ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সকলে এক দৃঢ়চেতা, মানবদরদি, নিঃস্বার্থ দেশনায়ক হিসেবেই জানেন। তবে অনেকেই একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তার অসাধারণ কৃতিত্বের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ভারতবর্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং গবেষণার জন্যও এই মহাপ্রাণের অনেক অবদান আছে। ইংরেজ শাসনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এদেশে বিজ্ঞানের অসাধারণ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। আজকের দিনের অনেক গবেষকই এই অত্যাশ্চর্য সাফল্যের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন।তবে কি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন দেশবাসীর মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল নাকি ইউরোপীয় শাসকদের অসহনীয় অত্যাচার ভারতবাসীর মধ্যেকার সহজাত প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত হতে দৃঢ়সংকল্প করে তুলেছিল ? শ্যামাপ্রসাদের মতো ব্যক্তিত্বের বিষয়ে গবেষণা প্রকাশ্যে আসার পরে উত্তরোত্তর দ্বিতীয় মতটির পক্ষেই পাল্লা ভারী হয়ে উঠছে।
পৃথিবীর বড়ো আর লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলির মধ্যে একটি হলো – সার্ন, দ্য ইউরোপীয়ান সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ। ২০১২ সালে ‘ঈশ্বর কণা’বাহিগস বোসন’পরীক্ষামূলক অবিষ্কারের সময় আরও একবার উঠে এসেছিল সার্নের নাম। সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে সার্নের ডিরেক্টর জেনারেলের অফিসের ঠিক সামনে আছে একটি বিরাট ব্রোঞ্জের নটরাজমূর্তি। ১৯১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় ভূতাত্ত্বিক আনন্দ কুমারস্বামী সর্বপ্রথম নটরাজের মহাজগতিক নৃত্যের সঙ্গে পদার্থের মধ্যেকার অবআণবিক কণার গতির সম্পর্কসূত্রের কথা বলেন। অনেক পরে আমেরিকার বিজ্ঞানী ও ভাষ্যকার এই মহাজাগতিক সম্পর্কের কথা বিশ্ববাসীকে জানান। সার্নের ওই নটরাজ মূর্তির নীচে আদি শঙ্করাচার্যের শিবানন্দ লহরীর একটি শ্লোক খোদিত আছে— নিত্যায় ত্রিগুণাত্মনে পুরজিতে কত্যায়নীশ্রেয়সে সত্যয়াদিকুটুম্বিনে মুনিমনঃ প্রত্যক্ষচিন্মুয়ে। মায়াসৃষ্ট জগত্ৰায়ায় সকান্নায়ান্তসংচারিণে সায়ন্তাণ্ডবসন্ত্রমায় জটিনে সেয়ং নতিঃ শম্ভবে। ৫৬৷৷
“হে সর্বব্যাপী, সকল সৎগুণের মূর্ত প্রকাশ, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, সন্ধ্যার আলো-আঁধারে আনন্দ তাণ্ডবরত হেনটরাজ, তোমাকে প্রণাম।”
জেনেভার সার্নের নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারের নটরাজ মূর্তি আর তার নীচের এই অপূর্ব শ্লোক ভারতবর্ষের কাছে একান্ত গর্বের বিষয়। আমাদের দেশের প্রজ্ঞাবান দার্শনিকেরা বিজ্ঞান মেধাকে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে প্রেরণা দিয়েছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষই দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংখ্যা ও বস্তুস্থিতি তাঁরা সঠিকভাবে জানতে সক্ষম হয়েছিলেন। শল্য চিকিৎসার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রাদি তৈরি করেছিলেন। কয়েক হাজার বৃক্ষ-লতা- গুল্মের ভেষজ গুণনিপুণভাবে আবিষ্কার করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ভারতীয় আয়ুর্বেদ গবেষকেরা। এসবই শত শত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বদেশি জাগরণের অংশ ছিল। প্রাচীন ভারতের গৌরব আমাদের দেশের চিন্তাবিদদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঠিক তেমনইবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পরম্পরাগত উত্তরাধিকার নতুন যুগের বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। যুব-বিজ্ঞানীরা বিশ্বসভায় তাঁদের সাফল্যকে দেশপ্রেমে নিজেদের নিবেদন বলে মনে করতেন। বিজ্ঞান গবেষণায় প্রাচীন ভারতের অবদান সে যুগের বিজ্ঞানীদের বিশেষ রূপে প্রভাবান্বিত করেছিল।
বেটথেলু লিখেছেন, ‘গ্রিক অ্যালকেমি’, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০২ সালে প্রকাশ করলেন ‘হিন্দু কেমেস্ট্রি’র প্রথম খণ্ড। বিরাট আলোড়ন ফেলল সেই গ্রন্থ। ১৯০৯ সালে আচার্য তার গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করলেন। এই গ্রন্থ ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক প্রামাণ্য আকর গ্রন্থ। যুবক বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর উন্নত স্বাধীন দেশের বিজ্ঞান গবেষকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকলেন।ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের এই সাফল্য স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার চেয়েছিলেন কলকাতায় এমন একটি সংস্থা স্থাপন করতে যেখানে দেশের মানুষ বিজ্ঞান গবেষণা করবেন, স্বদেশি ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নতির জন্য। ১৮৭৬ সালে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এর প্রতিষ্ঠা করলেন। এই ‘কালটিভেশন’ শব্দটির চয়নও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে বিজ্ঞানের ‘কালটিভেশন’ মানে চর্চা হবে, নাড়াচাড়া করা হবে। একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে তৈরি করে, কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করবেন। কতকটা চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরমনের মতো। দ্য ইন্ডিয়ান ফিনান্স সার্ভিসের একজন সদস্য যেমন এখানে এসে আলোকরশ্মির আণবিক বিচ্ছুরণের চর্চা করতে করতে ‘রামন এফেক্ট’ আবিষ্কার করে ফেললেন। সেই তথাকথিত অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তির বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটাই আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে একমাত্র বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। সালটা ১৯২৩।
পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানের এই সাফল্যকে কোনোভাবেই ‘ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান’বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য কোনো বড়ো বাজেটের ‘ইম্পেরিয়াল প্ল্যান ছিল । বরং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনটাই এই জাগরণের কারণ হিসেবে ভাবা যায়। যার থেকে উঠে এসেছিল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন। স্যার তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার জন্য সাঁইত্রিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গবেষণার জন্য সাত লক্ষ টাকা দান করার সময় স্যার তারকনাথ পালিতের বক্তব্যেও উঠে এল ‘কালটিভেশন’শব্দটি। সেদিনের ভাষণ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ‘পালিত প্রফেসর’-কে’প্রেরণা জুগিয়েছে, “এই সামান্য অর্থ ভারতবাসীর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচার ও প্রসারের জন্য। বিজ্ঞান চর্চা (কালটিভেশন) ও অগ্রগতির নিমিত্ত প্রদত্ত হইল।”
সত্যি বলতে কী উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বা প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানীরা প্রেসিডেন্সি কলেজে অসামান্য কাজ করেছেন। আজ মোবাইল থেকে উপগ্রহ, রান্নাঘর থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, সর্বত্র ব্যবহার হয় যে মাইক্রোওয়েভ তা আবিষ্কার করেছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞান গবেষণা পূর্ণরূপ পেল ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। এক ঝাঁক তারকা সেখানে শিক্ষক হিসেবে এলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রমণ, গণেশ প্রসাদ আর শিশির কুমার মিত্রের মতো দিকপাল সব বিজ্ঞান শিক্ষকেরা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজকে’ সত্যিই ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’ করে তুললেন। সেই সাধনার পূর্ণতা পেল ১৯১৫ ব্যাচের এমএসসি ছাত্রদের অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো জগবিখ্যাত বিজ্ঞানীরা সেই নক্ষত্রমণ্ডলীতে ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে এই বিজ্ঞান সাধনার উপবন যে মনোহর পুষ্পপল্লবে ভরে উঠেছিল তার নেপথ্যে ছিল স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং ড. শ্যামাপ্রসাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ঘাম, রক্ত আর অশ্রুবিন্দু। অসামান্য শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ স্যার আশুতোষ পরপর চারবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। ১৯০৬ সাল থেকে শুরু করে দুই বছর করে চারবার ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই পদ অলংকৃত করেছিলেন বাঙ্গলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ১৯২১ সালে আর একবার নির্বাচিত হন।
ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ স্থাপন করার পেছনে সবথেকে বড়ো অবদান ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। কালক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের এই ক্যাম্পাসটি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ নামে বেশি পরিচিতি লাভ করে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা, গণিত ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায় চেয়ার প্রফেসর’ পদ তৈরি করে ভারতবিখ্যাত পণ্ডিতদের এনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবথেকে কম বয়সের উপাচার্য হিসেবে এমন সব সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ কল্পনাও করতে পারতেন না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তো কোনো প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না। তবুও শ্যামাপ্রসাদ তাঁকে “ডিস্টইস্ট প্রফেসর’ পদে বাংলা বিভাগে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে ঘটালেন এক যুগান্তকারী ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় সমাবর্তন ভাষণ দিলেন। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ ভারতীয় ভাষাতে হলো।