বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস যখন মহামারী রূপে সমাজজীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে তখন শিক্ষাঙ্গনও যে এই ভয়ংকর রোগের কবলে পড়তে বাধ্য, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দীর্ঘ চার মাস ধরে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা বাড়িতে চুপচাপ বসে কাটাচ্ছেন। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় অকালে অচলাবস্থা নেমে আসবে কেউ কোনোদিন ভাবতে পারেনি। দীর্ঘ লকডাউনে শিক্ষাব্যবস্থায় যে ফাটল ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কীভাবে পূরণ হবে, এখন সেটাই সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ।
রাজ্যের সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, শিকেয় উঠেছে নিয়মিত ক্লাস ও পড়াশোনা। অথচ শিক্ষাবর্ষের ক্যালেন্ডারের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সিলেবাসের চোখরাঙানি। অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে পঠনপাঠন চালাচেছ যাকে বলে ভাচুয়াল ক্লাস। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার দৌলতে এত দুর্যোগের মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা হলেও গ্রামীণ ভারতের এক বিরাট সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী আজ পঠনপাঠন থেকে বঞ্চিত। থাকছে। সরকার যতই বলুক অনলাইনে পাঠদানের ফলে শিক্ষায় কোনও আঁচ লাগেনি। বাস্তব অন্য কথা বলে। ইউনিসকোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনা মহামারীর প্রকোপে বিশ্বজুড়ে ১৯১টি দেশের ১৫৭ কোটি ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা গ্রহণ প্রভাবিত হয়েছে, তার মধ্যে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩২ কোটি।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলগুলোতে এমনিতেই পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষকের অভাব রয়েছে, তার ওপর এই কোভিড-১৯-এর ছোবল, ইন্টারনেট সব জায়গায় নেই। ফলে অনলাইনে বেশিরভাগ গ্রামীণ ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা হচ্ছে না। এছাড়াও লকডাউনের ফলে বেশিরভাগ গৃহশিক্ষক আর টিউশনি করাচ্ছেন না, যার ফলে সবচেয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে গ্রামের নিরক্ষর পিতা-মাতার সন্তানরা। শিশু শ্রমিক ও স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত স্কুলমুখী করার জন্য সর্বশিক্ষা অভিযানের আওতায় দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিড ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছিল। ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সারাদেশে ১২ কোটি শিক্ষার্থী (মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ) এই প্রকল্পে উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আবার শিশুশ্রম ও স্কুলছুটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। যদিও লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকায় সরকারি নির্দেশে রান্না করা খাবারের পরিবর্তে চাল, ডাল ও আলু দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তার জন্য গ্রামে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্ররা অনেকেই অভাবের তাড়নায় শ্রমিক হিসেবে কাজ যেতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে বাল্যবিবাহ দীর্ঘদিন থেকে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। গ্রামের নিরক্ষর পিতা-মাতারা বোঝা কমানোর জন্য ও ইসলামি শরিয়ত প্রথা মোতাবেক ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে দিতে আগ্রহী থাকে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনের মধ্যেও এই বাল্যবিবাহের হার বহুগুণ বেড়ে গেছে।
কলেজ বন্ধ থাকায় এবং বাড়ির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেক কলেজ-ছাত্রকে সবজি ও ফলমূল বিক্রি করতেও দেখা গেছে। বর্ষায় কৃষিকাজের মরসুমে নিজেদের দু’চার বিঘা জমিতে চাষ করতে বা মজুর হিসেবেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রক যে নির্দেশ দিয়েছে সেখানেও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। পঠনপাঠনের উপর ভিত্তি করে গড় নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করার কথা বলা হলেও এই মূল্যায়ন কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেসরকারি স্কুল ও কলেজগুলোতে জনগণের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ফি বৃদ্ধি না করার জন্য সরকার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না বলেই জানা গেছে। এদিকে জুলাই মাসের মিড ডে মিলের চাল, ডাল ও আলুর সঙ্গে তিনবারের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এতদিনে অর্থাৎ আগস্ট মাস পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের তিনটি পরীক্ষা দিতে হতো, তাই এখন তাদের এই প্রশ্নপত্রের উত্তরপত্র বাড়িতে তৈরি করেই পরে বিদ্যালয়ে জমা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। এককথায় এবারে সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই এভাবে পাশ করিয়ে দেওয়ার ফলে শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। কিছু করার নেই, এভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আগামীদিনে বয়ে নিয়ে যেতে হবে মনে হচ্ছে। কেননা স্কুল খুললেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যানসিং বজায় রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের বসানো হবে তা এখনই বোধগম্য হচ্ছে।
। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও একই প্রশ্ন, হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী কীভাবে একসঙ্গে বসে দূরত্ব বজায় রেখে পরীক্ষা দেবে? সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় এই করোনা মহামারীর এক সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। যেহেতু করোনার প্রকোপ এখনো কতদিন আমাদের দেশে থাকবে, বিধি মেনে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কতদিন একসঙ্গে শিক্ষার্থীরা মেলামেশা করতে পারবে না তা জানা যাচ্ছে না। তাই আগামীতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করতে হবে বলে মনে হয়।
সবশেষে, করোনা পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা ভাবে মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি বিচার করা দরকার। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি এসেছে। সেক্ষেত্রে তারা বড়োদের মোবাইলে গেম ও কার্টুন দেখে কিছুটা সময় কাটাতে গিয়ে পাবজির’মতো মারাত্মক নেশার কবলে পড়ছে। কলেজের ছাত্ররা দীর্ঘদিন বাড়িতে গৃহবন্দি থেকে বিভিন্ন প্রকার ড্রাগে আশক্ত হয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছে। এমতাবস্থায় কাউন্সিলিং সেন্টার তৈরি করে প্রতিকারের জরুরি ব্যবস্থা করা দরকার।
স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন মনীষীর জন্মদিন পালন করার ক্ষেত্রে এখন আর আগের মতো জমায়েত বা একত্রিত হয়ে উৎসব করা যাবে না। সেক্ষেত্রে ভার্চুয়াল পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আর সেইসঙ্গে মুখে মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটাচলার অভ্যাস সকলকে গড়ে তুলতে হবে।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আর আগের মতো হইচই, আড্ডা দেওয়া ও ভিড় জমানো যাবে না। যতদিন না পরিবেশ পরিস্থিতি ঠিক হচ্ছে শিক্ষাকে ব্যক্তিগতভাবে দক্ষতা ভিত্তিক ও সৃজনশীল হতে হবে। মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাই হবে করোনা পরবর্তী পৃথিবীর একমাত্র ব্যবস্থা।
তরুণ কুমার পণ্ডিত
(লেখক মালদহ জেলার কমলাবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক)