প্রথম পর্ব
ততোহখিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরা বৃষ্টৈ প্রাণ ধারকৈ।
শাকম্ভরী বিখ্যাতং তদা যাস্যমহং ভূষি।।
ভারতবর্ষে বৃক্ষলতা উর্বরতা বর্ধনে সহায়ক এবং তা কেবল শস্যাদি , খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। অক্সিজেন, ওষধি , জ্বালানী , বাসগৃহ, বস্ত্র, বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী বস্তু সমূহ, সকল কিছু একটি বৃক্ষ প্রদান করতে পারে। তাই ধনজনসন্তান কামনা, রোগশোকপাপ দূরীকরণ ইত্যাদি পার্থিব ও পার্থিব আকাঙ্খা পূরণের জন্যও বটে। তাই নিরাকার পরম ব্রহ্ম রূপে বৃক্ষকে সেই প্রাচীন কাল হতে পূজা করে আসছে সনাতনী মানব। তাই দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন । তাই ব্রহ্ম স্বরূপ নিরাকার প্রকৃতি মহামায়া মা দুর্গা বোধন হয় নবপত্রিকায়। ওই নবপত্রিকা এবং ঘটই পূজা মুখ্য বিষয়। আজও তাই বহু স্থানে নবপত্রিকার সম্মুখে ঘটেপটে পূজা হয়। নবপত্রিকার নয়টি বৃক্ষ হল কদলী, কচ্চি, হরিদ্রা , জয়ন্তী, শ্রীফল, দাড়িম্ব, অশোক, মান্য ও ধান্য। পূজা মন্ত্রগুলোতে দেখা যায় একটি বৃক্ষ বা পত্রিকাকে দেবতা বা তাঁর প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসারে যথোচিত প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
ঠিক একই ভাবে লক্ষ্মী পূজায়ও মহাদেবীকে শ্ৰী হিসাবে এবং ভূমাতা হিসাবে, ধনদায়ীনি হিসাবে পূজার সময় ধান, আখ, সরিষা, নানা প্রকার শাক , কলার ভেলা ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসাবে প্রদান করা হয়। সনাতনী সমাজে মহাবিষ্ণু সংক্রান্তিতে #ফলদান_সংক্রান্তি ব্রত পালন করা হয়। উক্ত দিনে সবস্ত্র , সপাত্র নারিকেল ফল বিষ্ণুকে দান করলে নিখিল পাতক দূর হয়। পুরোহিত দর্পন, ক্রিয়াকান্ড বারিধি ইত্যাদি নানা গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ আছে। এই রূপে একেকটি মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ বিশেষ ফল দান করলে মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং, জনধনউৎপাদন , পাপ দূরীকরণ , মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি জাতীয় কামনা বাসনা বৃক্ষ উপাসনার নেপথ্যলোকে বিরাজিত থাকে। এই সকল কারনে বৃক্ষরোপণ সনাতনী প্রথায় একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
মৎস্য পুরাণে বলা হয় ” একটি বৃক্ষ দশজন সন্তানের সমান। ” বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে , ” একজন সুসন্তান যেমন তাঁর পরিবারকে রক্ষা করে তেমনই পুষ্প ও ফলশোভিত একটি বৃক্ষ তাঁর পিতা সমান রোপনকারীকে নরকগামীতা হতে রক্ষা করে এবং যে ব্যক্তি পাঁচটি আম্রবৃক্ষ রোপন করেন তিনি নরকে যান না।” অর্থাৎ , বৃক্ষ রোপণের পুণ্যফল নরকগমনহতে রোধ করতে পারে।
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের মন্তব্য এইরূপ ” একটি সন্তান যা সম্পাদন করে , কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচর্যাকৃত একটি বৃক্ষও সেইরূপ করে, কেন না এটি তার ফুল দ্বারা দেবতাকে , ছায়া দ্বারা পথচারীকে এবং ফলের দ্বারা ক্ষুধার্তকে তুষ্টি দান করে। ফলে, বৃক্ষ রোপণকারীর নরকগমন হয় না।” সন্তানের চাইতেও বৃক্ষরোপন কর্মটিকে অধিক গুরুত্ব সনাতনী শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
বৃক্ষই সব , তাই তাঁকেই পূজা কর, সেই কারণেই মহাকালী মহামায়া মহালক্ষ্মী মহাবিদ্যা দেবী দুর্গা শাকম্ভরী রূপেও পূজিতা। সুপ্রাচীন গ্রন্থাবলী সমূহ যথা – বেদ, রামায়ণ, মহাভারত , গীতা, নানা পুরাণাদি হতে কালিদাসের রচনাবলী , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী , সকল স্থানে বৃক্ষের প্রশস্তি হতে এই উপলোব্ধি করা যায় যে, ভারতে বৃক্ষোপসনা অতি প্রাচীন আচার ছিল। এই আচার কোনো কালেই লুপ্ত হয়ে নি। পদ্মপুরাণ এবং মৎস্য পুরাণে #বৃক্ষোৎসব বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবৃত হয়েছে।
বটের ফলে আরতি তার ,
রয়েছে লোভ নিমের তরে,
বনজামেরে চঞ্চু তার
অচেনা ব”লে দোষী না করে ।
শরতে যবে শিশির বায়ে
উচ্ছ্বসিত শিউলিবীথি,
বাণীরে তার করে না ম্লান
কুহেলিঘন পুরানো স্মৃতি ।
শালের ফুল-ফোটার বেলা
মধুকাঙালী লোভীর মেলা,
চিরমধুর বঁধুর মতো
সে ফুল তার হৃদয় হরে ।
সিন্ধু সভ্যতা অঙ্কিত নানা মূর্তি এবং পরবর্তী পর্যায়ে নানা ভাস্কর্যাদিতে বৃক্ষোপসনার প্রমাণ প্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী র ভারত স্তূপে বোধি বৃক্ষ, কদলী, ন্যাদ্রোধ , উদুম্বর, শিরীষ, শাল , আম্র, তাল, অশোক , পাটলি , নাগকেশর ,পিপল প্রভৃতি বৃক্ষের পূজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আবার খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সাঁচী ও অমরাবতী এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাগার্জুন কোন্ডার ভাস্কর্যে পিপল ও বোধিবৃক্ষ পূজার দৃশ্য আছে। এছাড়াও খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরা , খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগের দেওঘর, খ্রিস্টীয় সপ্তম হতে নবম শতকের ইলোরা এবং অন্যান্য স্থানের ভাস্কর্যে বৃক্ষের নিম্নে দেবী মূর্তি, ভগবান মহাদেব ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। ভাস্কর্যগুলি প্রমাণ করে বৃক্ষকে পূজা বহু অতীত কাল হতে সুবিশাল ভারতে প্রচলিত হয়ে আসছে।
এই সকল বৃক্ষ যাঁরা সনাতনে উপাসিত হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হল শাল বৃক্ষ।
দূরে চেয়ে রব আমি স্থির
ধরণীর
বিস্তীর্ণ বক্ষের কাছে
যেথা শাল গাছে
সহস্র বর্ষের প্রাণ সমাহিত রয়েছে নীরবে
নিস্তব্ধ গৌরবে।
শাল বা গজারী গাছ বিষ্ণুর আশীর্বাদপ্রাপ্ত । ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে শালকে প্রায়ই অশোক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সনাতনী ভারতের প্রতিটি জাতিদের কাছে শাল অতি পবিত্র গাছ। বনবাসীগণ শালকে মনে করেন বনের রাজা, আর তাঁর সভাসদ হল, কুসুম, করম, পিয়াল, মহুয়া, পলাশ। শাল গাছ বলতে গেলে দীর্ঘজীবী এবং প্রায় অমরত্ব প্রাপ্ত। কারণ , শাল গাছের সামান্য গোড়া থেকে পুনশ্চ নতুন গাছ জন্মায়। তাই এই গাছকে গজারী বলা হয়। প্রসঙ্গত , দেবাদিদেব মহাদেব গজাসুরকে বধ করেছিলেন , তাই তাঁর অপর নাম #গজারী।
শাল বৃক্ষতলে শাক্যমুনির আবির্ভাব এবং তিরোধান হয়। তাই শাল বৃক্ষ বৌদ্ধ মার্গে অতি পবিত্র বৃক্ষ বলে মনে করা হয়। শাল বৃক্ষতলে সম্ভবনাথ , আদিনন্দনাথ , মহাবীর প্রমুখ জৈন তীর্থঙ্কর সিদ্ধি লাভ করেন। তাছাড়া, উক্ত তীর্থঙ্করদের লাঞ্ছনা চিন্হগুলির মধ্যে
শাল বৃক্ষ অন্যতম। তাই সনাতন এবং সনাতন হতে উৎপন্ন নানান মার্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শাল বৃক্ষ উপাসনীয় বৃক্ষ। শাল বৃক্ষের প্রতিটি অংশ ব্যবহার যোগ্য। তাই, রামায়ণ হতে মহাভারত সকল মহাগ্রন্থে বারংবার অরণ্যাদির বর্ণনায় শাল বৃক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্ বিশাল-কায়া
হেথায় জাগিছে আলো, হোথায় ঘুমায় ছায়া।
কোথাও বা বৃদ্ধবট–
মাথায় নিবিড় জট;
ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল;
কোথাও বা ঋষির মতো
অশথের গাছ যত
দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল।
শাল বনের মাঝে , টুপ টুপ ঝরে পড়া শাল ফুলের মধ্যে দিয়ে, সবুজ বনের ভেতর পথ। সে পথ ধরে ঢুকলে পাওয়া যাবে নিভৃত ঘন সবুজ বন। পাখির কিচিরমিচির ডাকের সঙ্গে একটু পর পর ডেকে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা। নানা রঙের ফড়িং, ভিমরুল, মাকড়সা, বুনো ফল….সেসব পথ দিয়ে আজ আমি আপনাদের কেবল বনের রাজা শাল বৃক্ষের কথা বলতে বলতে উত্তরবঙ্গ থেকে রাঢ় অঞ্চলে নিয়ে চলে যাব। চলুন পথ চলা শুরু করি !..
শুনেছি আকাশ তারে
নামিয়া মাঠের পারে
লোভায় রঙিন ধনু হাতে,
আসি শালবন-‘পরে
মেঘেরা মন্ত্রণা করে
খেলা করিবারে তার সাথে।
যারা আমাদের কাছে
নীরব গম্ভীর আছে,
আশার অতীত যারা সবে,
খোকারে তাহারা এসে
ধরা দিতে চায় হেসে
কত রঙে কত কলরবে।
ভারতের নানা স্থানে তথা পশ্চিমবঙ্গে সেই সুপ্রাচীন কাল হতে নানা বৃক্ষকে পরমেশ্বর স্বরূপ পূজা করা হয়। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজ হতে রাঢ় অঞ্চলের আদিম অধিবাসীগণ কেউই সেই নিয়মের বাইরে যান নি। শাল বৃক্ষ সনাতনী বৃক্ষ , ধর্মীয় বৃক্ষ। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে শাল বৃক্ষ দেবরূপে পূজা পান। এই পূজার নাম শালশিরী বা শালশিরি পূজা। রাজবংশীরা অবশ্য শালশিরি বানানটি ব্যবহার করেন। শ্রদ্ধেয় চারুচন্দ্র স্যানাল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে শালশিরিকে শালেশ্বরী বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু বিদ্বদ্জনের মতে , শালেশ্বরী নামটি সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা যায় না। শালেশ্বরী শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে শাল এবং ঈশ্বরী শব্দদুইটি পাওয়া যায়। হয়ত লোকমুখে কালের নিয়মে ঈ লুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন – নয়ান + ঈশ্বরী = নয়ানেশ্বরী না হয়ে নয়ানশ্বরী হয় এবং কালক্রমে এর উচ্চারণ নয়ানশোরী হয়। ঠিক একই ভাবে দেখনশোরী , ধনশোরী ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সুতরাং ঈশ্বরী শব্দ যুক্ত করলে উপাস্যের নাম হয় শালশোরী।
কিন্তু রাজবংশীরা শালশিরি নামে অভিহিত করেন । সম্ভবত শাল শব্দের সঙ্গে শ্ৰী শব্দের যুক্তিকরণের ফলে এমন নাম এসেছে। কারণ , অনেক সময়ই উচ্চারণ বিভ্রাটের জন্য শ্ৰী এই শব্দকে মানুষজন ছিরি বলে উচ্চারণ করেন।তাই ছিরি = শিরি অসম্ভব নয়। যেমন – থানছিরি বা থানশিরি একটি গ্রাম ঠাকুরের নাম। আসলে শব্দটি হল স্থানের যে শ্ৰী ( লক্ষ্মী) = স্থানশ্ৰী। সনাতনে বিল্বফলের অপর নাম শ্ৰীফল, কিন্তু উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে অনেকেই ছিরিফল বা শিরি ফল বলার থাকেন। এই সকল কারণে আমরা শালেশ্বরীর পরিবর্তে অকৃত্রিম উচ্চারণ অনুসারে রাজবংশী সম্প্রদায়ের পূজ্য শালশিরি নামটি রাখতে পক্ষপাতী।
উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ,জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলাত্রয়ে শালবাগানের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। শালশিরি দেবতার পূজা প্রধানভাবে রাজবংশী সমাজ অধ্যুষিত এই অঞ্চলগুলিতে হয়ে থাকে। কাজেই এই শালশিরি ঠাকুরকে অরণ্যময় পরিবেশের দেবতা বলে মনে করা যেতে পারে এবং এই দিক থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের পুরুষ দেবতা দক্ষিণরায় এবং বনদেবীর সঙ্গে
আলোচ্য অরণ্য ঠাকুরের ভাবগত সাদৃশ্য থাকতে পারে। আবার রাঢ়অঞ্চলে শালবৃক্ষকে ধর্ম স্বরূপ সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনায় আরাধনা করা হয়।
একটি সুবৃহৎ শালবৃক্ষ ঠাকুরের প্রতিনিধিত্ব করে । শাল গাছের নিচে থান বেঁধে দেবতার পূজা দেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গের ভান্ডানী ঠাকুরকেও মূলত অরণ্য দেবী বলে অনুমান করা যেতে পারে। ভান্ডারী ঠাকুরের মূর্তি পূজা হয়। বনদেবীরও মূর্তি পূজিত হয়। মহাকাল, সোনারায়, দক্ষিণ রায় এনারা হলেন ব্যাঘ্র দেবতা ও অরণ্য দেবতা।শালশিরি দেবতার সঙ্গে ব্যাঘ্র সংস্রব থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারন এই সকল অঞ্চলের বনে জঙ্গলে অরণ্যে একসময় বাঘের ব্যাপক বিচরণ স্থান ছিল।
