মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক হলে বিভীষণ কেন নন, এমন প্রশ্ন অনেকেরই। কারণ, দুজনেই স্বপক্ষ ত্যাগ করে প্রতিপক্ষে ভিড়েছিলেন এবং প্রতিপক্ষকে কিছু অযাচিত সুবিধা দিয়েছিলেন, যেটা নিজ নিজ পরিস্থিতির ফলাফল নির্ধারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রমানিত হয়েছিল। এই প্রশ্নটিকে সাধারণ জনমানসের চিন্তাজগতে প্রকটিত করতে প্রথম কাব্যিক স্টিমুলাস ছিল, সম্ভবত মাইকেল মধুসুধন দত্তের অমর “মেঘনাদ বধ” কাব্যটি।
প্রথমতঃ, মীরজাফর, সিরাজুদ্দৌলার বিশ্বস্ত হয়েছিলেন, নৈকট্য লাভ করেছিলেন তাঁর মনের অভিসন্ধি গোপন রেখেই। তিনি সিরাজের সেনাপতি ছিলেন, ইংরেজের সাথে সমঝোতায় এসেও তিনি নিজ পদ ত্যাগ করেননি বিশ্বাসঘাতকতার সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়ার জন্য। অপরদিকে, রাবণের সীতা অপহরণের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে বিভীষণের বিরোধিতা শুরু থেকেই ছিল উচ্চমুখ ও স্পষ্ট। যুদ্ধপূর্বকালে হনুমান সীতাকে ফিরে দেওয়ার কথা বললে হনুমানকে হত্যা করতে উদ্যত হলে বিভীষণ স্পষ্ট ভাষায় রাবণকে রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দেন। শুরু থেকেই তিনি বার বার সীতাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য রাবণকে বলতে থাকেন। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাবণ বিভীষণকে রাজসভাতেই চরম অপমান করেন। তারপরেই বিভীষণ লঙ্কাপুরী ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দেন।
দ্বিতীয়তঃ, মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ইংরেজদের কাছ থেকে ক্ষমতা প্রাপ্তির ব্যাপারে আশ্বস্ত হবার পর। অর্থাৎ, তাঁর গোপন সিরাজ বিরোধিতা ছিল সম্পূর্ণ ক্ষমতার লোভ থেকেই। অপরদিকে, বিভীষণ, রাবণের সামনেই তাঁর বিরোধিতার কারণ স্পষ্ট করেছিলেন। কারণটা ছিল, ধর্ম। রাবণরা বিশ্বশ্রবা মুনির পুত্র, আর মুনিপুত্রের এমন কাজ যে ধর্মবিরোধী সেটাও বিভীষণ রাবণকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন।
তৃতীয়তঃ, মীরজাফর সিরাজের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধরেননি, বরং নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে সিরাজের বাহিনীর একটা বড় অংশকে নিস্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। অপরদিকে, বিভীষণ সরাসরি যুদ্ধ না করলেও, মন্ত্রণা ও স্ট্রাটেজি-র সাহায্যে রামকে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিলেন। এখানে, প্রশ্ন আসতে পারে, ধর্মাশ্রয়ী বিভীষণ তো যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ও থাকতে পারতেন, তিনি সরাসরি রামের পক্ষে যোগ দিয়ে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে জেতালেন কেন?
কারণ, অধর্ম বা অন্যায়কে চুপচাপ সহন করাও অন্যায়। ধর্মের পক্ষে সক্রিয় হওয়া ধার্মিক ব্যক্তি মাত্রের কর্তব্য। এখানে মাথায় রাখতে হবে, বিভীষণ যেমন রাবণের কুকর্মের বিরোধিতা করেছিলেন, তেমনই বিরোধিতা করেছিলেন কুম্ভকর্ণ। কিন্তু, কুম্ভকর্ণ সব জেনেও রাবণকে অধর্মের ব্যাপারে সতর্ক করেও রাবণকে ত্যাগ করেননি, বরং ভাইয়ের পক্ষে, স্বকুলের রক্ষার্থে যুদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই কর্তব্য পালন হয় না। ধর্মের পক্ষে সক্রিয় হতে হয়। নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদ মূল্যহীন।
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, সরাসরি শত্রুপক্ষে যোগ না দিয়ে বিভীষণ কি কুম্ভকর্ণকেই অনুসরণ করতে পারতেন না? আচ্ছা, মহাভারতের ভীষ্ম, দ্রোণের কথা কি মনে আছে? তাঁরা পাণ্ডবদের হিতাকাঙ্ক্ষীই ছিলেন, দুর্যোধনের সমস্ত কুকীর্তির কথা জেনে এবং সেসব কীর্তির বিরোধিতা করেও শেষপর্যন্ত দুর্যোধনের হয়েই যুদ্ধ করেছিলেন। দ্রোণ, ভীষ্ম নিজেরা আধর্মিক ছিলেন না, কিন্তু অধর্মের গোড়া দুর্যোধনের রক্ষাকবচ ছিলেন। সেজন্য দুর্যোধনের নাশ করতে, ভীষ্ম, দ্রোণকে হত্যা করা কর্তব্য– এমনই মত ছিল শ্রীকৃষ্ণের। একই ভাবে, কুম্ভকর্ণ ছাড়াও মেঘনাদ সহ সমস্ত লঙ্কাসেনাও রামের প্রতিপক্ষ ছিলেন না, আধর্মিক ছিলেন না। কিন্তু, রাবণের রক্ষাকবচ ছিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ যে অধর্ম করেছিলেন, কুম্ভকর্ণও সেই একই দোষে দোষী ছিলেন।
চতুর্থতঃ, অনেকেই দাবী করেন, বিভীষণ রাজ্যলোভে এই কাজ করেছিলেন। এখানে বিভীষণের সাথে মীরজাফরের পার্থক্য হলো বিভীষণ সবসময় রাবণের সম্মুখেই বিরোধিতা করেছেন, বারবারই ধর্মের দোহাই দিয়েছেন। বিভীষণ মীরজাফরের মত প্রতিপক্ষের সাথে গোপন চুক্তি করেননি। সুতরাং এক্ষেত্রে মেঘনাদই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। মেঘনাদ কেন নিজের বাবার বিরোধিতা করেন নি? ছেলের কুকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র যদি দোষী হন, তাইলে বাবার কুকর্মের সহায় হয়ে মেঘনাদ কেন দোষী হবেন না? মেঘনাদ যদি বিরোধিতা করতেন, তাহলে যুদ্ধটা ভেস্তে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। কারণ, স্পষ্টতই রাবণ যতটা মেঘনাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, ততটা আর কারও উপর ছিলেন না। কুম্ভকর্ণ প্রভৃতির মৃত্যুতে রাবণ ততটা ভেঙ্গে পরেননি, যতটা ভেঙ্গে পরেছেন মেঘনাদের মৃত্যুর পর। মেঘনাদ যদি, যুদ্ধে নিষ্ক্রিয়ও থাকতেন, তাহলেও কি লঙ্কার রাক্ষসকুলে বাতি দিতে বিভীষণের উপর নির্ভর করতে হত?
শেষকথায় আসি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে জাস্টিফাই করতে, ভারতবর্ষে সামাজিক ফাটল ধরাতে, খ্রীষ্টান মিশনারিদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে, রামকে ব্রাহ্মণ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী আর্য দস্যু হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে গত দেড়শ বছরের বেশী সময় ধরে। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব, আর্য-দ্রাবিড় তত্ত্ব ইত্যাদি আবিষ্কার করা হয়েছে সেই রবার্ট ক্যাল্ডওয়েলের সময় থেকেই। এই লঙ্কাযুদ্ধকে, রামের মাধ্যমে আর্যদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে বার বার। কিন্তু আসল সত্য হল, সীতাকে অপহরণের মাধ্যমে রাবণই প্রথম আঘাত হেনেছিল। প্রত্যাঘাত করাটা ক্ষত্রিয় রামের অবশ্য কর্তব্য ছিল৷ বৃহত্তর বিচারে, রাবণের উত্তরোত্তর বর্ধমান আধর্মিক, ভোগবাদী, সাম্রাজ্যবাদী বিকৃতির প্রসারকে আটকানোই ছিল রামচন্দ্রের জীবনের লক্ষ্যগুলির মধ্যে প্রধানতম।
রাকেশ দাশ