে জন্নত এর ‘বাহাত্তর হুর’ এর সেবা পেয়েছিল কিনা তার বিচার মুমিনরা করতেই পারেন, কিন্তু বাংলার মানুষ যে এক নরপশুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
১৭০০ সাল। মুঘল সাম্রাজ্যের ছায়া ততদিনে দীর্ঘায়িত হতে শুরু করেছে। একদিকে মারাঠা পরাক্রম প্রতিহত করতে গিয়ে রাজকোষ তলানিতে, অন্যদিকে সোনার বাঙলার রাজস্ব আহরণেও ভাঁটার টান। এমতাবস্থায় বাঙলার দেওয়ানির ভার পেলেন মহম্মদ হাদি ওরফে কুলি খাঁ। সীতারামের সমবয়স্ক দক্ষ এই প্রশাসক পরবর্তীতে নিজের কর্মকুশলতায় ‘মুর্শিদ’ উপাধি পাবেন, খ্যাত হবেন মুর্শিদকুলি খাঁ নামে। দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ সন্তান সূর্যনারায়ণ মিশ্র কিভাবে শিয়া মুসলিম মুর্শিদকুলি হয়ে উঠল, সে কাহিনীর বিস্তার অন্য পরিসরে করা যাবে, এখন আমরা মন দেব সীতারাম আর মুর্শিদকুলির দ্বৈরথে।
বিচক্ষণ মুর্শিদকুলি বুঝতে পারছিলেন সুবে বাঙলার রাজধানী ঢাকা সীতারামের সামনে সুরক্ষিত নয়। তাই রাজধানী স্থাপনের জন্য এমন এক বিকল্প স্থানের সন্ধান শুরু হল, যা থাকবে সীতারামের নাগাল থেকে দূরে, আবার সেখান থেকে বাঙলাকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মধ্যবঙ্গে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের কাছেই স্থাপিত হল নতুন নগর, প্রতিষ্ঠাতার নামে যা এখন পরিচিত মুর্শিদাবাদ নামে।
সীতারামের শাসনে স্বাধীন ভূষণা রাজ্যের অভূতপূর্ব সমৃদ্ধিতে আশেপাশের মুঘল শাসনাধীন প্রজারা ভূষণাতে এসে বসবাস ও বাণিজ্য শুরু করতে থাকছিল। ফলে ভূষণার আশেপাশের জমিদারদের ঈর্ষার কারণ হচ্ছিলেন সীতারাম। ওদিকে সুবার রাজস্ব সংগ্রহ কমতে থাকায় মুর্শিদকুলিরও চিন্তা বাড়ছিল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল ভূষণা আক্রমণ করার।
১৭১৪ সাল। মুঘল সেনা ও তার অধীন জমিদারদের যৌথবাহিনী আক্রমণ করল ভূষণা রাজ্য। রাজা সীতারাম ভূষণার দুর্গ থেকে আক্রমণ প্রতিহত করছেন। রাজধানী মহম্মদপুরের দুর্গ আগলাচ্ছেন সেনাপতি মৃণ্ময়। তাদের পরাক্রমের সামনে মুঘল সেনার জয় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এমন সময় মুঘল পক্ষের জমিদারদের কুটিল ষড়যন্ত্রে নেমে এল আকস্মিক আঘাত। নিজের কর্মচারীর বিশ্বাসঘাতকতা আর অন্তর্ঘাতে নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী হলেন সেনাপতি মৃণ্ময়। এই আকস্মিক আঘাত আর নেতৃত্বের অভাবে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ল তাঁর বাহিনী। সীতারাম ভূষণা ছেড়ে অগ্রসর হলেন রাজধানীর দিকে। মহম্মদপুরে দ্বিমুখী আক্রমণের সামনে স্বাধীনতা রক্ষার প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন সীতারাম। অবশেষে পরাজয় হল তাঁর। বন্দী অবস্থায় তাঁকে আনা হল মুর্শিদাবাদে। তাঁর রাজত্বের সমস্ত সম্পত্তি লুঠ হল। ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মৃত্যুদণ্ডে প্রাণ দিলেন বাঙলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা।
মধুমতী নদীর তীরে সেদিন যখন ষড়যন্ত্র, প্রবঞ্চনা,আর বিস্বাসঘাতকতায় বাঙলার শেষ স্বাধীন সার্বভৌম হিন্দু রাজ্যে শেষ অঙ্কের যবনিকা পড়েছিল, বিধাতা তখন অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। কালচক্রের আবর্তনে অর্ধশতাব্দী পরে, ১৭৫৭-র পলাশীর প্রান্তরে একই নাটকের পুনরাভিনয় ঘটবে– চার ঘণ্টার যুদ্ধে নবাবকে হারিয়ে বাংলার রাশ উঠে আসবে রবার্ট ক্লাইভের হাতে।
সীতারাম রায় আজ আর নেই। আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী তাঁকে মনে রাখেনি। স্রোতস্বিনী মধুমতী আজ মন্থর প্রবাহিনী, শীর্ণকায়া। ১৮৩৬ এর অজানা মহামারীতে রাজধানী মহম্মদপুর তথা মাগুরা জনশূন্য হয়েছে। তাঁর তৈরী দুর্গটি ধূলিসাৎ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মাগুরা জেলায় সীতারাম নির্মিত প্রাসাদ এবং তার ভগ্নপ্রায় সিংহদ্বার আজও দাঁড়িয়ে আছে। সীতারামের তৈরী দোলমঞ্চ, দশভুজা মন্দির, জোড়বাংলা মন্দির, পঞ্চরত্ন মন্দির আর শিবমন্দিরগুলি উপযুক্ত রক্ষনাবেক্ষণ ছাড়া অবহেলায় পড়ে আছে, দুষ্কৃতীদের হাতে টেরাকোটার কারুকার্য্য এমনকি ইটও লুঠ হয়েছে। বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতি ও শিল্প সুষমার এই অনন্য নিদর্শনগুলি আজ ধ্বংসস্তুপ। অবহেলা ও অযত্নে সীতারাম নির্মিত অষ্টভুজাকৃতি অষ্টকোণ মন্দিরটি ২০১৭ সালের ২৬শে জুলাই সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পড়েছে।
