সারা ভারতের সঙ্গে এ রাজ্যেরও সব ক্লাসরুম মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। ছাত্র-ছাত্রীরা, শিক্ষকশিক্ষিকারা সব ঘরে। আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন সময় আসেনি যখন এতদিন ধরে সব শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রাখতে হয়েছ। মহামারী ও মড়কে এদেশ বার বার বিধ্বস্ত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে। ম্যালেরিয়া, কলেরা, অজানা নানা জ্বর বার বার গ্রাম-নগর-জনপদকে উজাড় করে দিয়ে গেছে। কিন্তু তার জন্য এতদিন ধরে শিক্ষাঙ্গন, গুরুগৃহ, টোল কি বন্ধ ছিল? মনে হয় না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষালয়ে আসা হয়তো কমে গিয়েছিল, হয়তো কিছুদিনের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থেকেছে, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সেগুলো বন্ধ থাকেনি। করোনা মহামারী সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই সময়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে। বড়ো অসহায় এখন আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কখন আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খলবে, সেগুলো আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত ও জীবন্ত হয়ে উঠবে, স্টাফরুমগুলো আবার গমগম করবে— এই আশা,আশঙ্কা নিয়ে আমরা বসে আছি।
হ্যা, ছাত্র-ছাত্রীরাই এখন সব থেকে বড়ো অসহায়। আগামীদিনের চিন্তা এই কম বয়সেই যেন তাদের উপর চেপে বসেছে। এ রাজ্যে ১০ লক্ষের বেশি ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। আশার কথা, তাদের পরীক্ষা সম্পূর্ণ হতে পেরেছে। কিন্তু রেজাল্ট তো বেরোচ্ছে না। রেজাল্ট হয়তো তৈরি হয়ে আছে। সরকারের সম্মতি এলেই তা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সে সম্মতি আসছে না। শিক্ষামন্ত্রী একটা। নিদারুণ বাস্তব কথা বলেছেন— রেজাল্ট বের করেই কী হবে! তারা ভর্তি হতে কোথায় যাবে? সব স্কুল তো বন্ধ। এই অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যতের চিন্তা মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের ক্রমশ গ্রাস করছে।
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীদের তো অবস্থা আরও করুণ। তাদের পরীক্ষা সম্পূর্ণ করাই গেল না। শুধু এ রাজ্যেই নয়, সারা দেশে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে বাকি পরীক্ষাগুলো আর নেওয়া গেল না। যে পরীক্ষাগুলো হতে পেরেছে তার মধ্যে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে অসম্পূর্ণ বিষয়গুলোর নম্বর দেওয়া হবে। এভাবে নম্বর পেয়ে অনেকে খুশি হতে পারে, অনেকে আবার অখুশি। যদিও অখুশিদের জন্যও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কিন্তু তা কখন সম্পূর্ণ হবে তা আপাতত অনিশ্চিত। এরকমভাবে প্রাপ্ত নম্বরে কি শান্তি আসে? এতদিন ধরে তারা পড়াশোনা করল, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল না। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এর মাধ্যমেই তাদের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কেউ যায় প্রথাগত বাণিজ্য, কলা বা বিজ্ঞানশাখার উচ্চবিদ্যাচর্চায়, কেউ বা কারিগরি কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসে এবং তা উত্তীর্ণ হলে নির্দিষ্ট শাখায় চলে যায়। এই প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলোও কখন কীভাবে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরীক্ষাগুলো না নেওয়া গেলে শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, দেশও এক বড়ো সমস্যায় পড়বে। প্রধাগত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম ব্যাচগুলো কীভাবে নির্দিষ্টহবে তা স্থির করা যেন এক বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার মধ্যে আছে ১০+২-এর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবকেরা এবং অবশ্যই দেশের সরকার।
ইউ জি সি-র নির্দেশিকা অনুযায়ী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র-ছাত্রীদের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন এবং আগের সেমিস্টোরে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে রেজাল্ট তৈরি করার কাজ চলছে। লিখিত মূল পরীক্ষা এদের ক্ষেত্রেও বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ ছয় মাস কয়েকটি বিষয়ের পড়াশোনা করার পরেও তার পরীক্ষা দিতে পারল না ছাত্র-ছাত্রীরা। এর যে কী কষ্ট তা ওই ছাত্র-ছাত্রীরাই জানে, অন্য কেউ নয়। তাদের কাছে নম্বরই সব নয়।
করোনা এমন একটি মহামারী তাতে একত্র সমাবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এই সমাবেশ আবার যদি একটি ঘরের মধ্যে হয় তাহলে তার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এই আশঙ্কার দিকে লক্ষ্য রেখেই ক্লাসরুম খুলতে সরকার ভয় পাচ্ছে। তাই ক্লাসরুমের তালা আবার কখন খুলবে, খোলা উচিত— এটাই। এখন দেশের সব থেকে বড়ো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রশ্ন, সংশয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের সব থেকে সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ কিশোর-তরুণ-যুবকরা আজ যেন খানিকটা দিশাহীন।
এই নিবন্ধ লেখকের মেয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়াশোনার রুটিনের মধ্যেই সে থাকে। বাংলা, ইতিহাস, ইংরেজি, গণিত একের পর এক পড়াশোনা আর লেখালেখির মধ্যেই তার দিন কেটে যায়। শুধু আমার মেয়ে বলে নয়। সে তো এ রাজ্যের, এ দেশের কোটি কোটি এ ধরনের ছাত্র-ছাত্রীর প্রতীক। সে যে কেউ হতে পারে। তারা পড়াশোনা করছে এবং সবাই প্রায় গৃহবন্দি। বাইরের খেলাধুলাও এখন প্রায় বন্ধ। তবে হ্যা, বর্ষার সময় চলছে। গ্রামগঞ্জে এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা পরিবারের লোকেদের সঙ্গে এখন চাষের কাজে হাত লাগাবে। শিক্ষকতার চাকরিতে দেখেছি এই সময় ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা কমে যায়। কারণ তারা চাষের কাজ করে। তাহলে এখন বিষয়টা এরকম— স্কুল কলেজ সব বন্ধ, ছাত্র-ছাত্রীরা আপাতত চাষ করছে। বিষয়টা ভাবতে খুব একটা ভালো লাগছে না।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি গত প্রায় চারমাস ধরে বন্ধ। ধুলো পড়ছে বিদ্যাচর্চাকেন্দ্রগুলোর বারান্দায়, ক্লাসঘরে, বেঞ্চ-ডেস্কে, চেয়ারে-টেবিলে। এগুলো যদি কোনো প্রাণবান সত্তা হতো তাহলে তাদের অসহায়তাও যেন তারা অনুভব করত। ক্লাসের বেঞ্চ-ডেস্কগুলো হয়তো ডাকতো তাদের উপর প্রতিদিন ঠেলাঠেলি করে বসা শিশু কিশোর থেকে তরুণ যুবাদের। স্পষ্ট অনুভব করত তাদের হইহল্লা, দাপাদাপি। ঢাকতে লাইব্রেরির বইগুলো, সেলফগুলো, অ্যাটেনডেন্স খাতাগুলো, কালো কালো বোর্ডগুলো। বর্ষার জল পেয়ে স্কুল কলেজের মাঠে মাঠে জন্মাল ঘাস। সেখানে আর খেলে না ছেলে-মেয়েরা। যে মাঠগুলোকে মনে হত রুক্ষ কাকুরে ডাঙা সেগুলো এখন কচি কচি সবুজ ঘাসে ভরা। স্কুল-কলেজের বাগানে উদ্যানে ঝোপ জঙ্গল আগাছা।মিড ডে মিলের রান্নাবান্না আর গরম খাবার পরিবেশন করতে করতে যে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা এক সময় হাঁপিয়ে উঠতেন, তাঁরাও এখন কর্মহীন। হয়তো তাদেরও ডাকছে সেই কচি কচি মুখগুলো যারা গরম ডাল ভাত খেয়ে ভরা পেটে খুশি হয়ে উঠত। স্কুল কলেজের গেটে গেটে টিফিন সময়ে যেসব কাকু মাসিরা আলুকাবলি, ঘুগনি, ফুচকা, চটপটে ভোলামশালা নিয়ে রোজ হাজির হতেন তারাও কাজ হারিয়েছেন। হয়তো জীবিকার প্রয়োজনে অন্য কোনো উপায় বের করেছেন তারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন তাদেরও হয়তো ডাকছে সেইসব তালা দেওয়া বড়ো বড়ো গেটগুলো। স্টাফরুমগুলোর সারি সারি চেয়ারে, লম্বা বড়ো টেবিলে যেখানে প্রায়ই নানা মতের, নানা তর্কের তুফান উঠত সেখানে আজ অদ্ভুত নীরবতা। গৃহবন্দি শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও হয়তো এই স্টাফরুমগুলো ডাকছে। কতদিন আর ঘরে বসে থাকা যায়! এই অন্তবিহীন ছুটি আর কারই বা ভালো লাগে!
করোনা মহামারী থেকে আর্থিক ক্ষেত্রকে বাঁচানোর জন্য সরকার বহু পরিকল্পনানিয়েছে। শুরু হয়েছে সব ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে আনলক পর্ব। বহু অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এখনো লক বা তালাবন্ধ শিক্ষাক্ষেত্র। এর সঙ্গেই যুক্ত আছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দেশের সেরা মানবসম্পদ। এই ক্ষেত্রকেও কীভাবে খোলা যায় সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই ভাবনাচিন্তা চলছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুত এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই ক্ষেত্রকেও খোলা হবে। অনলাইনের নানা কোর্স ভালো। এই সংকটের সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তত সে সম্পর্কে খানিকটা জেনেছে। কিন্তু তার বহু সীমাবদ্ধতা। মুক্ত বিদ্যাচর্চার জন্য শিক্ষাঙ্গনগুলো যাতে শীঘ্র খোলা যায় আমরা সেই আশা করতেই পারি। কারণ সেগুলো এবার আমাদের ডাকছে।
গৌতম কুমার মণ্ডল
(লেখক পুরুলিয়ার নেতাজী সুভাষ আশ্রম মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক)