হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত তপন কুমার ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য

একদিন তিনি চিৎকার করে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দুকে তাঁদের অধিকারের লড়াইটা বুঝতে শিখিয়েছিলেন। তাঁর এক ডাকে রানী রাসমণি এভিনিউ ভিড়ে উপচে পড়ত। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে হিন্দু হুঙ্কারে দক্ষিণ থেকে উত্তর বঙ্গ কেঁপে উঠত । তাঁর এক কথায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু যুবক জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে সক্ষম হত। যিনি বাঙ্গালী হিন্দুকে মাটির দখল নিতে শিখিয়েছিলেন –

মাটি কারো বাপের হয় না,
মাটি হয় দাপের।
তোমরা জানোয়ার হলে, আমরা হবো ক্ষুাধার্ত শিকারী।

অজস্র যুবক যুবতীর রাজনীতির হাতেখড়ি তাঁর হাত ধরে হয়ে ছিল, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে তিনিই শিখিয়েছিলেন।সত্যের জন্য সবকিছুই হেলায় ত্যাগ কি করে করতে হয় সেটা তাঁর কাছ থেকে অধ্যয়ন করতে হয়।

এক নির্ভীক ,আপোষহীন ,স্পষ্টবাক্ যোদ্ধার কন্ঠস্বর। রাজশক্তি ও জনশক্তির পাশাপাশি অবস্হান কত গুরুত্বপূর্ণ। মুগ্ধ হতে হত তাঁর ব্যাখ্যায়।

হিন্দু সংহতি প্রতিষ্ঠা করলেন ,নেতৃত্ব দিলেন ,’জয় বাঙ্গালী ,জয় মাকালী’ মন্ত্রে হিন্দুত্ববাদে বাঙ্গালী স্বকীয়তা এনেছিলেন।

গত ১২ ই জুলাই ২০২০ সেই মহাজীবনের অবসান ঘটল। করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠাতা #তপন_ঘোষ।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে সঙ্ঘের সংস্পর্শে আসেন তপন ঘোষ। কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক (ওয়েলিংটন স্কোয়্যার) শাখার স্বয়ংসেবক পরে প্রচারক (হোলটাইমার) হন। এর পরে জরুরি অবস্থার সময়ে কারাবাসও করেন তপন ঘোষ।

সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবেই রাজ্যে অখিল ভারতী বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) সংগঠন-সম্পাদক হন। এই সময়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিতে চান, কিন্তু তৎকালীন বিজেপি নেতৃত্ব তাতে রাজি হয়নি। দীর্ঘ সময় বিদ্যার্থী পরিষদের দায়িত্ব পালনের পরে ফের হাওড়া ও হুগলি জেলা নিয়ে গঠিত বিভাগের প্রচারক হন তপন।

সেই সময়েই মৌরিগ্রামে ‘আল্লানা কসাইখানা’ নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। এক্ষেত্রেও স্থানীয় আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বনিবনা হয় না। প্রচারকের দায়িত্ব পালন না করে অন্য কাজ করছেন বলে তাঁর দায়িত্ব বদল হয়। দুই ২৪ পরগনা নিয়ে গঠিতে বিভাগের প্রচারক হন তপন ঘোষ।

সেই সময়েই ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে বাসন্তীর কাছে উত্তর সোনাখালি গ্রাম গোষ্ঠী সংঘর্ষে উত্তাল হয়। সেখানেও আরএসএস-এর নির্দেশ অমান্য করে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দেন তপন ঘোষ। এর পরে ফের দায়িত্ব বদল হয়। সরাসরি দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয় বঙ্গ আরএসএস। বজরং দলের সর্বভারতীয় দায়িত্ব দেওয়ার পরে কার্যত সঙ্ঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন তপন ঘোষ।

তৈরি হয় তাঁর নতুন সংগঠন ‘হিন্দু সংহতি’। মধ্য কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে গলি, তস্য গলির ভিতরে ৫, ভুবন ধর লেনে নিজের পৈতৃক বাড়িতেই তৈরি হয় সংগঠনের কেন্দ্র। ওই বাড়ি থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হয় সংগঠনের পত্রিকা। একই সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠন বিস্তারের কাজ।

হিন্দু সংহতি কোনওদিন ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ না হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দাঙ্গার সময় ত্রাণকার্যে নেমেছে। ২০১৭ সালে রাজ্যে একটি দাঙ্গার সময়ে এক নাবালকের আইনি কবচের ব্যবস্থা করেছিল হিন্দু সংহতি। যে নাবালকের পোস্ট থেকেই সেই দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল অভিযোগ উঠেছিল। সেই বছরই ইংল্যান্ডে ভাষণ দিতে গিয়ে তুমুল বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ঘোষ। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বব ব্ল্যাকম্যান।

এই সংগঠনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ওঠে। এমনকি প্রকাশ্যে ধর্মান্তকরণের অভিযোগও ওঠে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে কলকাতায় ধর্মতলায় বিশাল জনসভার আয়োজন করেন তপন ঘোষ। সেই সভা থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তপন ঘোষের বিরুদ্ধে। এমনকি ধর্মতলায় প্রকাশ্যে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

এরপরেই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে হিন্দু সংহতি এবং তপন ঘোষের সভা নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছরেই হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধীয় বক্তব্য পেশ করতে বিদেশ যাত্রাও করেন তপনবাবু। বিদেশে তাঁর বক্তব্য ঘিরেও তৈরি হয় একাধিক বিতর্ক। কিন্তু কোনও দিনই দমে যাননি। হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।

হিন্দুত্ববাদের একচেটিয়া বাজার কে তিনি দলীয় রাজনীতির উর্ধে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন ,কজন বুঝেছে সে কথা।

হিন্দু হৃদয়ে তিনি অমর হয়ে থাকুন।

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥

আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.