আচার্য যদুনাথ সরকার রাজা সীতারামকে বাংলার আর এক বীর রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার এই স্বাধীন হিন্দুরাজ্য স্থাপনের আখ্যানকে অমর করে গিয়েছেন তাঁর ‘সীতারাম’ উপন্যাসে।
নিজ উদ্যম, সাহস ও বীরত্বে রাজা সীতারাম যে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ছাব্বিশ বছরের স্বল্প স্থায়িত্বের পর তার পতন হয়েছিল বটে, কিন্তু কে জানে! ভাগ্যলক্ষ্মীর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলে সেই রাজ্যও হয়তো বিস্তারে, স্থায়িত্বে শিবাজী স্থাপিত আর এক হিন্দুরাজ্যের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারত। ভাষা-সংস্কৃতিতে আদ্যন্ত অবাঙ্গালী, রাজ্যশাসনে অপরিণত, পঁচিশ বছর বয়সী সিরাজের পরাজয় ও মাতামহের অনায়াস উত্তরাধিকারে পাওয়া নবাবি হারানোর ইতিহাস আজ দুঃখবিলাসী বাঙ্গালীর উপভোগ্য রোমন্থনের বিষয় হয়ে উঠেছে, অথচ নিজেদের মানসপট থেকে তারা সযত্নে মুছে ফেলেছে বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজার শৌর্যগাথা, যিনি নিজের পুরুষকারে অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর স্বপ্নের স্বরাজ্য।
‘পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা’– সীতারাম কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া এক রাজা মাত্র নন। সীতারাম ভারতের আবহমান সনাতন সংস্কৃতির সুশাসন, সংগঠন, বীরত্ব ও রাষ্ট্রবোধের প্রতীক। তিনি স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার ইতিহাসের রথচক্র যে পথে ধাবিত হয়েছে, সীতারামরা যুগে যুগে তাকে পথ দেখিয়ে গেছেন। ‘ঘোর তিমির ঘন নিবিড় নিশীথে, পীড়িত মূর্ছিত দেশে’ সীতারামরা মঙ্গলদীপ হয়ে জ্বলেছেন যুগে যুগে। শঙ্খধ্বনি হয়ে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশবাসীকে।
বিজয় সিংহ, শশাঙ্ক, গণেশ, শুক্লধ্বজ, প্রতাপাদিত্যের উত্তরসুরী, মুক্তিপথের অগ্রদূত, চির উন্নত শির হে রাজা সীতারাম, তোমার স্বরাজ্য-আকাঙ্ক্ষা ও বীরত্বে উদ্দীপ্ত জীবন এই আত্মবিস্মৃত নিরুদ্যম জাতিতে বিদ্যুৎ সঞ্চার করুক। তোমাকে প্রণাম।
তথ্যঋণ–
- Sarkar, Jadunath; History of Bengal, The: (vol 2 Muslim Period (1200A.D.-1757A.D.); BR Publishing Corporation; 2011:New Delhi. ISBN– 9788176462396.
- Stewart, Charles; History of Bengal, The: From the First Mohammedan Invasion until the Virtual Conquest of that Country by the English AD 1757; Cambridge University Press; 2015:London. ISBN– 9781139506649.
- Westland, James; Report on the District of Jessore, A: Its Antiquities, Its History, and Its Commerce; Bengal Secretariat Office; 1873:Jessore.
- যদুনাথ ভট্টাচার্য; রাজা সীতারাম রায়; যদুনাথ ভট্টাচার্য; ১৯০৭:কলিকাতা।
- সতীশচন্দ্র মিত্র; যশোর খুলনার ইতিহাস; গতিধারা; ২০১১:বাংলাদেশ। ISBN– 984715135
- দীনেশ চন্দ্র সেন; বৃহৎ বঙ্গ; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; ১৯৩৪:কলিকাতা।
- Islam, Sirajul; Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh; Asiatic Society of Bangladesh; 2003:Dhaka. ISBN 978-984-32-0576-6.
- https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1267951/%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A6%B2-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A3-%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B0 retrieved on July 19, 2020. (প্রথম আলো (সংবাদপত্র)। ২৮ জুলাই ২০১৭)
লেখক– রজত কুমার দাশ (Rajat Kumar Das)