সান জু (সঠিক উচ্চারণ সূন জু) প্রাচীন চীনের একজন প্রবাদপ্রতিম দার্শনিক ও যুদ্ধবিশারদ। কমিউনিস্ট চীন তার লেখা “আর্ট অব ওয়ার’ বইটা বেদবাক্য মানে।
বইটা সবার পড়া উচিত। বিশেষ করে আমাদের ভারতীয়দের। আমাদের দোষ, আমরা সবাইকে নিজের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখি। ‘মানবধর্ম’ নামক আকাশ কুসুমে বিশ্বাস রাখি। সত্যিটা হলো, প্রতিটি জাতি তার নিজের মতো করে ভাবে। একজনের কাছে যেটা অভদ্রতা, অন্যজনের কাছে সেটাই হয়তো ভদ্রতা। তার ভাবনাটা বুঝতে না পারলে তার সঙ্গে বন্ধুত্বও সম্ভব নয়, ভালো করে শত্রুতাও সম্ভব নয়। সান জু-র দুটি শিক্ষা তাই এখানে উল্লেখ করলাম—
(১) প্রতিস্পর্ধীরশক্তি যদি তোমারশক্তির তুলনীয় হয়, তাহলে বন্ধুত্বের পথ খোঁজো। আর যদি প্রতিস্পর্ধীর শক্তি তোমার শক্তির অর্ধেক হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় যুদ্ধের ফিকির খোঁজো।
(২) তোমার ক্ষমতাকে অক্ষমতার আবরণ দিয়ে ঢাকো, অক্ষমতাকে ক্ষমতার আবরণ দিয়ে।
প্রথম বিন্দুটির মানে কী দাঁড়ালো? চীনের সঙ্গে শান্তির একটাই উপায়, চীনের থেকে বেশি শক্তিশালী হওয়া। দ্বিতীয় বিন্দুটির মানে কী? যদি চীন বলে, আমি তোমাকে আক্রমণ করতে পারি, এক সপ্তাহে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করতে পারি, বাষট্টি সালে আমরা হেই করেছিলাম হুই করেছিলাম, জানবেন চীন তার অক্ষমতাকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। সম্মুখ সমরে ভারতের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা ওদের নেই। চীন যেটা বলছে না, ভয় সেখানে। চীন বলছে না, ভারতের মধ্যে ওদের প্রভাব কতটা। কাকে কাকে ওরা কিনে রেখেছে। কটা খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেল ওদের পয়সায় চলে। বলিউডের কটা সিনেমা ওদের টাকায় তৈরি। হিমালয়ের সীমান্ত ধরে দুই দেশের সেনা এখন দাঁড়িয়ে আছে, চোখে চোখ রেখে। দু’জনের শক্তি তুলনীয়। তাই সান জু-র নিয়মানুসারে, যুদ্ধ হবে না। যদি না…ভারতের অভ্যন্তরে গোলমাল বাধে, যার ফলে ভারতীয় সেনার একটা অংশ সেই গোলযোগ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুঝহ লোক, যে জানে সন্ধান!
আমরা আমাদের মতো করে শত্রুকে দেখি, সেটা ভুল। একই ভুল সম্ভবত চীনও করেছে। ওরা ভেবেছিল, আমরা সান জু-কে মানি। তিনশো সৈন্য নিয়ে ত্রিশজন ভারতীয় সৈন্যকে আক্রমণ করলে ভারতীয়রা পালাবে। আত্মসমর্পণের পথ খুঁজবে। ওরা জানতো না, ছোটোবেলা থেকে সান জু নয়, মহাভারত পড়ে বড়ো হয়েছি আমরা। অভিমন্যু আমাদের রক্তে। ভারতের ত্রিশজন যোদ্ধা চীনের তিনশো যোদ্ধার সঙ্গে বীরবিক্রমে লড়ে প্রভূত হানি ঘটিয়েছে।মারতে মারতে মরেছে, মরমেরতে মেরেছে। প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ বাঁচিয়ে পালায়নি। এমনটা হবে জানলে চীন নিশ্চয়ই এতবড়ো ভুল করত না। সেনাপতি ঝাও জংকি নাকি। বলেছিলেন, ইন্দুগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে, তবেই আমেরিকা আমাদের ভয় পাবে। হায় রে ! আমাদের শিক্ষা দিতে এসেছিল, নিজেরাই শিক্ষা পেয়ে মুখ পুড়িয়ে ফিরে গেল। এখন আমেরিকাকে ভয় দেখাবে কী করে? চীনের আজ সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো ওদের ‘এক সন্তান’নীতি। এই নীতির কালে যে শিশুরা জন্মেছিল, তারাই এখন লালফৌজের সেনানী। বেশিরভাগই আলালের ঘরের দুলাল। তারা লড়বে ভারতীয় সেনার সঙ্গে?
বাঘ হলো বাস্তব। ড্রাগন? কল্পনা, ফানুস!
