রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিতে গেলে এখনো রাজনীতি বিজ্ঞানের যে কোনো শিক্ষক বা অধ্যাপক ১৮ শতকের বিশিষ্ট ব্রিটিশ চিন্তাবিদ, রাজনীতিক ও বাগ্মী এডমন্ড বার্ক-এর সংজ্ঞার উল্লেখ করেন। এডমন্ড বার্ক(১৭২৯-১৭৯৭) রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “A party is a body of men united for promoting, by their joint endeavours the national interest upon some particular principle in which they are all agreed।” অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দল হলো কিছু মানুষের একটি গোষ্ঠী যা কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সম্প্রসারণের চেষ্টা করে। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা রাজনৈতিক দলের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। কারণ দেশের অস্তিত্বই যদি বিপন্ন হয় তবে নীতি, আদর্শ, উন্নয়ন প্রভৃতি ধারণার কোনো প্রয়োজন কিংবা প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। দেশই হলো রাজনীতির আধার। মহাশূন্যে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন থাকে না।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ঠিক করে দেবে আগামীদিনে দেশের রাজনীতি কোন পথে প্রবাহিত হবে। যে কোনো সাধারণ নির্বাচনে ইস্তাহার প্রকাশও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি পরিচিত প্রথা। ইস্তাহারের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল দেশের নাগরিকগণের সামনে তার ভবিষ্যৎ ভাবনা তুলে ধরে। ভবিষ্যতে দেশ ও তার নাগরিকদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কোন নীতি গ্রহণ করা হবে তার একটি দিশা পাওয়া যায় রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে। কিন্তু উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি তখনই সম্ভব যখন দেশ স্থিতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রকাশিত নির্বাচনী ইস্তাহারটি পড়ে সেই বহুশ্রুত বিতর্কটি মনে পড়ল— হাঁস আগে না ডিম আগে? হাঁসটিই যদি মরে যায় তবে ডিমের চিন্তা করে লাভ কী? দেশের ঐক্য এবং স্থিতিশীলতাই যদি বিপন্ন হয় তবে উন্নয়ন কিংবা জনগণের কল্যাণ প্রভৃতি ধারণাগুলি কিছু অর্থহীন বাগড়াম্বরে পরিণত হয়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রকাশিত ৫৫ পাতার ইস্তাহারে দেশবাসীর সামনে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অনেক স্বপ্ন ফেরি করা হয়েছে। কিন্তু দেশের ঐক্য ও সুরক্ষা নিয়ে এই ইস্তাহারে এমন কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে যাতে দেশের ঐক্য এবং অখণ্ডতাই বিপর্যস্ত হতে পারে। এই নিবন্ধে সেই দিকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।
ইস্তাহারের ২৪ পাতায় রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু ভাবনা, যে ভাবনা বিশ্লেষণ করলে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে দলটির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া সম্ভব। কংগ্রেস নাকি ক্ষমতায় এলে ‘নিরাপত্তা খাতে এনডিএ আমলের ক্রমহ্রাসমান বাজেট বরাদ্দকে পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী করবে এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ কর্মসূচি রূপায়িত হবে দ্রুত এবং স্বচ্ছতার সাথে’। এ কথা শুনে কবরে শুয়েও অট্টাভিও কাত্রোচ্চি অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারে। ১৯৮৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দল পরিচালিত সরকারের আমলে (সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্বর্গত রাজীব গান্ধী) বোফর্স কামান কেনা নিয়ে বহু কোটি (৬০ কোটি) টাকা ঘুষের অভিযোগ ওঠে এবং বোফর্স চুক্তিতে অন্যতম দালালের ভূমিকা পালন করেছিলেন গান্ধী পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অট্টাভিও কাত্রোচ্চি। কেলেঙ্কারিটি প্রমাণ হয়নি, কারণ এক্ষেত্রে অপরাধীরা হয় অতি ধূর্ত। তবে দুর্নীতির ধারাবাহিকতাও শেষ হয়নি। ১৯৮৬ সালে বোফর্স দুর্নীতি সবার সামনে আসার ঠিক কুড়ি বছর পরে ২০০৬ সালে আর এক কেলেঙ্কারির তথ্য সবার গোচরে আসে। এটি হলো অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড ভিভিআইপি হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি, যেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যাদের আমলে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র কেনা নিয়ে বারংবার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তারা ক্ষমতায় এলে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ কর্মসূচি রূপায়িত হবে দ্রুত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে একথা শুনলে রেসের মাঠের বাতিল ঘোড়াও হেসে উঠতে পারে। ইস্তাহারের ২৪ নম্বর পাতায় একটি শিরোনাম আছে–Pride in our Hard and Soft Power। কংগ্রেস কোনোদিন ভারতকে একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত করতে চায়নি। কংগ্রেসের নীতিই হলো ভারতকে একটি Soft Power হিসাবে রেখে দেওয়া যাকে কেউ খুশিমতো আঘাত করে যাবে কিন্তু সে প্রত্যাঘাত করবে না। ভারতে জাতীয় কংগ্রেসই সেই দল যে পাকিস্তান সীমান্তে প্রহরারত জওয়ানদের নির্দেশ দিয়েছিল কোনো অবস্থাতেই গুলি না চালাতে, কাশ্মীরে হিংস্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব সংযত আচরণ করতে। তার ফল ভোগ করছে গোটা দেশের মানুষ।
তবে কংগ্রেসের ইস্তাহারের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো দেশদ্রোহিতা এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আপোশ করার নীতি। ইস্তাহারের ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২৪এ ধারার অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে যে ধারায় দেশদ্রোহিতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সংস্থান আছে। দেশের নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন আওয়াজ ওঠে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে- ইনসাল্লা, ইনসাল্লা’ তখন দেশদ্রোহিতা বিষয়ক বিধিব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটালে গোটা দেশে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এরই বাড়বাড়ন্ত হবে। ৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় আরও একটি বিপজ্জনক ঘোষণা— “The Armed Forces (Special Powers) Act and the disturbed Area Act in J & K will be reviewed.” অথচ AFSPA আইন প্রণীত হয় কংগ্রেস আমলে, ১৯৫৮ সালে। এই আইন এবং ১৯৭৬ সালে প্রণীত Disturbed Area Act ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সন্ত্রাস দমনের অন্যতম হাতিয়ার। অন্য সবকিছুর মতো সন্ত্রাসবাদও তার চরিত্র বদলেছে। পার্শ্ববর্তী কিছু দেশের প্ররোচনা এবং মদতে সন্ত্রাসবাদীরা এখন অনেক বেপরোয়া, তাদের হাতে এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র। ভারতের সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করছে। বিগত পাঁচ বছর কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তরপূর্ব ভারতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ নেওয়ার কারণে সন্ত্রাসবাদী এবং জেহাদিরা একেবারে কোণঠাসা। সংঘর্ষের সংখ্যা বেড়েছে, কারণ সন্ত্রাসবাদীরা মরিয়া হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করছে। নিরাপত্তা বাহিনীও বহু সন্ত্রাসবাদীকে নিকেশ করেছে যার মধ্যে আছে বুরহান ওয়ানির মতো আধুনিক শিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী। এই সময় AFSPA এবং Disturbed Area Act তুলে দিলে নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ধাক্কা খাবে, উৎসাহিত হবে সন্ত্রাসবাদী এবং জেহাদি গোষ্ঠী। এরপর কাশ্মীরকে ভারতের মানচিত্রে ধরে রাখা সম্ভব হবে তো? ১৮১৭ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রো হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ইউরোপের বলকান অঞ্চল টুকরো টুকরো হয়ে যায়। জন্ম নেয় বেশ কয়েকটি স্বাধীন দেশ। এরপর ইংরেজি অভিধানে Balkanisation নামক ভূ-রাজনৈতিক শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়। কংগ্রেসের নীতি এদেশে Balkanisation এর পথকে প্রশস্ত করবে না তো? ভারতের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান উঠেছিল ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে- ইনসাল্লা, ইনসাল্লা’। কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি তার নিন্দে করেননি। বরং তাকে তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল।
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে জাতীয়তাবোধ। তাকে ধ্বংস করে সংকীর্ণ রাজনীতি। যে সংগঠন এক সময় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল, ক্ষমতার জন্য সে আজ দেশকেও ভয়ংকর বিপদের মুখে ঠেলে দিতে প্রস্তুত। এবার নির্বাচনে পরাজিত হলে আদৌ সংগঠনটি টিকে থাকবে তো? ভবিষ্যই এর উত্তর দেবে।
বিমল শঙ্কর নন্দ
2019-04-22