২৩ এপ্রিল এই দিনে আশপাশের ৩০০০ হিন্দু যুবককে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে পাথরাজ নদীর পাড়ে রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা করা হয়।
পাক বাহিনী তাদের হত্যা করার পর বিধবা স্ত্রীদের ওপর চলে সীমাহীন বর্বর নির্যাতন। সেদিনের স্বামী হারানো প্রায় সাড়ে ৩শ’ জন বিধবা আজো কালের সাক্ষী হিসেবে বেঁচে আছেন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১৮নং শুখানপুখুরি ইউনিয়নের জাটিভাঙ্গা গ্রাম। যখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকসেনারা মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি থেকে ধরে এনে মানুষকে হত্যা করছে। তখন উপায় না পেয়ে আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের শতশত লোক ২৩ এপ্রিল ভারতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে স্ত্রী সন্তান সহায়-সম্বল নিয়ে রওয়ানা হয়। ভোরের দিকে স্থানীয় রাজাকার তাদের পথরোধ করে টাকা পয়সা সোনা গয়না লুট করে নেয়।এরপর তাদের সবাইকে ঐ গ্রামে আটক করে রাখে। রাজাকারের দোর্দন্ড প্রভাবে গ্রামের অন্যরা মুখ খুলতে পারেনি। পরে রাজাকাররা পাকসেনাদের খবর দেয়। পাকবাহিনী এসে বেলা ১০টার দিকে ৩০০০ হিন্দুকে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্রাস ফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করে। যারা গুলিতে মারা যায়নি পরে বেয়নেট খুচিয়ে তাদের হত্যা করে। আশপাশের লোকজন দিয়ে লাশ নদীর পাড়ে স্তুপ করে মাটি চাপা দেয়। পরে তাদের যুবতী স্ত্রীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। যারা সহজে রাজি হয়নি তাদের অনেককে গুলি করে।
এমনি আজো বেঁচে থাকা বুধোস্বরী জানান, আমাকে গুলি করে পাক সেনোরা। আমার ডান হাতে এবং কোমরের বাম পাশে গুলি লাগে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে কে বা কারা আমাকে উদ্ধার করে। স্বামী স্বশুর দেবর হারিয়েছি সেদিন। সংসারে খেয়ে না খেয়ে আজো বেঁচে আছি। আমাকে দেখার কেউ নেই। এখন শরীর চলেনা। সরকারি কোন সহায়তা পায়নি। সেদিন স্বামী হারা ৬৫ বছর বয়সী রুশোবালা বলেন, আমি হয়তো না খেয়ে মরে যাবো তাতে কোন কষ্ট থাকবেনা তবে আমার স্বামী হত্যাকারী রাজাকারের বিচার দেখে গেলে পরপারে শান্তি পেতাম। জয়া বালা, পটেশ্বরীবালার মতো অনেক বিধবারা জানান, মুক্তিযোদ্ধার কোন ভাতা পাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা থেকেও অনেকেই বঞ্চিত হয়েছি। এভাবে অনেকেই ওপারে চলে গেছে। এতোদিন গায়ে শক্তি ছিল কাজ করে খেতাম। এখন বয়সের ভারে কাজ করতে পারি না।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল খালেক জানান, তার চোখের সামনেই এ গ্রামের সকল পুরুষদের ধরে এনে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয় এলাকার কয়েকজন রাজাকার। সেখানে তাদের লাইন করে দাঁড়িয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও পরে ব্রাস ফায়ার করে মারা হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জীতেন্দ্রনাথ রায় জানান, জাঠিভাঙ্গা হত্যাকান্ড ৭১’এ ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম গণহত্যা। আমরা হত্যাকারীর সহায়তাকারীদের বিচার চাই । ৪৯ বছর হয়েও যাওয়ার পরেও আজও বিচার পায়নি এই হতভাগ্য হিন্দুরা। আজ ২৩ এপ্রিল, ঠাকুরগাঁওয়ের জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা সদর উপজেলার ১৫টি গ্রামের তিন হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে জাঠিভাঙ্গায় জড়ো করে হত্যা করেছিল। সেদিন নিজেদের জীবন উৎসর্গকারীদের জন্য মেলেনি শহীদের স্বীকৃতি। দিনটি স্মরণে নেই সরকারি-বেসরকারি কোনও সংস্থা বা সংগঠনের কর্মসূচি। বরং গণহত্যায় আত্মদানকারীদের স্ত্রীরা এখন বেঁচে আছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। তাদের খবর নেওয়ার কেউ নেই।দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯বছর পেরিয়ে গেলেও স্বামীহারা বিধবা ও স্বজনহারা মানুষগুলো আজও পায়নি শহীদ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের তিরপা মোহন গণহত্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নানা রোগে এখন শয্যাশায়ী। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত তিরপা মোহন চিকিৎসা করাতে পা পেরে পঙ্গু জীবনযাপন করছেন।
জগন্নাথপুরের আশামনি বেওয়া ও জাঠিভাঙ্গা বুড়াশিব গ্রামের ভুটরী বেওয়া অভিযোগ করে বলেন, একটি বিধবা ভাতার কার্ডে তিন মাস পরপর পাই মাত্র ৯শ’ টাকা। এ দিয়ে কি সংসার চলে? আর শীতের মৌসুম এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাই একটি কম্বল। সারা বছর আর কেউ কোনও খবর রাখে না। কেউ জানে না আমাদের দিন চলে কীভাবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বামীহারা বিধবা ও স্বজনহারা মানুষগুলো আজও পায়নি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। বিধবাদের পুনর্বাসনে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট তাগাদা দিলেও তাতে কোনও কাজ হয়নি।
সৌমেন ভৌমিক