সাম্প্রতিকালে চীনের এক সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সাবধান হওয়া উচিত ভারতের! চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধালে পাকিস্তান ও নেপাল যোগ দেবে চীনের পক্ষে। ত্রিমুখী আক্রমণ সামলাতে পারবে না ভারত। ভেবে দেখুন, যে বিশারদ কথাটা বলেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সান জু-র উপদেশ মেনেই বলেছেন। তার মানে, এটা চীনের শক্তি নয়, দুর্বলতা। চীন ভয় পাচ্ছে, যুদ্ধ বাধলে ভারতের পক্ষে যোগ দেবে জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও আমেরিকা। হয়তো-বা অস্ট্রেলিয়াও। রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকবে। চীনের পক্ষে কে যোগ দেবে? পাকিস্তান ও নেপাল!তাতে চীনের লাভ ক্ষতি, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে!
নেপাল! আমাদের নিজেদের রক্ত , এভাবে শত্রুতা শুরু করেছে, ভাবাই যায় না। সম্প্রতি একটা বই পড়ছি। ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর প্রতিষ্ঠাতা আর এন কাও-এর জীবনী। কাও কীভাবে নিঃশব্দে অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে সিকিমের ভারতে বিলয় ঘটিয়েছিলেন, সেটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এমনটা নেপালের ক্ষেত্রে করা যেত না কি? তাতে নেপালের জনগণ উপকৃতই হতো। শুনেছি ভারতের স্বাধীনতার পর তারা ভারতে যোগ দিতে চেয়েছিল। যেমনটি চেয়েছিল মরুতীর্থ বালুচিস্তান। কিন্তু চাচা নেহরুর মত ছিল না! বিহার রেজিমেন্টের বীর সেনারা যেভাবে চীনা সেনাদের ঠ্যাঙ্গানি দিয়েছে, সেই খবর শত চেষ্টাতেও ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। গর্ব হচ্ছে, বিহার আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য। কিন্তু একটা দুঃখও হচ্ছে। ভারতীয় বাহিনীতে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেজিমেন্ট আছে। বিহার রেজিমেন্ট, মারাঠা রেজিমেন্ট, নাগা রেজিমেন্ট। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আগে ছিল, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ এই রেজিমেন্ট থেকেই শুরু হয়েছিল। সেই রেজিমেন্ট এখন আর নেই। ইংরেজ বলত, বাঙ্গালি বীর জাতি নয়, বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর হবে না! বুড়িবালাম ও চট্টগ্রামে দেখিয়ে দিয়েছিলাম, বীর বাঙ্গালি কাকে বলে। আমাদের বীরত্বে ভয় পেয়ে ইংরেজ এদেশে কমিউনিজম আমদানি করেছিল। যাতে দাস ক্যাপিটাল পড়ে আমাদের দাসভাব বাড়ে, বীরত্ব কমে। কমেনি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার প্রমাণ রেখেছি। তারপরেও কেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট নেই? বলবেন, আঞ্চলিক রেজিমেন্ট তৈরির নীতি ভুল, সেটা ইংরেজ করেছিল আমাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবার জন্য। মানলাম ! তাহলে এখন সবকটা রেজিমেন্ট একসঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হোক না কেন? এক্ষুনি সেটা সম্ভব নয়, তাই না? কবে সম্ভব হবে, সেটাও কেউ বলতে পারে না। তাহলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতে বাধা কোথায়? হুংকারে ‘জয় মা কালী’, কপালে রক্ততিলক, বেঙ্গল । রেজিমেন্ট কাপিয়ে বেড়াক হিমালয় থেকে সুন্দরবন! প্রতাপাদিত্যের চূড়াইল মাঝিদের রক্ত বইছে আমাদের ধমনীতে। মোগল ঠেঙিয়েছি আমরা। পোর্তুগিজদের ভয় দেখিয়ে। তাড়িয়েছি। তাই তো পোর্তুগিজরা যে ইনকুইজিসন পশ্চিম ভারতে করতে পেরেছিল, সেটা এদিকে করার সাহস পায়নি! সেই আমরা বীর নই? এই মিথ্যে কলঙ্ক আর কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে?
পরিশেষে বলি, তিব্বতের সঙ্গে বাঙ্গালির একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। অহিংসা পরম ধর্মের ফল তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ বলে, জমির টুকরো নিয়ে এইহানাহানি কী অন্যায়! তাদেরও তিব্বতে গিয়ে থাকা উচিত। বর্তমান বাংলা হরফের আদি রূপ ‘সিদ্ধম’ হরফ। তিব্বতীয় হরফেরও আদি রূপ ‘সিদ্ধম’। একই ভাষা, একই পরম্পরার আমরা উভয়েই উত্তরসূরি। আমাদেরই ঘরের ছেলে, ঢাকা বিক্রমপুর বজ্রযোগিনী গ্রামের সন্তান অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতের শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু। আমাদের তন্ত্রশাস্ত্র আত্মস্থ করে তিব্বত এক নতুন ধর্ম নির্মাণ করেছে, বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম। সেই তিব্বতীয়রা আজ বড়ো কষ্টে রয়েছে। স্বাধীনভাবে কিছুই করার অধিকার নেই তাদের। নিজেদের দেশটাও আর নিজেদের নেই। লক্ষ লক্ষ হান বংশীয় তিব্বতীয় ভাই-বোনেদের কথা ভুলে যাবেন না। পারলে দু ফোটা চোখের জল ফেলবেন। তাদের জন্য। আর মনে রাখবেন, আজ রুখে না দাঁড়ালে আগামীকাল আমাদের অবস্থাও তিব্বতীয়দের মতোই হতে পারে।
প্রবাল