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের স্থাপনের মাধ্যমে যে মহাযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন, তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্যামাপ্রসাদ সেই অপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করায় মননিবেশ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি ও ভারতের শিক্ষানীতির বিষয়ে ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, “যদিও পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের মধ্যে গভীর দেশাত্মবোধ, মুক্তচিন্তা ও রাজনৈতিক সচেতনতা এনেছে, কিন্তু এর মধ্যে আমাদের উপযোগী কোনো জাতীয় শিক্ষানীতি আমি খুঁজে পাইনি।” শ্যামাপ্রসাদ শিক্ষার ভিত্তিকে ভারতকেন্দ্রিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট (আইএ) পরীক্ষায় পুরাতত্ত্বকে একটি বিষয় হিসেবেযুক্ত করা হলো। বিএসসি-র পাঠক্রমে জ্যোতির্বিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ১৯৩৭ সালে এমবিএম পাঠক্রমকে ছয় বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছরের করা হলো। কারণ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক বছর পিছিয়ে যাচ্ছিলেন।
বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ‘ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ বিদ্যা প্রভূত পরিমাণে সঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের নিত্যদিনের জীবনে তার প্রকৃত ব্যবহার হচ্ছে
। যে দেশে কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র, রোগ-ব্যাধি আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আছেন, সেই দেশে শিল্প ও কৃষির অগ্রগতির জন্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পুষ্টির উন্নতিকল্পে, ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য ও মানুষের আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যের বৃদ্ধিতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগ সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”বিশ্ববিদ্যালৈয়ের উপাচার্য হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার পাঠক্রমে ‘মাসস্কেল প্রোডাকশন’ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার সময়েই ‘কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ শুরু হয়েছিল। স্নাতকোত্তরের বিষয় হিসাবে ফলিত মনোবিদ্যার পঠনপাঠন শুরু হয় তখনই। তিনি কৃষিবিজ্ঞানের ডিপ্লোমা কোর্সও শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বাগত ভাষণে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং কালটিভেশন অব সায়েন্সের সঙ্গে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সাফল্যের কথাও উল্লেখ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও কয়েকটি সংস্থা বিজ্ঞান গবেষণায় কলকাতার নাম উজ্জ্বল করেছে, তার মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, বোস ইন্সটিটিউট এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৩৮ সালটা কলকাতায় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য বছর। সেবছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন একযোগে একটি বড়ো বিজ্ঞান সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান মনীষীরা একত্রিত হয়েছিলেন সেই মহাসম্মেলনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বললেন, “ভারতবাসী কেবল ভাববাদী, তাদের বস্তুনির্ভর বিজ্ঞানে বিশেষ অবদান নেই, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এই মত সম্পূর্ণ সত্য নয়। ভারতবর্ষ কেবলমাত্র স্বপ্নই দেখেনি। ভারতের গৌরবময় দিনে, তাঁর বার্তাবহ দূতেরা দেশের সীমানার বাইরে গিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। চরক ও শুশ্রুত, নাগার্জুন ও ভাস্করাচার্য, আর্যভট্ট ও লীলাবতী এমন আরও অনেকে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে…”।
সবশেষে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, “ঐতিহ্য ও চিন্তায় সমৃদ্ধ, প্রতক্ষ্য প্রমাণ ও ক্ষমতায় বলশালী ভারতবর্ষ, সারা পৃথিবীর সঙ্গে উচ্চতর ও মহত্তর সভ্যতার পথে তালে তাল মিলিয়ে সমানভাবে চলতে পারবে।”
স্বাধীন ভারতবর্ষেও ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞানের শিল্পায়ন ও নতুন প্রযুক্তি বাণিজ্যিকীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি ‘দ্য কাউন্সিল অব সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ (সিএসআইআর) সংস্থার প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।‘দ্য ন্যাশেনাল কেমিকাল ল্যাবরেটরি’, ‘দ্য সিরামিক্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট’, ‘দ্য ফুয়েল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’, ‘দ্য ন্যাশেনাল মেটালার্জিকাল ল্যাবরেটরি’– এই পাঁচটি সংস্থার পরিকাঠামো তৈরি করে কার্যান্নয়ন শুরু হয় তার সময়েই। তিনি ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের কোর্ট মেম্বারদের একজন ছিলেন।
