ভারত বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কীভাবে মোকাবিলা করছে

গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে বিশ্বকে ত্রাসের শিকার করে রাখা করোনা মহামারী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানব সভ্যতার ওপর সর্ববৃহৎ আক্রমণ। ইতিমধ্যেই ৫ লক্ষ মানুষের এর আক্রমণে মৃত্যু ঘটেছে ও অজস্র মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। অর্থনীতির ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব বিধ্বংসী। চলতি ২০২০ সালের অর্থবর্যে বহু আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলি সমগ্র বিশ্বের উৎপাদন হার ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে আগাম অনুমান প্রকাশ করেছে। এর টাকার অঙ্কে পরিমাণ দাঁড়াবে বিশ্ব জিডিপি-র ১২ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার পরিমাণ ক্ষতি।

আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (ইন্টারন্যাশানাল মনিটারি ফান্ড) এই মহামারীকে ‘দি গ্রেট মনিটারি লকডাউন আখ্যা দিয়ে বলেছে- বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুত্থান নির্ভর করবে কত দ্রুত এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। এইমুহূর্তে ভারত দেশজুড়ে যে লকডাউন চালু রেখেছিল তাকে শিথিল করার দ্বিতীয়পর্ব ‘আনলক টু’ শুরু হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সুচারু রূপে চালু করা। তবে সরকার সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছে যে, এই জরুরি কাজ করতে গিয়ে মহামারী নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে যেন ঢিলে না পড়ে।

একথা বলতেই হবে যে, মহামারী উদ্ভূত যাবতীয় সমস্যার মোকাবিলা ও পরিত্রাণ সরকার সর্বদাই পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করে যথাসম্ভব নাগরিকদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। নাগরিকের জীবন-জীবিকা সর্বদাই সরকারের অগ্রাধিকারে থেকেছে। এর প্রমাণ হিসেবে করোনা আক্রান্ত রোগীর। সংখ্যা দেশে দ্রুত বাড়লেও সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে মৃত্যুর হারে আমরা অনেকটাই আশাব্যঞ্জক স্থানে রয়েছি। একই সঙ্গে আক্রান্তদের সেরে ওঠার হারও আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভালো। সময় থাকতেই ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আন্দাজ করে নাগরিকদের জীবন নিরাপদ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা (লকডাউন) নেওয়াই এর কারণ। সরকার তার অর্থভাণ্ডারের বড়ো অংশই নাগরিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ, চালু হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন, করোনা চিকিৎসাকেন্দ্র ব্যাপক সংখ্যায় তৈরি করা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা বর্ম (পিপিইকিট) এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে করোনা চিকিৎসা করার যোগ্য করে। তোলা সব ক্ষেত্রেই সরকার অতি তৎপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া বিপুল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিয়ে নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎমুখী ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর বহুমুখী রূপরেখার কল্পনা সঠিক শুধু নয়, একমাত্র বিকল্প। ২০ লক্ষ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত। করার খাতে বরাদ্দ হওয়া সমাজের সর্বাপেক্ষা বঞ্চিত ও সহজেই দুর্গতির কবলে পড়া মানুষদের জন্য একটি অতি শুভ প্রকল্প। বস্তুত আত্মনির্ভর ভারতের সাফল্য দাঁড়িয়ে। থাকবে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর — (১) অর্থনীতি, (২) পরিকাঠামো, (৩) টেকনোলজি, (৪) ভৌগোলিক অবস্থান এবং (৫) চাহিদা তৈরির ওপর।

এই আত্মনির্ভরতার অভিযান কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যে করোনা মহামারী থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ নির্দেশ নয়। সামগ্রিক শিল্প ও বাণিজ্য মহলে আত্মবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করা, আমাদের উৎপাদিত পণ্যকে বিশ্বের যে কোনো দেশের সঙ্গে গুণমানে ও মূল্যায়নে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের কৃষি ক্ষেত্রের উৎপাদন বিশ্বের সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত করে কৃষককে বর্ধিত লভ্যাংশ পাওয়ানো। দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি পুঁজি ও প্রযুক্তি আনার পথ সুগম করা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অর্থনৈতিক সাহায্য ও পরিকল্পনাগুলির কারণে যে পরিমাণ খরচ হবে তা ভারতের সামগ্রিক জিডিপি-র শতকরা দশ শতাংশ বলে জানানো হয়েছে।

আত্মনির্ভর ভারতের ডাক দেওয়ার মানে এই নয় যে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দেশকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া। উলটে এর অর্থ বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলে ভারতের আরও বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণ। নিজের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করার অর্থ বিশ্ব রপ্তানি ব্যবস্থায় আরও সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠা যাতে সরবরাহ শৃঙ্খলে অকিঞ্চিৎকর হয়ে না থাকতে হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু নজর রাখতে হবে কী ধরনের পণ্য উৎপাদনে ভারতের দক্ষতা ও সুবিধে বেশি। সেগুলিকে চিহ্নিত করে সফলভাবে উৎপাদন বাড়াতে পারলে অনায়াসে বিশ্ব সরবরাহকারী হিসেবে উঠে আসা যাবে। এটা নিশ্চয় সত্যি আমরা সবকিছু নিজেরা তৈরি করতে পারব না কিন্তু আমরা অনেক কিছুই তৈরিতে সক্ষম যা আমরা এখন করছি না।

এই সূত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রকে ৮টি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হবে। (১) কয়লা, (২) অন্যান্য খনিজ দ্রব্য, (৩) প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন, (৪) অসামরিক বিমান পরিবহণ, (৫) বিদ্যুৎ সরবরাহ, (৬) সামাজিক পরিকাঠামো, (৭) মহাকাশ, (৮) পারমাণবিক শক্তি। সরকার বেসরকারি উদ্যোগে কিছু গন্তব্যে ট্রেন চালানো ও রেলওয়ে স্টেশনগুলির মান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাদের আহ্বান করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ১৫০টি রুটও ঘোষণা হয়ে গেছে। করোনা আক্রমণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী দেশগুলি এর প্রতিষেধক বা চিকিৎসা।

উদ্ভাবনে সকলেই ঝাপিয়ে পড়েছে। এই ভারত বিশ্ব নেতাদের একত্র করে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। প্রত্যেকটি দেশই যে একই মানবতার অংশীদার ও ফলভোগী সেই ‘বসুধৈব কুটুম্বক’-এর আপ্ত বাক্য মোদী অত্যন্ত কুশলতার ১২০টি দেশকে ওষুধ সরবরাহ করে সফলভাবে বোঝাতে পেরেছেন।

এই মহামারীর প্রকোপে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশ্বের জননেতাদের পারস্পরিক সাক্ষাৎকার ও মতবিনিময়ের জন্য বিভিন্ন সম্মেলন ও সফর সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া পারস্পরিক বিবাদ বা সম্পর্কের তিক্ততার ক্ষেত্র তৈরি হলে সেখানে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অনেক সমস্যার চটজলদি সমাধান বেরিয়ে আসত। এখন সেটা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যার হাল করতে কূটনৈতিক স্তরে মতবিনিময় থেমে থাকতে পারে না। বিশ্বের নানা প্রান্তে বিশেষ করে ভারত ও চীনের মধ্যে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে উভয় দেশের মধ্যে —পারস্পরিক আলোচনার অপরিহার্যর্তাকে তা আবার প্রমাণ করছে। আলোচনা চালাতেই হবে, কূটনীতির অত্যাধুনিক পথসন্ধান করে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই হবে। মুখোমুখি দেখা না হলেও ভার্চুয়াল ডিপ্লোমেসি’র সফল প্রয়োগের ফলে বিশ্বের ৮৯টি দেশে ৮২ কোটি টাকা মূল্যের ওষুধ,করোনার টেস্ট কিট, প্রতিরক্ষা বর্ম ইত্যাদি ভারত থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয়, এই বিপদের সময়েও ভারত কিন্তু তার ঘোষিত আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা মেটাতে কোনো খামতি করেনি।

জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সেই সংক্রান্ত সরবরাহ শৃঙ্খল অটুট রাখতে ভারত সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিদেশমন্ত্রক ও তার কূটনীতিকরা সারা বিশ্বকে সফলভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে কোনো নতুন। আবিষ্কার ও তাকে উৎপাদনে পরিবর্তিত করার ক্ষেত্রে ভারত উপযুক্ত লক্ষ্য হওয়ার যোগ্যতাধারী। আমি নিশ্চিত এই প্রচেষ্টা দেশকে সর্বস্তরে শক্তিশালী করবে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্যে করোনার চ্যালেঞ্জকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাব।

হর্ষবর্ধন শৃঙ্গলা

(লেখক ভারত সরকারের বিদেশ সচিব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.