করোনার বেড়াজালে শিক্ষাও আজ সংকটের সম্মুখীন। মার্চ মাস থেকে। লকডাউনের ফলে সমস্ত শিক্ষালয় বন্ধ। শিক্ষার্থী আসেনা, শিক্ষক-শিক্ষিকা আসেন না, শিক্ষা কর্মীরাও নন। একা বিদ্যালয় ভবন দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও হয়তো পাহারাদার আছে, কোথাও নেই। করোনার আক্রমণে এধরনের প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ ছাড়া যে বিকল্প কোনো পথ নেই বা ছিল না একথা প্রকৃত সত্য। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র, যেখানে সরকারের ইতিবাচক, নিরপেক্ষ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তার অভাব এবং সহজে আত্মপ্রচার লাভে ইচছুক কিছু রাজনীতিবিদ বা অত্যুৎসাহী চিন্তাবিদদের সিদ্ধান্ত, কথা, প্রচার ইত্যাদি শিক্ষার পরিবেশকে নিত্য জটিল করে তুলছে। যেহেতু আমি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, তাই এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি তথ্য ও পরিস্থিতির উপলব্ধির কথা তুলে ধরছি।
সারাদেশে দু’প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে। সরকারি ও বেসরকারি। বেসরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও দু-প্রকারের। সরকারি অনুদান প্রাপ্ত ও সরকারি অনুদান বিহীন বিদ্যালয়। সারাদেশে প্রায় চার লক্ষের মতো এরকম প্রাইভেট স্কুল বর্তমান, যেখানে ৭.৯ কোটি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০ হাজারের কিছু বেশি এমন বেসকারি বিদ্যালয় রয়েছে। সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে অবজ্ঞা করার মতো নয়। তাছাড়া এদের অবদানও কম নয়। নতুবা সরকারি স্কুল ছেড়ে ছাত্র-ছাত্রী বেসরকারি স্কুলে কেন যাচ্ছে! অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে কিছু সরকারি নির্দেশ বা পরামর্শ, রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য, কিছু মানুষের অবিবেচনা প্রসূত মন্তব্য প্রাইভেট স্কুলগুলির পক্ষে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে (১) করোনার এ সময়ে কোনো ফিজ বৃদ্ধি চলবে না।(২) শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনে ছাড় দেওয়া হোক। স্কুল বন্ধ বেতন কেন দেব? (3) শিক্ষার্থী স্কুলে আসে না অতএব স্কুল বাসের পয়সা কেন দেবে? এ বিষয়ে আলোচনার পূর্বে একটা বিষয় আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এই প্রাইভেট স্কুলগুলি দুটো তিনটে ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে অভিভাবকরা পড়ান। এগুলো অতি উচ্চবিত্ত স্কুল। সাধারণত ইংরেজি মাধ্যমেই এখানে পড়ানো হয়। এধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত কোনো পারিবারিক ট্রাস্ট বা কোনো করপোরেট সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এরকমই স্তরে স্তরে আছে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত স্কুল। সমাজের মধ্যে আমাদের মানুষের স্তর যেমন একেবারে তেমনি। মজার কথা, সমালোচনা যে যাই করুক এই সমস্ত উচ্চবিত্ত স্কুল না থাকলে মন্ত্রী, নেতা, কোটিপতিদের সন্তানরা কোথায় পড়বে! তারা তো শপিং সেন্টার ছাড়া কেনাকাটার জন্য সাধারণ দোকানে যান না। একরকম হলেও কম দামের গাড়িতে চড়বেন না, ব্যাপারটা এরকমই আর কি। এ সমস্ত বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চমহলের নিবিড় যোগাযোগ থাকে। অতএব এই হাই প্রোফাইল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরদিনই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই আলোচনার মধ্যে এদের নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা আমি করব না। তাছাড়া কিছু স্কুল আছে সংখ্যালঘু সুযোগ সুবিধার আড়ালে, তাদের নিয়েও আপাতত বলার কিছু নেই। পক্ষান্তরে দেখা যায় দেশের সব নিয়মকানুন, দুরবস্থার