বনবাসী এবং বনাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা অনেকেই কাঠ কুড়িয়ে, পাতা কুড়িয়ে এবং তা বিক্রয় করে অর্থোপার্জন করে থাকেন। তাই বনে প্রবেশের প্রাক্কালে শালশিরি ঠাকুরকে পূজা দেবার রীতি প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে। বনের দেবতা প্রসন্ন হলে বন্যজন্তু আক্রমণ করতে পারে না , কাষ্ঠ ও বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করতে সুবিধা হতে পারে, এজাতীয় ধারণা প্রাচীন মানুষের মনে থাকা অসম্ভব নয়। অরণ্য প্রান্তিক কৃষক অধিবাসীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে সন্নিকটবর্তী বসতবাটী নির্মাণ করে থাকেন। বনের হিংস্র জন্তু মানুষ ও তার গৃহপালিত পশুর জীবন হরণ করতে যাতে না পারে তার জন্য এমন অরণ্য দেবতার পূজা প্রবর্তিত হয়েছে এবং সুপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। একদা উত্তরবঙ্গের জঙ্গল গুলিতে হাতি , বাঘ, বন্য মহিষ , শূকর, বিষধর সর্প ইত্যাদি ভীষন জন্তুর ভয়ানক উপদ্রবের কথা শুনতে পাওয়া যেত। যদিও বন তাদের নিজেদের জিনিস। মানুষ সেথায় তাদের সম্পত্তিতে অনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করে থাকে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বন কেটে নির্মাণ করা ধানের ক্ষেতে বা বসতিতে খাদ্যের জন্য বনের পশুরা আক্রমন করবে। তাই হয়ত রাজবংশীরা শালশিরি পূজার করতেই পারেন। তাছাড়াও, যে অরণ্য পিতা মাতা স্বরূপ হয়ে বনবাসী মানুষদের সেই প্রাচীন কাল থেকে লালন পালন করে আসছেন সেই অরণ্যের উপাসনা করা একান্তই সনাতনী প্রথা।
সাধারণত অধিকারী ( পুরোহিত) – রা শালশিরি পূজা করে থাকেন । পূজায় আড়ম্বর নয় বরং ভক্তি অধিক থাকে। পূজা উপকরণের মধ্যে ফুল, ধূপ, ধুনা, কলা , আতপ চাল, দুধ, দই, চিনি, বাতাসা, গছা অর্থাৎ মাটির প্রদীপ, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের জন্য সরিষার তেল, সলিতা, সিঁদুর ইত্যাদি সাধারণ পূজার দ্রব্যই ব্যবহার করা হয়। কোথাও কোথাও মোরগ প্রয়োজন হয়। সাধারণত বৈশাখ মাসে এই পূজা সম্পাদন হয়ে থাকে।
শালবনের মাঝে কোথাও একটি সুপ্রাচীন এবং সুবৃহৎ শাল বৃক্ষের নীচে মাটি দিয়ে থান নির্মাণ করা হয়। এই থানেই প্রতি বৎসর পূজা দেওয়া হয়। অধিকারীর সঙ্গে পূজার্থীরা বনে প্রবেশ করে প্রথমে থানটি লেপা মোছা করা হয় এবং আগাছা ইত্যাদি কেটে থানটি পরিষ্কার করা হয়। এরপর যথাবিধি লৌকিক মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজা দান করা হয় ও একটি মোরগ ঠাকুরের নামে সেই থানে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে দুইটি মোরগ ছেড়ে দেবার প্রথা আছে। #দি _রাজবংশীজ_অব_নর্থবেঙ্গল গ্রন্থে বৈকন্ঠপুর জঙ্গলে শালশিরি ঠাকুরের পূজার পূর্বে দুয়ারী ঠাকুর ও কন্ঠ পাল ঠাকুরের পূজার উল্লেখ আছে। কিন্তু অন্যত্র এই সকল সহায়ক দেবতার পূজার প্রচলন থাকতে দেখা যায় না । গ্রন্থটিতে ধামসেবাকে শালশিরি পূজার নামান্তর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে ধামসেবা হলো বিশেষ কোন থানে #সর্বদেবদেবীর পূজা । পূজার সময় রাত্রে গানের আসরেরও ব্যবস্থা করা হয়। দার্জিলিং জেলার তড়াই অঞ্চলে ধাম বলতে একটি বিশেষ আসরে বহু দলের সংগীতে প্রতিযোগিতা কে বোঝানো হয়। এই জাতীয় ধামের সঙ্গে দেবতার পূজার আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকে না।
শ্রী চারুচন্দ্র সান্যাল তার বিখ্যাত গ্রন্থে শালশিরি নামটিকে শালেশ্বরী করেছেন সম্ভবত মার্জিত করার অভিপ্রায় এবং বলেছেন যে নামটি শালেশ্বরী হলেও দেবতাটি স্ত্রী নয় অর্থাৎ শালশিরি একজন পুরুষ দেবতা। কিন্তু স্ত্রী দেবতা না হলে শালেশ্বরীর পরিবর্তে বরং শালেশ্বর হওয়া উচিত ছিল। নামটিতে ঈশ্বরী যুক্ত করেও কেন তিনি পুরুষ দেবতা বলেছেন তার যথেষ্ট যুক্তি বা অনুমান তাঁর গ্রন্থে দেখা যায় না ।কেবলমাত্র নামটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই আমরা শালশিরিকে দেবী বলে গ্রহণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। তাছাড়া এর কিছু কারণ আছে সে ব্যাখ্যায় আমি আসছি।
শালশিরি ঠাকুরকে পুরুষ দেবতা কল্পনা করবার অনুকূলে অনুমান শ্রদ্ধেয় সান্যাল না দিয়ে থাকলেও মনে হয় নিম্নবর্ণিত আবাহন মন্ত্রটি তাঁকে অনুরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করেছে।-
শালশিরি মহারাজা আজল দৈ খপাতি নসাতি ….
গ্রন্থাকার এইভাবে বর্ণনা বা বিন্যাস করেছেন ” শালেশ্বরী মহারাজা আজল দৈ ইত্যাদি “। অর্থাৎ , শালশিরি ও মহারাজা শব্দ দুটিকে পৃথক পৃথক না ভেবে তিনি একটি শব্দে পরিণত করেছেন। ফলত, শালশিরি ঠাকুর মহারাজা হয়ে গেছেন।
আসলে মন্ত্রটিতে শালশিরি মহারাজা আজল দৈ অর্থাৎ আজলদেবী প্রভৃতি গাঁ জঙ্গলের প্রধান এবং অপ্রধান দেবতাকে আবাহন করা হয়েছে। শালশিরি স্ত্রী দেবতা হেতু মহারাজা না হয়ে মহারাণী হত এবং অন্যদিকে শালশিরি পুরুষ দেবতা হলে সেখানে যদি শালেশ্বরীর পরিবর্তে শালেশ্বর মহারাজ কথাটি মন্ত্রে ব্যবহার হত। প্রকৃত পক্ষে মহারাজার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। মহারাজ উত্তর বঙ্গের অপর একটি খ্যাত দেবতা। তবে এটা সঠিক যে , নানা সনাতনী এবং ব্যবহার্য কারণে শাল গাছকে বনের রাজা বলা হয়। তবে এখানে মহারাজা মানে শালকে বোঝানো হয় নি।
আবাহন মন্ত্রটিতে পদবিন্যাসে সামান্য হেরফের থাকার দরুন দেবতাটিকে পুরুষ দেবতা বলে সিন্ধান্ত অন্য একটি মন্ত্রে পদবিন্যাস নির্ভুল হয়েছে। –
“শালেশ্বরী মহামই , গায় গারাম সন্ন্যাসী ঠাকুর তিলমালগুড়ি দেবতাগণ।
নহাই অহেন বাবা।”
শালশিরিকে মহাময়ী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মহাময়ী অর্থাৎ আদি পরাশক্তি মহামায়া। এই মায়ার সংসার তাঁরই ইচ্ছায় চলছে। মন্ত্রটির আক্ষরিক অর্থ বড়ই সহজ।
মহাময়ী শালেশ্বরী, গাঁয়ের গরাম ঠাকুর, সন্ন্যাসী ঠাকুর, ত্রিশাল কোটি দেবতা সকলে তোমরা সহায় থাকবে।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্য : ১.The Golden Bough
২.Tree symbol worship in India
৩.The Rajbanshis of Nort Bengal
৪. Indian Folklore
৫. Cult of Tree Deities of Bengal-