বাঙ্গলার আকাশে সেদিন বিপদের ঘনঘটা, ১৯৪৬ সালে ঘটে গেছে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। ১৯৪৭ সালের শুরুতে রব উঠল সমগ্র বঙ্গপ্রদেশই পাকিস্তানকে দেওয়া হবে। তেমনই দাবি মুসলিম লিগের। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তো লিগের সঙ্গেই প্রথম থেকে ছিল। অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশ পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তাব কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও প্রায় মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের নবজাগরণের কেন্দ্রই তো ছিল বঙ্গপ্রদেশ। স্বাভাবিক ভাবেই তা ভারতবর্ষেই থাকার কথা। সেই সময় ড. শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে কাধে কাধ লাগিয়ে লড়েছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার মতো অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। রাজনৈতিক মতপার্থক্য, সংগঠনগত পার্থক্য, দল-মত সব । কিছু ভুলে বাঙ্গলার জন্য লড়ে ছিলেন কলকাতার এই প্রকৃত বিদ্বজ্জনেরা। এনাদের। সম্মিলিত লড়াইয়ের জয় হলো। ২০ জুন, ১৯৪৭ বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ আইনসভা গঠিত হলো। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের রাজ্য হিসেবে থেকে গেল। সেই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও। যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই জ্বলে উঠেছিল এই উপমহাদেশের প্রথম আলো।
১৯৩৯ সালে নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি পাঠক্রমে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। অধ্যাপক সাহা তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালিত প্রফেসর’। ইতিমধ্যে তিনি লরেন্স কার্কলে ন্যাশেনাল ল্যাবরেটরি । পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তখন অ্যাসিলারেটর ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন একটা যন্ত্রের জন্য প্রয়োজন অনেক টাকা আর সেই সঙ্গে বেশ খানিকটা জায়গাও। তাই তার স্বপ্ন সাকার হওয়ার পথে অনেক বাধা এসে দাঁড়াল। কিন্তু অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা এবং ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সরস্বতীর এই দুইবরপুত্রের মিলিত প্রয়াসের সামনে কোনো বাধাই আর টিকল না।
১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (আজকের সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স) সংস্থার উদ্বোধন করলেন ড. শ্যামাপ্রসদ মুখোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে ড. মুখার্জির ভাষণে নতুন স্বাধীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার বিষয়ে তার ভাবনা ও স্বপ্ন। ফুটে উঠেছিল। ড. শ্যামাপ্রসাদের সেদিনের ভাষণ গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে আজকের বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষকেরা তাদের চলার পথের পরিষ্কার দিকনির্দেশ পাবেন। বর্তমানে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স তাদের বারুইপুর ক্যাম্পাসে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (স্মার্ট) শুরু করার । পরিকল্পনা নিয়েছে। এই রকম গঠনমূলক সময়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রদর্শিত আলোকবর্তিকা ভীষণভাবে কার্যকর হয়ে উঠবে।
“…পারমাণবিক যুগের এই প্রভাতে, আমাদের অবস্থা কতকটা সেই মানুষটির মতো, যে সর্বপ্রথম আগুন জ্বালাতে পেরেছিল। সেই আগুন রান্নার কাজে, উষ্ণতার জন্য বা আলোর উৎস হিসাবে কাজে লেগেছে, খুব বিরল পরিস্থিতিতে শত্রুকে বা তার সম্পত্তি পোড়ানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিল সে ভাবতেও পারত না যে, একদিন সেই আগুনে স্টিম ইঞ্জিন চলবে, রেলগাড়ি চলবে, টারবাইন ঘুরবে, সেন্ট্রাল হিটিংয়ের ব্যবস্থা হবে। প্রথম আগুন আবিষ্কারের পর থেকে বৃহত্তর ভাবে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়ার মাঝখানে কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেছে…।…আমি আনন্দিত যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক পরমাণু গবেষণা ও সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণের জন্য একটি পুরদস্তুর ‘ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ স্থাপন। করার মতো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পেরেছে।”
মজার বিষয় হলো, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পিতামহ গঙ্গাধর মুখার্জি ছিলেন ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের সুহৃদ। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের শুরুর সময়ে অঙ্কের ক্লাস নিতেন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজেও কালটিভেশনের গভর্নিং কাউন্সিলের (তখন ম্যানেজিং কমিটি বলা হতো) সদস্য ছিলেন। তাই কালটিভেশন অব সায়েন্সের সঙ্গে বহুভাবে জড়িয়ে আছে ড. শ্যামাপ্রসাদের নাম।
২০২০ সাল তো বহু কারণেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। হতেও পারে এই বছরটা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (স্মার্ট) ক্যাম্পাসের পরিকাঠামো তৈরির জন্যও বিখ্যাত হয়ে থাকবে। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ড. হর্ষবর্ধন ইতিমধ্যেই শ্যামাপ্রসাদের নামাঙ্কিত ওই সংস্থার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা প্রমুখ এই কলকাতার মাটিতেই বিজ্ঞান গবেষণার সূবর্ণযুগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ড. শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে বারুইপুরে আইএসিএসের যে আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হতে যাচ্ছে, তা হবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের যথার্থ উত্তরাধিকার।
ড. জিষ্ণু বসু