কোপ সরাসরি যেমন এসে পড়ে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষের উপরে, ঠিক তেমনি সরকারি যত নির্দেশাবলী নিয়মাবলীর কোপ এসে পড়ে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত প্রাইভেট স্কুলগুলির উপরে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন এখনও দুশো- তিনশো থেকে হাজারের মধ্যে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা পান তিন-চার হাজার (এখনও) থেকে দশ, বারো, পনেরো হাজারের মতো। করোনার আবহেমানুষের দুরবস্থার মধ্যে নতুন কোনো ফিজ বৃদ্ধি বা নেওয়া উচিত নয়, এটা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত এবং ঔচিত্যপূর্ণ। কিন্তু বেতন না দেওয়ার বিষয়ে যুক্তি কোথায়! কারো কোনো অসুবিধা থাকলে প্রতিটি স্কুলেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য বিবেচনা করে ছাড় দেওয়া হয়। সে তো এখনোও হতে পারে। কিন্তু কেউ দেবেন না বা দেব না —এ কীরকম যুক্তি! তাছাড়া একশোজনের মধ্যে একশোজনই কী দুরবস্থাগ্রস্ত, এটা কী বাস্তব! তাহলে যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা দিচ্ছেন না কেন বা টিউশন ফিজ দেবেন না কেন? তাঁরা দিলে পরে বিদ্যালয়ের যেমন সহযোগিতা হয় তেমনি যারা প্রকৃত অসমর্থ পরোক্ষভাবে তাদেরও সহযোগিতা করা হবে। বিষয়গুলি অবশ্যই ভাববার মতো। শিক্ষার্থী বেতন না দিলে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন, কর্মীদের বেতন বন্ধ করে দিতে হবে। ছাঁটাই করতে হবে অনেককে। যা সরকারের পক্ষ থেকেও বার বার না করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এই শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যে সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়েন। তাঁদেরও তো পরিবার চালাবার প্রয়োজন। অথচ এদের থেকেই বহু বিদ্যালয় লকডাউনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে সাধ্যমতো অর্থ দান করেছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের সামান্য বেতন থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আশেপাশের সমস্যাগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিলি করেছেন। প্রসঙ্গত এটাও সত্য যে, এমনও অনেক অভিভাবক আছেন যাঁরা নিজে শিক্ষার্থীর বেতন বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন, অনলাইন ব্যবহার করেছেন। তাহলে টিউশন ফি দিতে হবে না, দেব না – এসব কথার মধ্যে কী যুক্তি আছে!
দ্বিতীয়ত, বাসের টাকা দেব কেন? আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ঠিক, গাড়ি না চললে পয়সা কেন? কিন্তু একটু ভাবলে দেখা যাবে এই বাস বা পরিহহণগুলি যা সারাবছর পরিবহণের জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। এই সমস্ত বাসের সাধারণ রুটে চলার কিন্তু অনুমতি থাকে না। তাহলে এদের যে নিয়মিত খরচ ড্রাইভার, ক্লিনার, ইনসিওরেন্স, রুট ট্যাক্স ইত্যাদি কে ছাড় দেবে? শুধু তেলের খরচ লাগে না। যাদের গাড়ি, বাস রয়েছে লকডাউনে তারা এই হিসাবটা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। তাই এক্ষেত্রে তিরিশ শতাংশের কম-বেশি ছাড় দেওয়া যেতেই পারে, আর তা যতটা জানি অনেক স্কুল বা বাস মালিক ছাড় দিচ্ছেনও। কিন্তু দেব না বা দিতে হবে না বলে এসব উস্কানিমূলক মন্তব্য করে বিরূপ পরিবেশ তৈরির পেছনে অবশ্যই কোনো স্বার্থান্বেষীর হাত রয়েছে। আর সত্যি কথা হলো, দেওয়া, না দেওয়া, ছাড় সর্বত্র একই রকম হতে পারে না। এগুলো পারস্পরিক আলোচনার বিষয়। তবে এসমস্ত ক্ষেত্রে সরকার যদি কোনো ভরতুকি দিয়ে সহযোগিতা করেন তাহলে বলার কিছু নেই।
