সম্প্রতি লাদাখ অঞ্চলে চীন-ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেশের মধ্যে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। কোভিড মহামারী নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা দেশের মনঃসংযোগ সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হলেও সীমান্তের এই ঘটনা নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। চীনের এই আগ্রাসী নীতি ও পেছনে আরও বড়ো কোনো মতলবকে আন্দাজ করে নিয়ে দেশব্যাপী চীনাপণ্য, পরিষেবা, এমনকী বিনিয়োগকেও বর্জন করার আওয়াজ উঠেছে। এই সূত্রে ১৯৬২ সালের দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধে ভারতের পক্ষে চরম অবমাননাকর ফলাফল ও ‘আকসাই-চীন’ অঞ্চল হারানোর কথা সকলেই জানেন। এই অপমানের স্মৃতি জাতিকে ব্যথিত করলেও আজকের ভারত বিশ্বাস করে চীনের চোখে চোখ রেখে রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা তার আছে।
অবশ্য এটা ঠিক যে, জাতির এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাব কোনোভাবেই সমরাঙ্গনে সরাসরি পরীক্ষিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না, কেননা সেক্ষেত্রে সংঘর্ষ কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। কিন্তু এতে বিপদের আশঙ্কাকে কোনোমতেই খাটো করে দেখা যাবে না। কেননা ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে যে বহু জটিল ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত হিসেবকে ব্যর্থ করে মানুষের বিচিত্র আবেগের বিস্ফোরণ পরিকল্পনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের মতো দুটি প্রতিবেশী সভ্যতার মধ্যে অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার সম্পর্কটি সূক্ষ্ম সূতোর ওপর ঝোলে। অবশ্যই ইতিহাস ও কূটনীতিবিদরা
কলসির তলা অবধি গভীর অনুসন্ধান করে উভয় দেশের পারস্পরিক ঐতিহাসিক সম্পর্কের অনুসন্ধান ও মিল খোঁজায় ত্রুটি রাখবেন না। কিন্তু দুটি নিশ্চিত উপসংহারের প্রসঙ্গ তারা কিছুতেই এড়াতেও পারবেন না।
প্রথমটি হলো আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারত-চীন বিশেষজ্ঞ প্রবোধ চন্দ্র বাগচীর পর্যবেক্ষণ। তিনি বলেছিলেন, ভারত চীনের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক মূলত এক পক্ষীয় একটি প্রক্রিয়া। যে কারণে ভারতীয় চিন্তন ও জীবনধারার ওপর চীনা সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে কোনোদিনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়নি। দ্বিতীয়ত, হিমালয়ের দ্বারা সংযোজিত এই দুটি দেশের মধ্যে তিব্বত একটি কেন্দ্রীভূত অবস্থানে রয়েছে। অথচ এই তিব্বতীয় সংস্কৃতির কোনো প্রভাব ‘হান সম্প্রদায়’পরিচালিত চীনে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত, সম্পূর্ণ প্রভাবহীন।তাই নিশ্চিত করেই তিনি বলেছেন ভারতীয় সভ্যতা কোনোদিনই চীনের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এর ফলে কোনো প্রভাবের অস্তিত্ব অবান্তর।
একটা সময়ে হিন্দি মূলধারার সিনেমায় খুব বিখ্যাত হয়ে পড়া নর্তকী হেলেনের ‘মেরা নাম চীন চীন চু’বা হোটেল রেস্তোরার ফেবারিট চীনে খাবার (যা আদৌ মূল চীনা পদ্ধতিতে রান্না করা নয়) খাওয়ার ফলে যথেষ্টচীনা সংস্কৃতি আত্মীকরণ হয়েছে এটি নিতান্তই মানসিকতা ছাড়া কিছু নয়।
বিগত তিন দশক ধরে চীন একদিকে ক্ষমতার নরম কূটনৈতিক ব্যবহার (soft power diplomacy) , অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বাজার দখল করার লক্ষ্যে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। আজকের সারা বিশ্বের কাছে তারা নিজেদের একটি আত্মবিশ্বাসী ও অত্যাধুনিক দেশ হিসেবে পাশ্চাত্য দুনিয়ার ওপর চিরাচরিত প্রাধান্যকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাধারী হিসেবেই তুলে ধরেছে। দুঃখের বিষয়, এই ভাবমূর্তিটা ভারতীয় মানসেও আংশিকভাবে জায়গা করে নিয়েছে। তুলনামূলকভাবে সস্তায় কুশলী ও সূক্ষ্ণ কারিগরি দক্ষতায় নির্মিত ভোগ্যপণ্যগুলির ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও জনমানসে দীর্ঘ ঝুলন্ত গোঁফধারী, রঙিন রেশমের বড়ো বড়ো জোব্বাপরা এক ধরনের কুচক্রী ড. ফু মানচু’র সঙ্গে জড়িত। প্রাচীন ইমেজও কিন্তু রয়েছে।
এরই বিপরীত মেরুতে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষায় দুরস্ত ভারতীয় কূটনীতিকরা চৈনিক ও ভাষা চর্চা ও চীনা কৃষ্টি, ইতিহাস, সংস্কৃতির ত ওপর গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ করার মধ্যে যে ব পার্থক্য আছে তা গুলিয়ে ফেলেছেন। চীনেও ত কিন্তু ভারত সম্পর্কে ধারণায় এমন কিছু রকমফের নেই। সেটিও আদৌ সন্তোষজনক ১ নয়। চীনের কাছে পাশ্চাত্য শক্তির দ্বারা দীর্ঘ ২ নিপীড়ন, জাপানের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বা বহুকাল ধরে বিশ্বের নানা দাপুটে শক্তির কাছে ‘কুলি’ নামধারী হয়ে পদাঘাত খেতে ে অভ্যস্ত চীনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী অপমানবোধ ও তৈরি করে। এই সমস্ত বিদেশি দৈত্যদের। শিক্ষা দিতেই চীন তার গৌরব পুনরাদ্ধারের। বদ্ধ পরিকর। এই গৌরব ইতিহাসে মিডিল কিংডোম-এর সময়কার। সেটায় পরে ১ আসছি। এই অত্যাচারিত হওয়ার করুণ গল্প ব প্রচারের পেছনে ভারত যে পাশ্চাত্য শক্তির ৮ অনুগত ভূমিকাই পালন করছে এমন একটা > ভাবনাই চীনে প্রচলিত আছে। চীনা ত জনমানসে ভারতীয়দের সম্পর্কে সাংহাইয়ের আন্তর্জাতিক বসতির অঞ্চলের ঢুকতেই বিশালদেহী পাহারাদার হিসেবে যে ব শিখদের দেখা যায় সেই রূপ কল্পনাটা। চীনাদের কিছুটা ভীত করে। এরাই সেই বিদেশি বসবাসী অঞ্চলের প্রথম প্রতিরক্ষা প্রহরীর ভূমিকা নেয়। এদের হাতে যাকে মজবুত লাঠি, যে কোনো মুহূর্তে স্থানীয় চীনে রিকশাচালক বেয়াদপি করলে এরা রেয়াত করে না। এই ছবিটাই চীনের সাধারণ মানুষের ভারত সম্পর্কে ইতিহাস চেতনায় সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
ইতিহাসবিদ ইসাবেলা জ্যাকসনের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, চীনা ইতিহাস। বইয়ে-তে এই ধরনের ভারতীয় শিখদের বোঝাতে অত্যন্ত জঘন্য গালিগালাজ ব্যবহার করা হয়। চীনারা এদের বলে ‘হংটু আসান’যার অর্থ বহুবিধ যেমন—লাল মাথা বাঁদর, লাল মাথা ব্যাসকেল ইত্যাদি। এই সব নােংরা অভিধার সবটা বোঝানোর চেষ্টা হয় যে এরা পূর্বতন ব্রিটিশ প্রভুদের পা-চাটা চাকর ছাড়া কিছুই নয়।
এটা বেশ বোঝা যায়, এই মানসিকতা এক সময় মাও-জে-দংও তুলনামূলকভাবে বেশি পরিশীলিত চৌ এন লাইয়ের জওহরলাল নেহর ঔদ্ধত্য ও আচার আচরণের প্রতি বিরাগের মূল কারণ ছিল। কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ৬০-এর দশকে বিশ্ব আঙিনায় ভারতের স্থান ঠিক কী ছিল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকেই ৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ। পর্যদুস্ত হয়েছিল ভারত। এর পেছনে উল্লেখিত দুই ব্যক্তির অবদান কম নয়।
এবারেও শোনা যাচ্ছে, সেই ধরনের কোনো মানসিকতা চীনা রাজনৈতিক তথা পার্টি নেতৃত্বের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। মধ্য রাজত্ব বা ইতিহাসে মিডিল কিংডোম বলতে চীন বোঝায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছরের সময়কে। যখনকার চীনারা মনে করত তাদের সাম্রাজ্যই পৃথিবীর মধ্যস্থলে অবস্থান করছে, বাকি অঞ্চলে অসভ্যদের বাস। পাশ্চাত্য সভ্যতার অস্তিত্বই তারা জানত না। আর সেই সময়কার ভৌগোলিক অধিকারে থাকা সমস্ত অঞ্চলকেই এখনও তারা নিজেদের পতাকার অধীনে থাকা ভূখণ্ড বলেই অধিপত্য কায়েম রাখতে উদগ্রীব। চীনে যেহেতু সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয় তা সকলের বোধগম্য নয় এবং গোচরেও আনা হয় না, যে কারণে তাদের মনে কী আছে তা নিতান্তই অনুমান সাপেক্ষ, যাকে বলে specelation। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বেজিং মনে করে বিশ্বজোড়া করোনা মহামারীর প্রকোপের সময় ভারতের পক্ষে বিশ্ব সমর্থন বিশেষ জোরদার হবে না।
চীনের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তারা ভারতের যতটা ক্ষতি করতে পারে ভারতের পক্ষে চীনের ওপর তেমন ধাক্কা দেওয়া অসম্ভব। এই ভাবনাই তাদের অধৈর্য করে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে বাধ্য করছে। তাদের এই ধারণাকে ভেঙে দিতে দরকার আমাদের তরফে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, একই সঙ্গে বর্ধিত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি। এগুলি ছাড়াও প্রয়োজন শত্রুর মনোভাব ও তার চরিত্রের দিক বিশ্লেষণ করে দুর্বল জায়গাগুলি চিহ্নিত করা। চীনের একচেটিয়া আধিপত্যের বাসনাকে চুরমার করতে আমাদেরও চীন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে হবে। ভারতকে শক্তিধর হিসেবে উঠে এসে অন্যান্য ক্ষমতাশালীদের দলের সদস্য হতে হবে।
স্বপন দাশগুপ্ত
(লেখক বিশিষ্ট স্তম্ভলেখক ও রাজ্যসভার সদস্য)