দ্বিতীয় পর্ব
উত্তরম যৎ শিলাবত্যাঃ
অজয়াস্যচৈব দক্ষিণম্
ভাগীরথ্যাঃ পশ্চিমায়াং তু
দ্বারকেশ্বরম্ চ্ পূর্বস্যাম্
জনপদং তদ্ বর্দ্ধমান নাম।
রাঢ়ী যত্র সন্ততিঃ ॥
পূর্ব পর্বেই উল্লেখ করেছিই যে জৈন আচারঙ্গ সূত্রের মধ্যে বজ্জভূমির পথে কুকুরের উৎপাতের উল্লেখ আছে। তার জন্য নাকি হাতে দণ্ডের ব্যবহার করতে হত মহাবীর ও তার অনুগামীদের । তার উল্লেখ পেয়ে অনেকেই এই কথা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে , ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বামী সময় বজ্জভূমি তথা রাঢ় অঞ্চল বা বর্দ্ধমান জনপদ বন্যজন্তুর বিহারক্ষেত্র ও সভ্যতা বর্জিত স্থান ছিল। কিন্তু সেখানেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে , যে বর্দ্ধমান বা রাঢ় দেশ ভীম , মোদাগিরিস্থিত অতিবলশালী রাজা , তীব্র পরাক্রমশালী রাজা পুন্ড্রাধীপ বাসুদেব, কৌশিকীকচ্ছ নিবাসী রাজা মহৌজা, সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন , বিজয় সিংহ প্রমুখ দ্বারা শাসিত, প্রশাসিত হয়েছে, যে বর্দ্ধমান যুদ্ধের কারণ হয়েছে , সেই অঞ্চলকে কিভাবে অসভ্য বলা সম্ভব ?
বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল। তাই আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে। রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম। এছাড়াও ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম ছিল এহেন স্থানে। এমন এক সুসভ্য অঞ্চলকে কিভাবে বা কোন প্রমাণে অসভ্য , জংলী ইত্যাদি বলা হয় তা প্রশ্ন চিহ্নের সৃষ্টি করে।
উক্ত আলোচনা থেকে একথা বাস্তবিক যে , বর্দ্ধমান বন্য ও সভ্যতা বর্জিত অঞ্চল ছিল না। তার বহু বহু পূর্ব হতেই এই অঞ্চলে উচ্চ সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছিল এবং পরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণের বাস ছিল। কুরুক্ষেত্রের মহাসমরেও যে তাঁরা স্ব স্ব বীর্য্যবত্তার পরিচয় দিয়ে গেছেন। মহাভারতেই তার উল্লেখ আছে।
মহাবীর এবং শাক্যসিংহ উভয়েই সমসাময়িক ছিলেন। সিংহলের পালি মহাবংশের প্রকাশ যে, তৎকালে সিংহপুরে রাঢ় অঞ্চলের রাজধানী ছিল এবং মহারাজ সিংহবাহু রাজত্ব করতেন। তাঁরই প্রিয়পুত্র বিজয় সাত শত অনুচর নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় গিয়েছিলেন। তৎকালে রাঢ়ীয়গণ যে, সমুদ্রগামী নৌকা ব্যবহার করতেন এবং মহাসমুদ্রের ঊর্মিমালা ভেদ করে সমুদ্রাস্তরে ভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে সমর্থ ছিলেন।
তৎকালে বর্দ্ধমান , রাঢ় বা সুহ্মদেশের ভূভাগ সমুদ্র তরঙ্গ বিচুম্বিত ছিল। বর্দ্ধমান স্বামীর আগমন কালে যে স্থান বজ্জভূমি নামে পরিচিত ছিল , তাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে ও বরাহমিহিরের গ্রন্থে বর্দ্ধমান নামে উল্লিখিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪ র্থ শতাব্দীতে গ্রীক রাজদূত মেগাস্থিনিস #Gangaridae নামক এক বৃহৎ এবং সমৃদ্ধশালী জনপদের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন , ” যে বিস্তৃত জনপদের রাজধানী পাটলিপুত্র , সেই প্রাচ্য জনপদের পূর্ব্বদিকে উক্ত গঙ্গারিডি জনপদ।” প্রাচীন , পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক দিওদোরস্ মেগাস্থিনিসের এই মতকে উল্লেখ করে বলেছেন , “গঙ্গানদী গঙ্গারিডি পূর্ব্ব সীমা হয়ে সাগরে মিলিত হয়েছে। ” আবার প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য ভৌগলিক টলেমীর মতে , ” গঙ্গার মোহনার অদূরস্থিত প্রদেশে গঙ্গারিডিগণের বাস। এখানকার রাজা গঙ্গৈ নগরে বাস করেন। সুপ্রাচীন পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ ও ভৌগলিকগণের উক্তি থেকে বেশ মনে হবে যে , বর্তমান ভাগীরথীর পশ্চিম কূল হতে প্রাচীন মগধের পূর্ব্বসীমা পর্যন্ত রাঢ় দেশই একসময় গঙ্গারিডি নামে সুপরিচিত ছিল।
প্লিনি লিখেছেন – ” গঙ্গার শেষাংশ গঙ্গারিডি – কলিঙ্গির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে । ” প্লিনির এই বর্ণনা থেকে অনুমান হয় , কলিঙ্গের উত্তরাংশ বা উৎকলের কতকটা তৎকালে রাঢ়দেশের অন্তর্গত ছিল। কেউ কেউ বলেন গঙ্গারাঢ়ী বা গঙ্গালী গ্রীক উচ্চারণের ফলে গঙ্গারিডি হয়েছে।
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক দিওদোরাস্ বলেছেন -” গঙ্গারিডিগণের নিকট অসংখ্য রণদুর্ম্মদ হস্তী থাকার কারণে কখনো কোনো বিদেশী রাজা তাঁদের পরাস্ত করতে পারে নি। কারণ ভারতবর্ষের বাইরের সকলকেই হস্তী নামক বিশালাকার প্রাণীকে ভয় পেত। ” প্লিনি লিখেছেন – ” সর্বদা ৬০০০০ পদাতি, ১০০০ অশ্বারোহী ও ৭০০ হস্তী সুসজ্জিত থেকে সেই রাজ্যের নরপতির দেহ রক্ষা করছে। সেই রাজ্যের রাজধানীর নাম পর্থলিস বা পরতালিস্।” খ্রিস্টীয় ১ ম শতাব্দীতে পেরিপ্লাস লিখে গিয়েছিলেন -” গঙ্গৈ বন্দর হতে শ্রেষ্ঠ মসলিন, প্রবাল, ও নানা মূল্যবান দ্রব্য রপ্তানী হতো।”
রোমের মহাকবি ভার্জ্জিল খ্রিস্টপূর্ব ১ ম শতাব্দীতে উজ্জ্বল ভাষায় বর্ণনা করেছেন – ” তিনি জন্মস্থানে ফিরে যাবেন । সেখানে গিয়ে তিনি একটি মর্ম্মর মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই মন্দিরের দ্বারদেশে স্বর্ণ এবং গজদন্তের মাধ্যমে গঙ্গারিডিগণের যুদ্ধের অপূর্ব চিত্র ও সম্রাট কুইনিশের লাঞ্ছন আঁকবেন। “
সিংহলের কবি ঐতিহাসিকের মহাবংশ এবং গ্রীক ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা হতেই আমরা বেশ উপলব্ধি করি যে, খ্রিস্টপূর্ব ৬ ষ্ঠ শতাব্দী হতে খ্রিস্টপূর্ব ১ ম শতাব্দী পর্যন্ত রাঢ় দেশ সভ্যতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছিল।
সিংহলের মহাবংশে পাই যে , খ্রিস্টপূর্ব ৬ ষ্ঠ সিংহপুর নামক স্থানে রাল বা লাল বা লাঢ় বা রাঢ়ের অধীশ্বর সিংহবাহু রাজত্ব করতেন। তৎকালে এই স্থানে সিংহের বড়ই পরাক্রম ছিল। ( কুকুরের নয় ) …তা থেকেই অথবা রাজা সিংহবাহুর বীর্য্যবত্তার পরিচয় দেবার জন্য মহাবংশকার রাঢ়াধীশ্বরকে সিংহী দুগ্ধে প্রতিপালিত বলে প্রকাশ করেছেন। সেরগড়পরগণার সিংহরণ নামে যে নদী আছে , কেউ কেউ মনে করেন যে ওই নদীর তীরেই সিংহবাহুর রাজত্ব ও সিংহপুর রাজধানীর অবস্থান ছিল।সিংহপুর কালের নিয়মে ধ্বংস হলে এই স্থানের নাম হয় সিংহারন্য এবং সেই থেকেই সিংহারণ নদী নাম হয়।
তৎপরে গ্রীক ও রোমদের বিবরণী হতে প্রাপ্ত হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪ র্থ হতে খ্রিস্টসীয় ১ ম শতাব্দীর মধ্যে বর্দ্ধমানে পরতালিস্ , গঙ্গৈ ও কাটাদপা নামক তিনটি নগর বা বন্দর ছিল।
ফরাসী পুরাবিদ্ সেল্টমার্টিন বর্তমান বর্দ্ধমান শহরকেই Parthalis বা Portails বলে স্থির করেছেন। এই নামটি দেশীয় #পরতাল শব্দের বিকৃত রূপ। দিগ্বিজয় প্রকাশে সপ্তজাঙ্গলের বিবরণের #বঙ্গাল_পরতালের উল্লেখ আছে। এই প্রসঙ্গ অনুসরণ করলে বলতে হয় যে বর্তমান রাঢ় এবং পূর্ববঙ্গের মধ্যস্থলে #পরতাল বলে কোনো প্রসিদ্ধ স্থান ছিল এবং বিক্রমপুর সেই পরতালরাজের প্রমোদভবন ছিল।
বিদ্বজ্জনানাং ধাসশ্চ বিক্রমপূর্ব্যাশ্চ ভূম্মিশঃ।
পরতালভূমিপস্য তোবিস্থলং বিদুর্বুধাঃ।।
যদি দিগ্বিজয়প্রকাশের পরতাল এবং গ্রীক ঐতিহাসিকগণের Parthalis বা Portails যদি এক হয় তাহলে বর্তমান বর্দ্ধমান শহরকে Portails ধরে নিতে সন্দেহ হয়। যা হোক এই সম্পর্কে আরো অনুসন্ধান আবশ্যক।
গঙ্গৈ বন্দরটি কোথায় ছিল তা এখনো স্থির করা কঠিন। তৎকালে যেখানে গঙ্গাসাগর সঙ্গম ছিল, সেখানে গঙ্গৈ বন্দর হওয়া সম্ভবপর । তৎকালে কণ্টকদ্বীপ >কাঁটাদিয়া> অপভ্রংশে কাটাদপা হয়ে থাকবে এবং এখন তার নাম কাটোয়া।
খ্রিস্টীয় ৭ ম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক রাঢ় অঞ্চলে আগমন করেন। তিনি এই স্থানের সমৃদ্ধির কথা উজ্জ্বল ভাসায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তৎকালীন সুহ্ম বা রাঢ় বা বর্দ্ধমান ভুক্তির একবৃহৎ অংশও কর্ণসুবর্ণ নামে পরিচিত ছিল । তৎকালে এই স্থান বহু জনাকীর্ণ , বহু ধনকুবের ও বিদ্যানুরাগী জনগণের বাস ছিল। তৎকালে এস্থলে ৫০ টি মন্দির এবং ১০ টি বৌদ্ধ বিহার ছিল।
তবে এই কর্ণসুবর্ণ নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে। কেউ বলেন বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি বা কানসোনা নামক স্থানে এই কর্ণসুবর্ণের অবস্থান
ছিল। কেউ বলেন বর্ধমানের নিকটবর্তী কাঞ্চন নগরই কর্ণসুবর্ণে নামক প্রাচীন রাজধানী ছিল।
বলা বাহুল্য এই দুইটি স্থানই এক সময়ে বিশেষ সমৃদ্ধশালী ও রাঢ়ীয় সভ্যতার কেন্দ্র বলে পরিচিত ছিল এবং এখনো উভয়স্থানে সেই অতীত কীর্তির নিদর্শন বিদ্যমান।
উক্ত উভয় স্থান ব্যতীত এই বর্দ্ধমানে সিংহারণ , প্রদু্্যম্নপুর , শূরনগর , মন্দারণ , ভূরসুট প্রভৃতি শত শত স্থানে পূর্ব্ব ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার যথেষ্ট নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১) বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি
২) বর্দ্ধমানের কথা : বর্দ্ধমানের পুরাকথা ও বর্তমান বর্দ্ধমান