আন্তিম অংশ
কালিঞ্জর দূর্গ বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্ববধানে সংরক্ষিত হয়েছে ও হচ্ছে। এটি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ হেরিটেজ স্থাপত্য এটি। ভারতীয় পুরাতাত্বিক বিভাগ এই দূর্গে স্থাপিত হাজার হাজার মূর্তি , বিভিন্ন শীলালেখ ,প্রশস্তি সংরক্ষণ ও তাদের অধ্যয়ন ও ছায়াঙ্কন কার্য সূচিত করেছে।
ইতিমধ্যেই ভারতীয় পুরাতাত্বিক বিভাগ রাজা আমন সিংহের মহলে অবস্থিত প্রায় ১৮০০ টি মূর্তি সহ বিভিন্ন শীলালেখ ও প্রশস্তি সমূহের ছায়াঙ্কন ও অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পূর্ণ করেছেন। কালিঞ্জর বিকাশ সংস্থার সংযোজগ ডক্টর বি ডি গুপ্তের কথা অনুযায়ী ,এছাড়াও অন্য আরো অনেক মূর্তির ছায়াঙ্কন ও অধ্যয়নের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ভারতীয় পুরাতাত্বিক বিভাগের লখনৌ মন্ডলের উদ্যোগে এই কার্য সম্পন্নকৃত হচ্ছে। এছাড়াও মূর্তি ও আরো নানা শিল্প ভাস্কর্য গুলিকে রাসায়নিক উপাচারের মাধ্যমে সংরক্ষনের কার্য সম্পাদিত হচ্ছে।
কালিঞ্জর দূর্গের মধ্যস্থিত জরাজীর্ণ , ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির , মূর্তি ও স্থাপত্য ভাস্কর্য গুলিকে ভারতীয় আইনের আওতায় বহুদিন পূর্বেই সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই অমূল্য সম্পদ ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় রাজ্য সরকার স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বৃদ্ধি করার জন্য এখানে পর্যটক দৃষ্টি আর্কষন করছেন। এর ফলে স্থানটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনবসতির আর্থিক উন্নয়ন ও বিভিন্ন জীবিকা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
২০১৫ সাল থেকে এখানে প্রবেশ মূল্যও যুক্ত হয়েছে। যাতে সেই অর্থ দূর্গ সংরক্ষনের কাজে ব্যয় করা যায়। কেবল তাই নয় , এর ফলে এখানে ঘটা নানা অবৈধ , পাচার ও অসামাজিক কাজ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। এখানের প্রচুর ও পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক জলকে কাজে লাগিয়ে জলসঞ্চয় , সুন্দর বাগান তৈরি সম্ভব হচ্ছে।
কালিঞ্জর দূর্গের পশ্চিমে তাঁর অবস্থান। যিনি বিশ্ব চরাচরকে রক্ষার নিমিত্ত আকন্ঠ বিষ ধারণ করে কালকে জয় করেছিলেন। তিনিই দূর্গের অধিষ্ঠাতা কুল দেবতা ,তিনিই নীলকন্ঠ মহাদেব। দূর্গের পশ্চিমে তাঁর মন্দির। দুইটি দুয়ার পেরিয়ে সেই নীলকন্ঠ মন্দিরের যেতে হয়। সেই পথে যেতে , গুহা পরে , পাথর পরে, কিন্তু সেগুলি অদ্ভুত শিল্প নৈপুণ্য ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ। বাস্তুশিল্পের ইতিহাসে এই মন্দির ও এই পথে পরা সমস্ত স্থাপত্য চান্দেল শাসকদের এক অন্যতম ও অমোঘ কীর্তি।।
মন্দিরের প্রবেশ পথে পরিমার্জন দেব নামক এক চান্দেল শাসক রচিত প্রস্তর খোদিত শিবস্তুতি পরিলক্ষিত হয়। মন্দিরের মধ্যে অবস্থান করছেন এক স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। মন্দিরের উপরে রয়েছে এক অবিশ্রান্ত জলধারা যা সতত নীলকণ্ঠকে অভিষিক্ত করে চলেছে। এক্ষেত্রে বলে রাখি যে, এই বিন্ধ্যাচলের ভৌগলিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছি। এখানে কিন্তু গ্রীষ্মের দাবদাহে সমস্ত নদী, জলাশয় শুষ্ক তৃষিত রূপ ধারণ করে ,কিন্তু কি অদ্ভুত মায়ায় কালিঞ্জর দূর্গের মধ্যস্থিত জলধারা গুলি সমান তালে ও স্রোতে প্রবাহমান হয়ে চলে। মন্দিরের পুরোহিত হলেন চান্দেল বংশজাত রাজপুত।
মন্দিরের উপরের অংশের প্রবাহিত জলধারাকে সঞ্চিত করার নিমিত্ত প্রস্তর খোদন করে একটি কুন্ড নির্মিত হয়েছে, যা স্বর্গারোহন কুন্ড নামে পরিচিত। এর নিচের পাথরে একটি কালভৈরবের মূর্তি অবস্থান করছে এবং পরিকরে আরো বহু প্রস্তর মূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে।
ভগবান শিবের লিঙ্গের নিকট একটি পার্বতী মূর্তি ও একটি কালভৈরব মূর্তি অবস্থান করছে। মন্দিরের প্রবেশ দ্বার খচিত আছে অজস্র দেব দেবীর মূর্তির অলঙ্করণ । এখানে অনেক ভাঙা স্তম্ভ আছে । যেগুলো আয়তকার আকৃতিতে যুক্ত হয়ে অবস্থান করছে। ঐতিহাসিকদের মতে এই স্তম্ভ গুলোর উপরে ছয় মহলা মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি, অনেক প্রস্তরকলার নমুনা রয়েছে, যা যুগে যুগান্তরের খেলায় ক্ষয় প্রাপ্ত হয়েছে।
কালিঞ্জর দূর্গের সবথেকে বিখ্যাত ও প্রধান উৎসব হল কার্তিক পূর্ণিমার অবসরে লাগা পাঁচ দিনের ব্যাপী কতকী মেলা বা যাকে কতিকী মেলাও বলা হয়।এই মেলা ও উৎসবে হাজার হাজার শ্রদ্ধালু ভক্ত দূর হতে দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। ইতিহাস সাক্ষ্য অনুসারে চান্দেল শাসক পরিমর্দি দেবের ( ১১৬৫- ১২০২ খ্রিস্টাব্দ ) সময় সূচিত হয়েছিল। যা আজও অপরিবর্তিত হয়ে চলে আসছে।
এই কালিঞ্জর মোহৎসবের কথা রাজা পরিমর্দি দেবের মন্ত্রী ও নাট্যকার বস্তরাজ রচিত নাটক রূপক ষষ্ঠকম এ উল্লিখিত হয় । রাজা পরিমর্দি দেবের রাজত্বের সময় প্রতি বছর কালিঞ্জর মোহৎসবে মন্ত্রী বস্তরাজ রচিত দুইটি নাটক মঞ্চস্থ করা হত। কালান্তরে রাজা মদন বর্মার সময় কোনো এক নর্তকীর উল্লেখও কালিঞ্জরের ইতিহাসে পাওয়া যায়।সেই নর্তকীর নৃত্য মোহৎসবের মুখ্য আকর্ষণ ছিল।এক হাজার বছরের মত সময় ধরে পরম্পরা গত ভাবে এই মেলা চলে আসছে। এই উৎসবে ভক্তগণ বিভিন্ন সরোবরের জলে স্নান করে নীলকন্ঠ মহাদেবের মন্দিরে পূজা করেন। অনেক তীর্থযাত্রী তিন দিনের কল্প বাসও করেন। এখানে পাহাড়ের উপর গুফায় তিন খন্ড বিশিষ্ট পাথরে একটি নলকুণ্ঠ আছে। একে স্বরগবহর বলা হয়। ওখানেও প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হয়।
কালিঞ্জর দূর্গ ব্যবসায়িক দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখানের পাহাড়ের খাদানে ও বৃহস্পতি কুন্ডের মধ্যে হিরের খনি আছে। এছাড়াও এখানে কুটলা জ্বারির ঘন অরণ্যে এক ধরনের রক্ত বর্ন বিরল পাথর পাওয়া যায়। কিংবদন্তি অনুসারে প্রাচীনকালে মানুষ এগুলি থেকে স্বর্ণ উৎপাদন করতেন। এখানের পাহাড় গুলিতে উত্তম মানের গ্রানাইট পাওয়া যায়। এছাড়াও এখানে অরণ্য সেগুন, শিশু বৃক্ষের ন্যায় মূল্যবান বৃক্ষ আছে।
বিন্ধ্যাচল পর্বতমালার বিভিন্ন পাহাড় গুলির অরণ্য বনসপতি এবং ঔষধি বৃক্ষ সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে প্রচুর পরিমানে ক্ষীরপাদপ বৃক্ষ অর্থাৎ সীতাফল বা আতা গাছ আছে। এগুলি যেমন সুস্বাদু ফল হিসাবে বিক্রি হয় তেমনি এদের বীজ ঔষধি রূপে ব্যবহার করা হয়। এখানে গুমায় ( এক ধরনের বুনো ডুমুর )বীজ এবং হরীতকী প্রচুর পাওয়া যায় যা জ্বর ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মদনমস্ত বা দারুচিনি ও কাঁদির পাতা সিদ্ধ করে সেই জল ঔষধি হিসাবে ব্যবহার হয়। গরোখইমলি বা গোরখমুন্ডি রাজযক্ষা নিরাময়ের জন্য প্রোয়গ হয়। মারফোলি নামক গুল্মলতার প্রয়োগ পেটের ব্যামো সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। রক্ত আমাশয়ের জন্য এই জঙ্গলে কুরিয়াবেল ও স্থানীয় ঘুনচু নাম গুল্ম পিত্ত প্রদর নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ফলদু, কুটা, সিঁদুরী, নরগুনডী, রুশো, সহস্রমুষলী, পাথরচটা, গুমা, লটজীরা, দুধি ইত্যাদি বিভিন্ন ঔষধি গুল্মলতায় বিন্ধ্যাচল অরন্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
কালিঞ্জর দূর্গ অতিসুপ্রাচীন তার উল্লেখ এই প্রবন্ধ রচনার সূচনাতেই করেছি তেমনি বেদ ও পুরানাদিতে
কালিঞ্জর দূর্গ এর উল্লেখ এ ব্যাপারে নানা মন্তব্য করেছি। পুনঃ আমি আরো কিয়দ উদাহরণ যুক্ত করছি।
বায়ু পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে , ”
কালঞ্জরে দশার্ণাযং নৈমিষৈ কুরুজাংগলে॥
বারাণস্যা তু নগর্যা তুদেযং তু যন্ততঃ॥”
কুর্মপুরাণে উল্লিখিত হয়েছে , যে নীলকন্ঠ মহাদেব এখানে কালকে জীর্ণ করেছিলেন । তাই এর ভবিষ্যৎ নাম ছিল
কালিঞ্জর।
কালে মহেশ নিহতে লোকনাথঃ পিতামহঃ। অচাযত বরং রুদ্রম সজীবো যং ভবিত্বতি॥
ইত্থেতত্পরম তীর্থ কালংজর মিতিশৃতম। গত্বাম্যার্চ্য মহাদেবং গাআণপত্যং স বিন্দ্যতি॥
বামন পুরাণে কালিঞ্জর দূর্গকে নীলকন্ঠ মহাদেবের নিবাস স্থল বলে উল্লেখ করেছে।
কালঞ্জরে নীলকণ্ঠং সরশ্বামনুত্তম॥
হংসযুক্তং মহাকোশ্যাং সর্বপাপ প্রণাশনম॥
মহাভারতে বেদ ব্যাস কালিঞ্জরকে বেদের অংশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। উনি ব্যাখ্যায় বলেছেন যে , এই কালিঞ্জরের সীমা কুরু , পাঞ্চাল, মৎস্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত।
সন্তি রম্যাজনপদা বহবন্না: পারিতঃ কুরুন। পাংচালশ্চ-চেদি-মত্স্যাশ্চ শূরসেনাঃ পটচ্চরা॥
দশার্ণা: নবরাষ্ট্রশ্চ মল্লঃ সাত্বা, যুগন্ধরাঃ। কুন্তি রাষ্ট্র সুবিস্তীর্ণ সুরাষ্ট্রাবন্ত্যস্তথা॥
ইহা ব্যতীত ভবিষ্য পুরান, পদ্ম পুরান , ভাগবত পুরান, স্কন্দ পুরান, অগ্নি পুরান, ব্রহ্ম পুরান, মৎস্য পুরান, হরিবংশ পুরান, মার্কণ্ডেয় পুরান ইত্যাদিতে কালিঞ্জর মাহাত্ম্য উল্লিখিত হয়েছে।
উত্তর কালে বিভিন্ন গ্রন্থ ও নাটকে উক্ত দূর্গ ,তার মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য এর উল্লেখ করা হয়। চান্দেল বংশ কেবল শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্যের পৃষ্ঠ পোশাক ছিলেন না। তাঁরা একাধারে শিক্ষা ,সাহিত্য ইত্যাদির প্রতিও অসম্ভব সৃজনশীল ছিলেন। বহু বিদ্বান ব্যক্তি, পন্ডিত, নাট্যকার তাঁদের সভা অলঙ্কৃত করতেন। সেইসময় রচিত প্রবোধ চন্দ্রদয় , রূপকষষ্ঠকম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম বিশেষ ভাবে করছে।
পৃথ্বীরাজ চৌহানের প্রিয়বন্ধু, গুপ্তচর ও রাজকবি চাঁদবরদাই তাঁর ঐতিহাসিক সৃষ্টি পৃথ্বীরাজ রাসো তে কালিঞ্জর দুর্গের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
চলুন গ্রীষ্মের শেষে যে বর্ষা আসবে , আমরা সবাই যাই সেই যুগান্তরের ইতিহাসে…কালিঞ্জরে…
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কালজয়ী কালিঞ্জর : জাগরণ যাত্রা , দৈনিক জাগরণ ,দিওয়ান প্রতিপাল, কালিঞ্জর পরিচয় প্রথম অধ্যায়।