‘এন. আর. এস‘ (N. R. S.) -এর পুরো নাম নীলরতন সরকার, ইংরেজিতে পদবীর বানান লিখতেন Sircar। তিনি খ্যাতনামা ডাক্তার ছিলেন, ছিলেন শিক্ষাবিদ৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবেও তাঁর অধিষ্ঠান ছিল (১৯১৯-১৯২১), শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর (Shyamaprasad Mukherjee) সঙ্গেও ছিল ঘনিষ্ঠতা।
একসময় কলকাতার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন, সেই স্কুলে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে, পরে যিনি স্বামী বিবেকানন্দ হলেন। তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর ১৯৪৮ সালে এন. আর. এস মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়।
শিক্ষাবিদ হিসাবে স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সঙ্গে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনা কার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আশুতোষ মুখার্জীর সঙ্গে তিনি অনন্য ভূমিকায় এগিয়ে এলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে দেশীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও তাঁর মনোযোগ ছিল, ১৯৩২ সালে নিখিল ভারত মেডিক্যাল কনফারেন্সে তাঁকে সভাপতি করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত ‘কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সায়েন্স’-এর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
নীলরতনের জন্ম ডায়মন্ড হারবারের সন্নিকটে ন্যাতড়া গ্রামে ১৮৬১ সালের ১ লা অক্টোবর। স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল প্রযুক্তি বিজ্ঞানের প্রতি; কিন্তু না, তাঁকে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য করলো তাঁর পারিবারিক পরিস্থিতি, মা মৃত্যুশয্যায়, খুলনা জেলায় গরীব বাবার তত্ত্বাবধানে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। তিনি ও তাঁর ভাই যোগীন্দ্রনাথ সরকার (পরে বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক, ১৮৬৬ — ১৯৩৭) পড়াশোনা করছিলেন মামাবাড়ি থেকে, বহড়ু হাইস্কুলে। বাবা ওষুধপত্র ও পথ্যের যোগান দিতে পারেন নি তাঁর মা-কে, রোগও ধরা পড়ে নি। নীলরতনের শৈশব জীবনে এলো হাহাকার! মা কীভাবে চলে গেলেন, জানতেই হবে! মামাদের তেমন আর্থিক সামর্থ্য নেই, তবুও ভাগ্নের স্বপ্ন সার্থক হল একদিন। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় এলেন, ‘ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল’-এ ভর্তি হলেন। ১৮৭৯ সালে দেশীয় ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে পেলেন ডিপ্লোমা। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এ. ও বি. এ. পাশ করেছিলেন। একসময় হুগলী জেলার শ্রীরামপুর সন্নিকটস্থ চাতরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাজে যোগদান করেছিলেন। তারপরে যোগদান করেছিলেন কলকাতার গ্রে স্ট্রিটের স্কুলে, এই স্কুলে চাকরি করলেন এক বছর, এখানে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সহকর্মী।
এরপর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন, তখন ১৮৮৫ সাল৷ এম. বি ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ১৮৮৮ সালে। ধাত্রীবিদ্যার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল, মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন ধাত্রীবিদ্যার জন্যই বিশেষ গুডিভ বৃত্তি পেয়েছিলেন। এম.বি পাশ করে তিনি হাউজ সার্জেন হিসাবে কাজে যোগ দিলেন, প্রথমে চাদনি ও পরে মেয়ো হাসপাতাল। ১৮৯০ সালে তিনি এম. এ ও এম. ডি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৮৯০ সাল থেকে তাঁর বর্ণময় কর্মজীবন। চিকিৎসক হিসাবে তিনি সেই সময় কলকাতার নানান মনীষীকে চিকিৎসা করার সুযোগ পান। পেশাগত দক্ষতা, রোগ নির্ণয়ে বাস্তবতা-বোধ, চিকিৎসায় আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জরুরী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, রোগীদের প্রতি সেবাযত্নের পারিপাট্য তাঁকে চিকিৎসা শাস্ত্রে উন্নতির শিখরে তুলেছিল। চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি প্রভূত ভ্রমণ করতেন, প্রতিবেশী দেশেও যেতেন নানান সময়। তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সেই সময় ১৯২০ সালে লন্ডনে Empire University Conference -এ গিয়েছিলেন। সেই যাত্রাতেই তাঁর কর্মজীবন ও পেশাগত জীবনের সেরা উপাধি লাভ হল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পেলেন DCL (ডক্টরেট অফ সিভিল ল) এবং এডিনবারা ইউনিভার্সিটি থেকে পেলেন LLD (ডক্টরেট অফ লেজিসলেটিভ ল)। আগে ১৯১৮ সালেই ব্রিটিশ সরকারের থেকে নাইট উপাধি লাভ করেছিলেন।
তিনি কলতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সময় সিস্টার নিবেদিতার সেবাকাজ নিজ চোখে পরিদর্শন করেছিলেন। তখন ১৮৯৮-৯৯ সাল। তিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের বহু বৎসর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সংগঠনের মেডিক্যাল জার্নালের চীফ এডিটরও হয়েছিলেন। তাঁরই হাত ধরে পথ চলা শুরু করলো ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাব। কলকাতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেন তিনি; এরমধ্যে রয়েছে চিত্তরঞ্জন সেবাসদন, চিত্তরঞ্জন হসপিটাল, যাদবপুর টিউবারকিউলোসিস হসপিটাল। তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রথম গভর্নিং কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯২২ সালে ‘মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ -এর প্রেসিডেন্ট হলেন, একাদিক্রমে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অফ সায়েন্সস’-এরও তিনি প্রেসিডেন্ট হন ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। ১৯৪০ সালে তাঁর ব্রেনস্ট্রোক হয়, এরপর থেকে তিনি সমস্ত দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন। ১৯৩৯ সাল থেকেই নিজেকে এমনতরো গুটিয়ে আনার শুরু, ওই বছরের মাঝামাঝি তাঁর পত্নী বিয়োগ ঘটে। নীলরতন সরকারের পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র। ১৯৪৩ সালের ১৮ ই মে গিরিডিতে তাঁর জীবনাবসান হয়। জানা যায়, মৃত্যুকালেও তিনি অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন, অথচ সারাজীবন কত রোজগারই না করেছিলেন। দেশের জন্যে অনেক দানধ্যান করেছিলেন বলেও জানা যায়। এই নীলরতনের নামেই কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty) এবং অংশুমান মাহাতো (Anshuman Mahato)।