ভারতের মধ্যে ভারত বিরোধীরা

আজকাল কিছু তথাকথিত আধুনিক ভারতীয়র মনে নেতিবাচক প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে। দেশের মধ্যে এই সমস্ত স্বঘোষিত অভিজাত বর্গের লোকেদের দ্বারা এক অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ চলছে যার মধ্যে গৃহযুদ্ধের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। এর দ্বারা দেশের সাংস্কৃতিক ধারার প্রধান প্রচেষ্টা পতনোন্মুখী হবে বা বিদেশিদের অনুকরণে প্রয়াসী হবে, যার ফলে কোনো ভারতীয় তথা হিন্দু এই ধারার সংরক্ষণ বা সংশোধন করতে সমর্থ হবে না। ভারতের এইসকল অভিজাতবর্গ ভারতের মূল পরম্পরা ও সংস্কৃতির থেকে সর্বদা আলাদা ভাবনা পোষণ করে। এই বর্গের লোকেরা ক্ষমতায় বসে পুরনো ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশীয় অবতার রূপ ধারণ করে, নিজেরা আলাদা ছাতার তলায় বাস করে সাধারণ লোকেদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে, তাদের সামাজিক রীতি পালন করাকে অশ্রদ্ধা করে। ইংরেজি বলা এই বর্গ নিজভূমির পরিচয় ত্যাগ করে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করে।

বিশ্বে এই রকম কোনো দেশ আছে কি যেখানে রাষ্ট্রীয় স্তরে নিজস্ব সংস্কৃতি ও চিরকালীন পরম্পরাগত ইতিহাস বিকৃত করতে আনন্দিত হয় ? ভারতের প্রাচীন গাথা ও পুরাতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষ যখন প্রমাণ সাপেক্ষে সবার সামনে উন্মোচিত হয় তখন এই লোকেরা আবিষ্কার ভেবে গৌরব বোধ না করে হাসিঠাট্টা করতে থাকে। অর্থাৎ এটাকে অসভ্য ও সামন্তবাদী পরম্পরার অঙ্গ হিসেবে কপোলকল্পনা করে। সম্ভবত, এর কারণ হলো— বিশ্বে এরকম কোনো দেশ নেই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেদের ধর্ম নিয়ে বাকিরা মজা করে— যে জনসমাজ জ্ঞানসমৃদ্ধ, চৈতন্যযুক্ত ও আধ্যাত্মিক । অপর পক্ষে অল্পসংখ্যক মতবাদীরা কট্টরপন্থী বা উগ্রবাদী হলেও বীরবিক্রমে এগিয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বা সংস্থার উপর যে ঋণের বোঝা থাকে বা যে আইন নির্ধারিত হয়, তা অল্পসংখ্যক লোকেদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। তারা ঠিকমতো আইন মানে না, দেখারও কেউ থাকে না। অল্পসংখ্যক মতের লোকেরা মাদ্রাসার মাধ্যমে নিজেদের মনমতো বিষয় পড়াতে পারে, তা সে রাষ্ট্রবিরোধী বা ব্যবহারিক দিক থেকে অনগ্রসর হলেও | অল্পসংখ্যক মতের বিরুদ্ধে। কোনো পুস্তক লিখলে তা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রদ্ধার কেন্দ্রকে কেউ আঘাত বা অপমান করলে কিছু যায় আসে না, বরং তীব্র প্রতিবাদের বদলে মহিমামণ্ডিতই করা হয়।

বিশ্বে দ্বিতীয় কোনো দেশ আছে কি যেখানে রাষ্ট্রের কল্যাণকে উপেক্ষা করে আঞ্চলিক, জাতিগত বা পরিবারের প্রতিনিষ্ঠাকে বড়ো করে দেখা হয়? এমনকী যারা নিজেদের গণতান্ত্রিক, সমাজবাদী বা সমাজ সংস্কারক দাবি করে তারাও এর থেকে বেরুতে পারে না। এরা রাজনৈতিক দল তৈরি করে রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নয় বা কোনো রাষ্ট্রীয় বিষয়কে সামনে রেখে নয়, বরং আঞ্চলিক বা জাতিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে। এদের প্রত্যেক গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদের বড়ো অংশ ভোগ করার জন্য লালায়িত থাকে। তারা বুঝতে চায় না যে, যত বেশি তারা আদায় করে নেবে, অন্যের ভাগ ততটাই ছিনিয়ে নেওয়া হবে। জোর করে নিজের পকেট ভরলে অপরের পকেট ততটাই খালি হবে। ভারতে অসম বণ্টনের এই নিয়ম জারি রয়েছে এবং তার ফলে অসন্তোষও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। | আশ্চর্যের কথা, কিছু সম্প্রদায়ের মানুষের চাকুরিক্ষেত্রে যোগ্যতার মাপকাঠি না হয়ে অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকট হচ্ছে। অপরপক্ষে বাকিদের উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জাতি প্রথা শেষ করতে গিয়ে এক নতুন জাতিবাদ জন্ম নিচ্ছে— যার ফলে স্কুল-কলেজে ভর্তির বা চাকুরি ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতের লোকেদের বিভিন্ন যোগ্যতার প্রাধান্য আছে। ব্রাহ্মণ-বিরোধী ভাবনা জাতপাতের রাজনীতি রূপে প্রচলিত রূপে সামনে এসে গেছে। জনগণের ভোটে জেতানো সরকারকে ব্যক্তিগত স্বার্থের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, যাতে দেশের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভ প্রকট হচ্ছে। ভারতের ক্ষতি করার জন্য বাহিরের লোকের প্রয়োজন নেই, ভারতীয়রাই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই কাজ করছে। এতে শুধু নিজেদের নয় দেশের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। নিজের প্রতিবেশী পিছিয়ে পড়ছে বা দেশের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে জেনেও এই সমস্ত লোকের কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করাই এদের লক্ষ্য। এই ভারতীয়রাই যখন বিদেশ যায় তখন সাধারণত ভালো সফলতা পায়, কারণ সেখানে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী বাধা দেওয়ার কেউ থাকেনা, সামাজিক ভেদভাবপূর্ণ পরিবেশের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে হয় না।। | ভারতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের লোকেরা ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে কেবল নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বৃদ্ধি করে ও দেশের সম্পত্তি লুঠ করে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অনেক অপরাধী, ধূর্ত, মুখলোক জুড়ে যায়, কারণ তারা ক্ষমতা দখলের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে। এমনও দেখা যায় যে তথাকথিত উদারবাদী ও আধুনিক দলের নেতারা রাজা-প্রজা সম্পর্কের মতো ব্যবহার করে যার দ্বারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে ব্যক্তিগত খবরদারি বেশি প্রাধান্য পায়। এই সব নেতা একবার ক্ষমতায় এলে জনগণের সেবা করার বদলে নিজের লাভের জন্য সবাইকে ধোঁকা দেয়। মহাভ্রষ্ট নেতার অনেক চেলা থাকে, তাই ভ্রষ্টাচারের কিছু চিহ্ন তাদের মধ্যেও দেখা যায়। নেতারা ভোটব্যাঙ্ককে সামনে রেখে সমাজের এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণীর দূরত্ব বাড়িয়ে দেয় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়কে কিছু উপহার দিয়ে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাস্তা পরিষ্কার রাখে। নেতারানির্বাচনী অভিযানের সময় এমন ভাবে কথা বলেন যাতে রাষ্ট্রীয় সদভাব তৈরি হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণীগত ভয় ও সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়। সমাজে পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে বাস্তবমুখী কার্যক্রম না রেখে পরস্পরের প্রতি দ্বেষ ও ঘৃণা উৎপন্ন করে নিজেদের আখের গোছায়। এরা অশিক্ষিত জনতার মধ্যে বাস্তবিক সামাজিক সমস্যা যেমন- জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মন্দ পরিকাঠামো, শিক্ষার অভাব ইত্যাদির জাগরণ না করে নিজস্বার্থ সিদ্ধির জন্য লোকদেখানো প্রচার করে। দেশে যখন এক সবল সরকার ক্ষমতায় আসে তখন বিরোধীদের লক্ষ্য থাকে যেভাবেই হোক সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতা দখল করা। আজকাল সদর্থক ও সহযোগী বিরোধীপক্ষ প্রায় দেখা যায় না। একমাত্র লক্ষ্য নিজে ক্ষমতায় বসা।।

ভারতীয় নেতারা নিজেদের মহত্ত্বাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বিরোধীদের বদনাম করতে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকেও নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করতে ছাড়ে না। তাতে যদি মিথ্যা বলতে হয় বা দেশের সম্মানে আঘাত লাগে তাও স্বীকার্য। ভারতের কোনো তুচ্ছ ঘটনা বিদেশি সংবাদমাধ্যম যখন বড়ো করে দেখায়, তখন এখানের গুটিকয়েক লোক ওই সুযোগে মহা বিস্ফোটক প্রচার করে পরিবেশ দূষিত করতে ছাড়ে না। বিদেশি প্রেমের জন্য ভারতের খবরকে আরও দূষিত করে কিছুলোক নিজের দেশের সম্পর্কে বিষ উগরে দিচ্ছে। একজন খ্রিস্টান মিশনারি হত্যা হলে ‘খ্রিস্টান বিরোধী হামলা হিসেবে জাতীয় স্তরে পত্র পত্রিকায় হইহল্লা চলতে থাকে, কিন্তু শত শত হিন্দুর হত্যা হলেও সেটাকে ছোটো ঘটনা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ভাবটা এমন হয় যেন সাদা চামড়ার লোকের দাম বেশি। মিশনারিদের আন্দোলনকে ‘সামাজিক উত্থান’ রূপে পরিগণিত করা হয়।।

অপরদিকে ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তাকে কট্টরবাদী মনে করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— লালপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিংহ যাদব প্রভৃতি নেতারা নিজেকে রাজ্যের মুকুটহীন বাদশা ভাবেন এবং নিজস্ব চাটুকারদের দ্বারা পরিবৃত থাকেন। আধুনিক কালের বহু নেতা যারা ঔপনিবেশিক শাসকেদের থেকে কোনো অংশে কম নয়, যারা নিজের দেশকেই লুঠ করছে, ‘বিভেদ কর ও শাসন কর’নীতিতে চলছে, যাতে সাধারণ মানুষ এত দুর্বল হয়ে পড়ে যেন চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতাটুকু না থাকে।

ভ্রষ্টাচার প্রায় সব জায়গায় ছেয়ে গেছে, আর সম্পর্ক প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে স্বার্থ পূরণের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ভারতে এক আমলাতন্ত্রের রাজত্ব চলছে, যারা রাজরোষে পড়তে চাইছে না। এজন্য তারা পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, বিকাশের গতি রুদ্ধ করছে।

মুখ্যরূপে, হিন্দুবহুল দেশে সবচেয়ে পুরনো কংগ্রেস পার্টি একজন ইতালীয় ক্যাথলিক মহিলাকে প্রধান দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। কারণ গান্ধী পরিবারের শেষ প্রধানমন্ত্রীর বিধবা পত্নী হিসেবে তিনি মশাল ধরে রেখেছেন, যেন পরিবারতন্ত্র ও তার প্রতি আনুগত্য এখনও পর্যন্ত দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রধান আধার। চিন্তার বিষয় হলো, এই সমস্ত নেতা ও দলকে প্রগতিশীল মনে করা হয়।।

গত কয়েক বছরের অস্থির রাজনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা ভারতের পরিচয় দেওয়া যায় না। এই দেশের সভ্যতা বিশ্বের মধ্যে প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ সভ্যতার মধ্যে এক। এই দেশের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার জন্য জিহাদের ফলে উৎপন্ন উগ্রবাদী ও কট্টরপন্থী সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসার দরকার হয় না। এই দেশের ধর্ম ও দর্শন হলো অপার্থিব, পরমজ্ঞানী, চেতনা সৃষ্টিকারী। ভারতে সেই সমস্ত প্রধান প্রধান মত ও পথের উদ্ভব হয়েছে যা ঐতিহাসিক দিক থেকে পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতি সহিষ্ণুতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। এখানেই সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি হয়েছে, যা সারা বিশ্বের মধ্যে সমৃদ্ধ ভাষা। এখানেই যোগের মতো আধ্যাত্মিক প্রণালী, ধ্যান, স্মরণ-মনন ও আত্মজ্ঞানের পরম্পরা বিদ্যমান।

বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠতম সার্বভৌম স্বরূপ প্রাপ্ত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি কেন্দ্রিত রয়েছে ভারতবর্ষের। মজহবি কট্টরবাদীতার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় এই মহান দর্শন ভবিষ্যতের পথনির্দেশ করবে।

বিড়ম্বনার বিষয় এই যে, এখানে মূল পুরাতন পরম্পরাকে গ্রহণ না করে আধুনিক ভারতীয় মানসিকতা মার্কসবাদের মতো পশ্চিমি মতের পদলেহন করে খুশি হয়। এমনকী খ্রিস্টান মিশনারি ও ইসলামি মোল্লা-মৌলবিদের দ্বারা কৃত উগ্রতাকে বৈধ মনে করে। অথচ এই তথাকথিত অভিজাত অর্থাৎ ভারত-বিরোধীরা ভারতে থেকেও মন্দির, সাধুসন্ত এবং মহান উৎসবের পবিত্র ধারার সঙ্গে একাত্ম অনুভব করেননি। অধিকাংশ আধুনিক বুদ্ধিজীবী ভারতের মতো পবিত্র ভূমির আত্মা দর্শন করেননি। এরা লোহার মিনারে নিজেদেরই অজানা মতাদর্শে বন্দি রয়েছেন।

ড. ডেভিড ফ্রলে

(লেখক আমেরিকার নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব বৈদিক স্টাডিজ-এর সংস্থাপক ও যোগাচার্য)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.