‘ভোর’ সাতটার আধো ঘুম আধো জাগরণে এখনো প্রায় সব বিত্ত’-এর বাঙ্গালির শেষ আশ্রয় পাশবালিশ। ছেলেবেলার বাবাকে পাশবালিশ করা কিংবা সদ্য বিবাহিত দম্পতি ???? পাশবালিশ ডিঙোনোর মতো নস্টালজিয়া কাটিয়ে উঠতে পারলেও চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট পেরনোর মানব জীবনে পাথুরে সত্য হয়েই জেগে আছে পাশবালিশ। আর জেগে আছে বলেই বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাশবালিশ কবি, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকারের কলমের কলমকারি সৃষ্টিতে কোথাও আদিরসের রসেতে হাবুডুবু খেয়ে, কোথাও বা নির্ভার প্রেমের নির্জীবতায়। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। “বাবা ও খোকা বামন প্রেমিকা দুজনের পাশবালিশ, তৃতীয় বিশ্ব আদতে নিঃস্ব গতি সেই পাশবালিশ।”
হ্যা, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সুবিখ্যাত ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দুর গানেরই পরবর্তী কথাঞ্জলি—
“এই যে দোস্তি কিছু অস্বস্তি সবেতে পাশবালিশ ডার্লিং পিলো চার আনা কিলো কি দারুণ পাশবালিশ।”
আলিপুরদুয়ারের কবি অরুণাভ রাহা রায় তো আস্ত একটা কবিতার বইয়েরই নামকরণ করেছেন খামখেয়ালী। পাশবালিশ।
আর আখতারুজ্জমান বিপ্লব তাঁর রোম্যান্টিকতার মাধুর্য মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে বিখ্যাত কবিতা—
‘এমন হলেও হতো ইনসোমনিয়ার দুঃখ হয়ে শেষ রাত্তিরে সয়ে সয়ে তোমার আঙুল আলতো
আলতো করে আমার পাশবালিশ ছুঁতো।
বাঙ্গালি জীবনে পাশবালিশ তাই আজন্মকাল হয়ে আছে প্রেম, রোমান্টিকতার আইকন হয়ে, আলসেমি, স্বপ্নবিভোর আর আরামপ্রিয় জীবনের ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডার হয়ে।
আবহমানকাল জুড়ে পাশবালিশের এই আইকনত্ব অথবা ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডারকে আচমকাই এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছেন আমাদের ‘কবি, শিল্পী, লেখিকা, গায়িকা, ছড়াকার রাজনীতিবিদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনা জ্বরে জর্জরিত ওপার বাংলার একদা ডরপুকো, অধুনা
ভয়কাতুরে বাঙ্গালিকে পরামর্শ দিয়েছেন। উপদেশাচ্ছলে—“করোনাকে নিয়ে ঘুমোন, করোনাকে পাশবালিশ করে নিন।
মাত্র দুটো বাক্য। ছোটো ছোটো। তাতেই পাশবালিশের দফারফা। প্রেম, ভালোবাসার ‘রোবাইয়াৎ’ হয়ে ওঠা পাশপালিশকে নিমেষে বানিয়ে দিয়েছেন মর্গের কফিন যেটার গর্ভে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে শুধুই মৃতদেহরা। দোলনচঁাপা আর দুইয়ের স্বপ্নালু গন্ধ ছেটাতো যে পাশবালিশ নিমেষেই নির্দয় মুখ্যমন্ত্রী তাতে মাখিয়ে দিয়েছেন পূতিগন্ধময় অস্পৃশ্য করোনায় মৃত মৃতদেহ নিঃসৃত ‘আতর’ আর ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, করোনা প্রতিরোধের ন্যূনতম যোগ্যতাও তার নেই। তাই চাইছেন, করোনাই হোক এপার বাঙ্গলার বাঙ্গালির চিরঘুমে যাবার মহৌষধ। বাঙ্গালি যাক চিরঘুমে করোনা সংক্রামিত পাশবালিশ জড়িয়ে।
কী ভয়ংকর ৬ পদেশ ! কী নির্মম কথাঞ্জলি! কী চরম বিশ্বাসঘাতকতা এই বাঙ্গলার প্রতি যে বাঙ্গলা তাঁকে ‘ঘরের মেয়ে’ উপমায় ভূষিত করে ভোট গাঁথা মালায় পরপর দু’বার বরণ করে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদে!