অনলাইনে শিক্ষা : করোনার এই সংকটকালে লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে বেশিরভাগ বেসরকারি স্কুল অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। মূলত, হোয়াটস অ্যাপ ভিত্তিতেই এই ক্লাস হয়। এর সঙ্গে ভিডিয়ো, অডিয়ো কনফারেন্স, ভিডিয়ো কনফারেন্সের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বহু স্কুলে ৯০ থেকে ১০০ ভাগ শিক্ষার্থীই এই শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাদের এই পদ্ধতি বিষয়ে দু’মাসে নিজেদের মধ্যে অনেক উন্নতি ঘটিয়েছেন। কোথাও কোথাও বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানে ই-কনটেন্ট নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা হচ্ছে। নিয়মিত পরিবর্তিত শিক্ষাদান ব্যবস্থায় নিজেকে উপযুক্ত তৈরি করা নিত্যকার শ্রেণীকক্ষে পাঠদান থেকে বেশ কঠিন ও পরিশ্রমের বলেই আমার মনে হয়। তবুও তাঁরা মাসান্তে সামান্য কিছু যে বেতন পান তার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের চেষ্টা। অথচ সরকারি স্কুলে অনলাইন শিক্ষায় তেমন কোনো উদাহরণ নেই, কিছু টিভি চ্যানেলের ক্লাস ছাড়া। প্রাইভেট স্কুলে সাতশো বা হাজার টাকা বেতন নিলে সরকার বা অনেকে প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু সরকারের ছাত্রপিছু মাসে ৬ হাজার টাকার কম-বেশি খরচ হয়ে থাকে – সাধারণ মানুষ এ হিসাব করেন না বা জানেন না। এগুলোতে সাধারণ মানুষেরই টাকা, তাহলে সরকারি স্কুলে পঠন-পাঠনের এই দুরবস্থা কেন? কেন গরিব মানুষের ছেলেরা দুশো টাকা দিয়েও একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না, আর সরকার মাথাপিছু এতটাকা খরচ করবে!তাই দেশ জুড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে আওয়াজ উঠছে শিক্ষাখাতে প্রাপ্ত টাকা সরাসরি শিক্ষার্থীকে দেওয়া হোক ডিবিটি (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) পদ্ধতিতে। তারা নিজের মতো স্কুল পছন্দ করবে। তবেই সমাজে শিক্ষার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণতা আসবে। নতুবা আর্থিক পিছয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা চিরদিন পিছনেই পড়ে থাকবে। এই রকম আরটিই (RTE) ক্ষেত্রে অ্যাক্ট প্রয়োগ নিয়ে যত নিয়ম প্রাইভেট স্কুলগুলির জন্য। আরটিই-র সব পরিকাঠামো কটা সরকারি স্কুলে আছে? অথচ কথায় কথায় সরকার সাধারণ বেসরকারি স্কুল বন্ধের নোটিশ ধরিয়ে দেয়, পরিকাঠামো নেই বলে। পরিকাঠামোতো সরকারের স্কুলেও নেই, সেগুলো তবে কী করে চলছে। প্রত্যেক প্রাইভেট স্কুল থেকে এনওসি-র জন্য তিন হাজার থেকে দশ হাজার পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়েছে(২০১৩-২০১৪) আবেদনপত্র প্রদানের সময়। আজ পর্যন্ত তার কোনো উত্তর নেই। প্রশ্নটা স্বাভাবিক, প্রাইভেট স্কুল চালানোটা কি তাহলে অপরাধ?
মূল্যায়ন : পরীক্ষা মূল্যায়ন হবে না, সব পাশ—এই ফতোয়ার মধ্যেও কোনো দূরদর্শিতা নেই। কেন হবে না। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্গত যারা, এখনও তাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে। মূল্যায়ন সংক্ষিপ্ত, সহজ, মৌখিক নানাভাবে হতে পারে। সামান্য যা পড়াশোনা হবে তার থেকেই মূল্যায়ন হবে। এই সৃষ্টিতেই মূল্যায়ন এক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। কোনো না কোনোভাবে আমরা সর্বদা মূল্যায়িত হতেই থাকি। এমন ঘোষিত ছাড় হলে শিক্ষার্থীর মনোবল, আগ্রহ, প্রয়োজনবোধ সব নষ্ট হয়ে যাবে। কাগুজে শিক্ষা সমাজের কোনো কাজে লাগবে। করোনা যুদ্ধের এই ভয়ংকর পরিবেশ শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে ও শান্তভাবে দূরদর্শী চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। করোনার আঘাত যে ক্ষতি করে যাবে তা হয়তো দু-চার বছরে পূরণ হয়ে যাবে কিন্তু একটি প্রজন্মের ক্ষতি হলে তা পূরণ করা যে দুষ্কর হবে একথা ধ্রুব সত্য।
বিমল কৃষ্ণ দাস
(লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ)