শিক্ষার ক্ষেত্রে লকডাউনের প্রভাব কী হতে পারে সেই সম্পর্কে পৃথিবীর কারোরই কোনো পূর্বানুমান ছিল না। শিক্ষাক্ষেত্রে এরূপ গাঢ় কালো মেঘ নেমে আসবে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মার্চের প্রথম সপ্তাহেই শিক্ষাক্ষেত্রে সারা দেশেই প্রথম লকডাউন নেমে আসে। চীনের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাই হোক বা আর্থিক দিক থেকে সারা বিশ্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজেকে সুপার। পাওয়ার হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই হোক, সুকৌশলে করোনা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে। ছড়িয়েছে। তখন চীনের একনায়কতন্ত্রী সরকার হয়তো ভাবতে পারেনি কোটি কোটি শিশুকে শিক্ষার অধিকার হতে বঞ্চিত করবার জন্য মহা পাপের ভাগ তাদের নিতে হবে।
যাইহোক, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পড়াশোনা অপেক্ষাকৃত কম হয়। প্রি-প্রাইমারি, প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি ও হাইস্কুল লেবেলে আমাদের দেশে সম্পূর্ণভাবে বিদ্যালয় কেন্দ্রিক পড়াশোনা হয়ে থাকে। প্রি-প্রাইমারি ও প্রাইমারি লেবেলে দেখা যায় শিশুর জীবনের সঙ্গে। বিদ্যালয় একাত্ম হয়ে জুড়ে থাকে। স্কুল তাদের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে পরিগণিত হয়। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর শিশুদের সব আশা, ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ছোটো ছোটো সুন্দর বিদ্যালয়গুলি।
পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে এখানে খেলাধুলা, সংগীতচর্চা, শারীরশিক্ষা, গল্পবলা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর একটি স্বপ্নের জগৎ তৈরি হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে শিশুর কাছে বিদ্যালয় ও তার পরিবেশ স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে।
এতদিন পর্যন্ত সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বিদ্যালয়ের পড়া প্রস্তুত করে, স্নান খাওয়া সেরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য স্কুলভ্যান বা পুলকারের জন্য অপেক্ষা করা বা হইহই করে ছুটে বিদ্যালয়ে যাওয়া এই ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের রোজনামচা। প্রাণচঞ্চলতায় ভরপুর শিশুরা উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সব কাজ করত। মনে হতো শিশুর মানসিক গতি পৃথিবীর গতির থেকে বেশি। কিন্তু এই ক’মাসে সব যেন উলটপালট হয়ে গিয়েছে। মন্দাক্রান্তা ছন্দের মতো ছাত্র-ছাত্রীরা যেন তাদের গতি হারিয়ে ফেলেছে। প্রাণচঞ্চল নদী বনো বড়ো পাথর ও কংক্রিটের মোটা দেওয়ালে বাধা পড়ে বদ্ধ জলাধারে পরিণত হয়েছে।
তবে আশার কথা, ঈশ্বর শিশুদের মধ্যে অপূর্ব তেজ ও শক্তি প্রদান করেছে। মহাভারতের যুদ্ধে অভিমন্যু যেমন সপ্তরথী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন, তদ্রপ আজকের ছাত্র- ছাত্রীরাও তাদের সংকল্পে অবিচল রয়েছে। স্কুলের কলরব নেই, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি নেই, শিক্ষক-শিক্ষিকার তর্জন গর্জন নেই, নিঃশ্বাস ফেলবার বড়ো প্রাঙ্গণ নেই, তথাপি উদ্ভূত পরিস্থিতির বাধা সত্ত্বেও ফল্গুধারার মতো ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রবাহ চলছেই – এটি দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে। ছাত্রানাং অধ্যায়নং তপঃ—মহামারী করোনা সংকটেও এই মন্ত্র যেন সমান সত্য।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের যখন ফোন করি তখন প্রায় প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর একটা কমন আবেদন —স্যার, স্কুল কবে খুলবে? আবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে কবে, আবার স্যার ম্যামরা পড়া শোনাবেন কবে, স্যারেদের মুখে মজার গল্প শোনা হবে কবে, পিটি-ব্যায়াম হবে কবে, জোরদার খেলাধুলা হবে কবে? শিশুর ইচ্ছা কবে পূরণ হবে জানি না। কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রথম পর্যায়ে তাদের উৎসাহ যে ভরপুর – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের বিদ্যালয়ে যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা চলছে তার মোটামুটি রূপরেখা হলো
১. কোনো একটি বিষয় বোঝানো হচ্ছে। তারভিডিয়ো রেকোডিং করে হোয়াটসঅ্যাপ বা ইউটিউবের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট পাঠানো হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। কোনো ছাত্র-ছাত্রীর কোনো প্রকার প্রশ্ন থাকলে তা গ্রুপে পোস্ট করা হচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আবার তৈরি করে গ্রুপে পোস্ট করছেন। বিভিন্ন মিটিং অ্যাপের মাধ্যমে সব ছাত্র-ছাত্রীকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়েও. পড়াশুন চালানো হচ্ছে।
২. জটিল ও কঠিন প্রশ্নের উত্তর শিক্ষক-শিক্ষিকা নিজে হাতে লিখে বা টাইপ করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রুপে। পোস্ট করছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সব প্রশ্নের উত্তর বার বার পাঠ করছে, মুখস্থ করছে, আত্মীকরণ করছে। অপর দিকে ছাত্র-ছাত্রীরাও হোম ওয়ার্ক তৈরি করে লিখে । ফেলছে এবং তার ছবি তুলে। শিক্ষক -শিক্ষিকাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে তা আবার ছাত্র-ছাত্রীদের ফোনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
৩. পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা, পার্বিক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে থাকে। প্রায় প্রতিমাসেই কোনো না কোনো পরীক্ষা হয়ে থাকে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে সিল প্যাক করা প্রশ্নপত্র অভিভাবকের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার নির্দিষ্ট দিন ও নির্দিষ্ট সময় প্যাক খুলে শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে এবং উত্তরপত্রটি আবার বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরাই বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পরীক্ষার সময় ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট উপস্থিত থাকছেন ও পরীক্ষক হিসেবে খাতাতে সই করছেন।
৪. কোনো কোনো বিদ্যালয় আবার অনলাইনেই নির্দিষ্ট সময় প্রশ্নপত্র পাঠাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তর লিখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছবি করে অনলাইনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। স্কুল কতৃপক্ষ উত্তরপত্রটির প্রিন্টআউট করে নিয়ে মূল্যায়ন করছেন।
৫. বেশকিছু বিদ্যালয় আবার অনলাইন মিটিং অ্যাপের মাধ্যমে সব ছাত্র-ছাত্রীকে একসঙ্গে জুড়ে নিয়ে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন করছে।
যে ব্যবস্থার কথা আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম এই ব্যবস্থার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিল না। হঠাৎ করে সম্পূর্ণ এক নতুন ব্যবস্থা অনলাইনে পঠনপাঠন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এসে হাজির হয়েছে। নতুন কোনো ব্যবস্থাকে আত্মীকরণ করতে সময় লাগে। শিশুরা কিন্তু সেই সময় পায়নি। তাই তাদের জীবনে এই ব্যবস্থার প্রভাব সুখকর বলে আমার মনে হচ্ছে না। তারা হয়তো উৎসাহের সঙ্গে ব্যবস্থাটি গ্রহণ করে নিচ্ছে কিন্তু শারীরিক ও মানসিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বর্তমানে বেশ কিছু শিশুর ইমিউনিটি পাওয়ার বেশ কম। এ কারণে মোবাইল। থেকে নির্গত রেডিয়েশনের প্রভাব শিশুর । শরীর ও মনে কতটা ক্ষতি করতে পারে তা আবার নতুন করে গবেষণার বিষয় হতে পারে। মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটর বেশি ব্যবহার করার ফলে শিশুর চোখ দিয়ে জল পড়তে পারে, মাথা ব্যথা হতে পারে, ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে, মাথা ঘুরতে পারে। এ কারণে অনলাইন পঠনপাঠন চলার সময়
মা-বাবাকে বা অভিভাবককে শিশুর কাছে বসতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, তার চোখ ও শরীরের দিকে। কোনো প্রকার উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এরকম পরিস্থিতি হলে কলম ধরতে হবে বাবা-মা বা অভিভাবককে। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রেরিত নোটপত্রগুলি লিখে দিতে হবে বাড়ির বড়োদের। চোখের সঙ্গে সঙ্গে কানও এক্ষেত্রে বিকল হতে পারে। হেডফোনের অধিক ব্যবহারের ফলে শ্রবণ সমস্যা হতে পারে। বেশিরভাগ হেডফোন এয়ার টাইট। এ কারণে কানে বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। এতে ঝুঁকি থেকেই যায়। হেডফোন থেকে সৃষ্টি তরঙ্গ মস্তিষ্কের জন্য গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই অসুবিধাগুলি দূর করবার জন্য ব্লুটুথের সঙ্গে সাউন্ড বক্স যুক্ত করে শিশুদের পড়া শোনানো উচিত। কিন্তু ব্লুটুথ হেডফোনের ব্যবহার একেবারেই নয়।
তবে সব থেকে যেটি চিন্তার বিষয় তা হলো অনলাইন পঠন-পাঠনের জন্য শিশুর মানসিক প্রভাব। তাদের মধ্যে যদি এই ধারণা জন্মায় আর কোনোদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া যাবে না, এই ভাবেই থাকতে হবে বছরের পর বছর, তবে শিশু খিটখিটে ও জেদি হতে পারে, আবার ঝিম ধরে থাকতে পারে। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য বাবা-মাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাবা-মা-ই এখন তাদের বন্ধু , শিক্ষক-শিক্ষিকা ও খেলার সাথী। শিশুর সুকমল মনটি যদি মোবাইল ট্যাব বা কম্পিউটরের দাসে পরিণত হয়ে যায় তবে সমূহ বিপদ।
আর একটি কথা, অনলাইন পঠনপাঠন মানেই নেট কানেকশন। এর ফলে শিশুর কাছে অনভিপ্রেত কোনো লেখা বা ভিডিয়ো পৌঁছে যায় তবে উপকার থেকে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি ইউরোপ আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলিতে বহু আগে থেকেই অনলাইন পঠনপাঠন ব্যবস্থাটি আংশিক রূপে রয়েছে। ফলে ওইসব দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণে কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা ও উদ্ভাবনী প্রতিভা বেশি। অন্যদিকে, সেই সব দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, অপরাধ প্রবণতা, যৌন প্রবণতা, কিশোর মাতৃত্বের প্রবণতা বেশি। তাই আমরা আমাদের সুকোমল শিশুদের মহাবিপদের দিকে যাতে ঠেলে না দিই সেদিকে কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে—
১. অনলাইন পাঠনপাঠনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে।
২. অনলাইন ক্লাস চলার সময় অভিভাবক বা অভিভাবিকাকে পাশে বসতে হবে।
৩. মোবাইল ট্যাব বা কম্পিউটরের গুণমান অর্থাৎ ছবি ও সাউন্ডের কোয়ালিটি যাতে ভালো থাকে তা দেখতে হবে।
৪. বিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলা যাতে এক থেকে দু ঘণ্টার বেশি অনলাইন ক্লাস না করে।
৫. শিশুর চোখ ও শারীরিক পরীক্ষা যাতে তিন মাসে অন্তত একবার করানো হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
৬. বাড়িতে প্রিন্টার মেশিন অবশ্যই রাখুন, সরাসরি মোবাইল বা ট্যাব থেকে প্রশ্নোত্তরগুলি না লিখে সেগুলিকে প্রিন্ট করে দিন।
অবশেষে বলতে হয় দুর্যোগ কেটে যাক, করোনামুক্ত সূর্য উঠুক। আবার বিদ্যালয় খুলুক, ছাত্র-ছাত্রীরা তার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীকে খুঁজে পাক। বিদ্যালয়ের পরিবেশে ও সংস্কৃতিতে ছাত্র-ছাত্রীরা আবার ফিরে আসুক। অনলাইন পড়াশুনা আলআউট হোক। তবে না চাইলেও আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে মোবাইলের কিছুটা দাসত্ব করতেই হবে। আমার মনে হয়, করোনা পরবর্তী বিশ্বেও অনলাইন পঠনপাঠন কিছুটা চালু থাকবে। তাই অনলাইন পড়াশুনার বিষয়ে আরও গবেষণা দরকার, আরও পরিকল্পনা দরকার।
রাজু কর্মকার
(লেখক প্রধান শিক্ষক, বীণাপাণি বিদ্যাপীঠ, কালিয়াচক, মালদহ)