অনেকদিন আগে তখন মমতার মন্ত্রীসভারই বরিষ্ঠ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় (তখন তিনি কংগ্রেস বিধায়ক) একটি চরম সত্য জনসমক্ষে বলেছিলেন, “মমতা যা বলে তা করে না। প্রতিশ্রুতি দেওয়াটা যেমন ওর স্বভাব, তেমনি প্রতিশ্রুতি ভাঙাটাও ওর স্বভাব।” মুখ্যমন্ত্রী হবার পর থেকেই ওই স্বভাবটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কথায়, কাজে ও চরিত্রে।
এইমুহূর্তে যখন গোটা ভারতবর্ষই গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির হিসেবের খাতায় আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে, তখন এই পশ্চিমবঙ্গও অলিম্পিক প্রিন্টারের গতিতেই এগোচ্ছে দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে করোনাশ্রী অভিধায় ভূষিত হওয়ার পথে। এটা যে হবেই তা বোঝা গিয়েছিল সেই এপ্রিলেই যখন তিনি গোটা মন্ত্রীসভা, দলের এমএলএ, এমপি-দের। কাউন্সিলরদের ঘরবন্দি করে রেখে একাই ‘করোনাযোদ্ধা’র ভূমিকায় অভিনয় করতে। গিয়ে বাজারে বাজারে বিশাল পুলিশ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গোল গোল দাগ কাটছিলেন আর পাশে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে বসিয়ে মাইক হাতে পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করছিলেন—“সকলে ঘরে থাকুন, নিতান্ত প্রয়োজনে বেরোতে হলে মাস্ক ব্যবহার করুন। আর প্রত্যেকদিন বিকেলে নবান্নের পাঁচতারা অফিসঘরেবসে
‘বাণী’ দিচ্ছিলেন নিয়মিত। বোঝাই গিয়েছিল— কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। করোনা রোধে পরিকাঠামো গড়ে তোলার নামে চলছে শুধুই গোয়েবলসীয় প্রচার। এককে একশো করে দেখানোর অপচেষ্টা। তাই প্রথম থেকে শুধু একাই ছিলেন গোটা প্রচার-নির্মাণের চিত্রনাট্যকার। তাঁর মতলবেই স্বাস্থ্য দপ্তর দিনের পর দিন মিথ্যা তথ্য দিয়ে গেছে। এখনও দিচ্ছে। ধরাও পড়ছে যে যখন দেখানো হচ্ছে সাগরদত্ত হাসপাতালে রয়েছে ৫০০ করোনা শয্যা, তখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সেখানে রয়েছে হাতে গোনা মাত্র ৮০টি শয্যা। বাকি ৪২০টির হিসেবটা পুরোপুরি ফোর টোয়েন্টির বাস্তবতা।
চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে এক সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রীর করোনা প্রতিরোধে পরিকাঠামো গড়ে তোলার নজির। হ্যা, ওই উত্তরপ্রদেশেই যেখানে মুখ্যমন্ত্রী যোগী। আদিত্যনাথ দাপটের সঙ্গে বলতে পারেন— মাত্র দুমাসে গোটা রাজ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ৭৮ হাজার করোনা আক্রান্তদের জন্য শয্যা। বলতে পারেন—আগামী বছর থেকে আর কোনও শ্রমিককে রাজ্যের। বাইরে যেতে হবে না কাজের সন্ধানে, রোজগারের সন্ধানে। কাউকে গায়ে জড়াতে হবে না পরিযায়ী শ্রমিকের তকমা।
না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে যেসব ধরা পড়েনা। শুধু ধরা পড়ে দু-চারটি বিক্ষিপ্ত গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনা। কারণ তিনি সবচেয়ে ভালো বোঝেন মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতির অঙ্কটা। তাঁর কৃতিত্বের অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে ওই নির্মম রাজনীতির ফর্মুলা।
উন্নয়নের ছবিটা তাই তার নজর এড়িয়ে যায়। আর হয়তো তাই নিজের সামগ্রিক ব্যর্থতা ঢাকতেতঁাকে বলতে হয়— ‘করোনাকে নিয়ে ঘুমোন। করোনাকে পাশবালিশ করে নিন। তার চেয়ে স্পষ্ট করেই বলতে পারতেন—‘মরণকে সঙ্গিনী করে নিয়ে বিছানায় যান। মৃত্যুকেই পাশবালিশ করে নিন।
হয়তো এটাই বাস্তব, হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন করোনা ভাইরাস টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো আমাদের জীবনে জড়িয়ে থাকবে মৃত্যুদূত হয়ে। কিন্তু সেদিন তো আমাদের হাতে থাকবে কোনও ভ্যাকসিন, চিকিৎসার কিছু সুযোগ ! আজ যখন ভ্যাকসিনের স্বপ্ন
দূর-অস্ত, যখন করোনা আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়ে বেড়াতে হচ্ছে ন্যূনতম চিকিৎসা পাওয়ার আশায়, তারপর রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে হচ্ছে তখন মুখ্যমন্ত্রী (যিনি রাজ্যের অভিভাবিকা হিসেবে দাবি করেন ‘আমার পুলিশ, আমার প্রশাসন, আমার মন্ত্রী, আমার চিকিৎসক’ বলে) কোন সাহসে মানুষকে ঠেলে দেন মৃত্যুর দিকে। আসলে তিনি বুঝে গেছেন— করোনা প্রতিরোধে সরকারি অর্থ তিনি নয়ছয় করেছেন—তাই মানুষের পরীক্ষা হয়নি আজও। গড়ে ওঠেনি যথেষ্ট পরিমাণে আইসোলেশন সেন্টার। বাড়েনি হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা। চিকিৎসক, নার্সরা করোনা প্রতিরোধক পিপিই বা অন্যান্য সামগ্রী পাননি। এমনকী বহু জায়গায় পৌঁছয়নি মাস্কও। পরিযায়ী শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা। পুলিশকে তাঁর করণীয় কাজ করতে দেওয়া হয়নি। পুরসভাগুলি নিষ্কর্মা হয়ে হাত গুটিয়ে বসে। নর্দমা পরিষ্কার হয়নি। ভ্যাটের জঞ্জাল জমেছে পাহাড় হয়ে। পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে সেদিয়েছেন ঘরে। বিধায়ক, সাংসদরা নির্ভেজাল ছুটি কাটিয়েছেন ৪২০ দিন ধরে। সুতরাং মমতাদেবী ধরেই নিয়েছিলেন, বাঙ্গালির অপমৃত্যু অবধারিত। এখন সেটাই ঘটছে। মানুষ বাধ্য হচ্ছে করোনাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতে নয়, চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিতে। মমতা ব্যানার্জি এখন নিশ্চিত, দেশের মধ্যে করোনা প্রতিরোধের ব্যর্থতায় তিনি প্রথম হবেনই। শুধু এটা দেখার জন্য আমাদের আরও দু’একটা মাস অপেক্ষা করতেই হবে— সেদিন ‘করোনাশী’ ট্রফিটা হাতে তুলে নেবার জন্য কে বেঁচে থাকেন— মৃত্যুঞ্জয়ী বাঙ্গালি নাকি মরণাকাঙ্ক্ষী তৃণমূল সরকার।
সুজিত রায়