দ্বেষপ্রেমীদের মুখপত্র একটি সংবাদপত্রের ‘দেশদ্রোহী’ সম্পাদকমশাই তাঁর সম্পাদকীয় স্তম্ভে খোলাখুলি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন মোদী জমানায় ‘দেশদ্রোহ’ শব্দটি বিশেষ গৌরববাচক, সুতরাং দেশদ্রোহী তকমায় তারাই খুশিই হবেন। নেহাত ব্যঙ্গার্থে বলা, কিন্তু মনের জানলা তিনি দু’হাট করে খুলে দিয়েছিলেন। এঁদের বৌদ্ধিক তাণ্ডবের মাতব্বরির সাক্ষী হয়ে রইল এবারের বাঙ্গালির নববর্ষ। শোনা যায়, স্বদেশের প্রতি এঁদের যতই বিদ্রোহ বা বিতৃষ্ণা থাকুক না, আন্তর্জাতিকতার প্রতি এঁরা খুবই অনুরক্ত। সেই অনুরাগের বশেই সম্ভবত ‘দেশদ্রোহী’, ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিকতাবাদীরা বাঙ্গালির জাতিসত্তাকে সজীব করে তুলতে চেয়েছেন।
যেমন ধরা যাক বাঙ্গালিরা কেন ভারতবাসী হবেন? বাঙ্গালির একমাত্র ঠাঁই হলো গিয়ে বাংলাদেশ। অথচ কী মুশকিল। দেখুন বাংলাদেশের ‘বাঙালি’ সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি সংস্কৃতি আদপেই মেলে না। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী উভয় বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে মেলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, “রামধনু’কে ‘রংধনু’, ‘প্রণামে’র সঙ্গে ‘সালাম’ ইত্যাদি যোগ করে, তবুও যেন কোথাও অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে। এ রাজ্যের বামমনস্ক তৃণমূলপন্থী বিশিষ্ট ‘বুদ্ধিজীবী’ মহলের এমত পরিস্থিতিতে আর চুপ থাকা সাজে না।
তারা সঠিকভাবেই বিষয়টির মূলে ঢুকে পড়েছেন। বাংলাদেশের প্রকৃত বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবীর একদা বলেছিলেন, রবীন্দ্রসংগীত কেবল বাংলাদেশিদের জাতীয় সংগীত রূপেই রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশিরা ভারতবংশীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার পরিবর্তে আরবীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। তাঁর কথার প্রমাণ দিয়েছিলেন শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ আশরাফ আলি, সিরাজুল ইসলাম, আহমেদ জামালের মতো ইসলামি বুদ্ধিজীবীরা। মূলত তাদেরই আবিষ্কার ছিল মোগল সম্রাট আকবর, কিংবা নিদেনপক্ষে বাংলার আফগান সুলতান হুসেন শাহ-ই ‘বঙ্গাব্দ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। যদিও আকবর-হুসেন শাহ-এর রাজত্ব কমবেশি পাঁচশো বছরের, আর বঙ্গাব্দের প্রাচীনত্ব ১৪২৬ বছরের। হিসেবে জল মানে একবারে সাগর পড়লো একেবারে খোদ হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনাযাত্রা, ইসলামি বর্ষপঞ্জি হিজরির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে। যাইহোক, এপার বাংলার ‘দেশদ্রোহী’ বুদ্ধিজীবীরা যথেষ্ট গর্বের সঙ্গে ওপার বাংলার ইসলামি সংস্কৃতিকে মান্যতা দিয়ে আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এরাজ্যেও চালিয়ে দিয়েছেন।
সত্যিই তো, এই একবিংশ শতাব্দীর ইসলামিক বাংলায় দাঁড়িয়ে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে যদি কারোকে চিহ্নিত করতেই হয়, তবে তো তা অবশ্যই ভারত। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালন করা বাঙ্গালির জাতীয় কর্তব্য। হিন্দু শব্দটি এখানে মহা-ঘৃণিত কোনও সন্দেহ নেই, আরবি-উর্দু অবশ্যই মহা পবিত্র। ১৯৪৬-৪৭-এর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন বলে যাঁরা চিল্লাচ্ছেন, তাঁরা বোধহয় বাঙ্গালির শত্রু, পশ্চিমবঙ্গের জন্মদাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নির্ঘাত মানস-সন্তান, ইসলামিক বাঙ্গলায় এদের ঠাঁই হবে না নিশ্চয়ই।
তবে শুধু বাঙ্গালি ক্যালেন্ডারেই নয়, ইসলামিক বাঙ্গলার মহা শত্রু হিসেবে উদ্ভব হয়েছে রামনবমীর। আমাদের ইসলামপন্থী, বামমার্গী বুদ্ধিজীবীরা এটা বোঝাতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেননি যে ওসব রামনবমী-বৈশাখি বাঙ্গলার ঐতিহ্য নয়। মক্কা-মন্দিনা বরং বাঙ্গলার ঐতিহ্য হতে পারে, রামমন্দির কখনোই নয়। আরবি সংস্কৃতি আমাদের আপন হতে পারে, হিন্দু সংস্কৃতি নয়। সুতরাং কালচার বিগর্হিত কাজ হয়েছে বাঙ্গলায় রামনবমী পালন করতে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গকে যখন ভারতে থেকেই স্রেফ ‘বাংলায়’ পরিণত করার চক্রান্ত চলছে, তখন ‘বাংলা’ ‘বাংলাদেশ’-এ মিশে গেলেই ভারতবর্ষের দেশদ্রোহীদের ‘দেশপ্রেম’ আবার নিশ্চয়ই চেপে উঠবে। ইসলামি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দৌলতে বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদ এখন আরবীয় জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, অনেকটা ‘কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের’ মতোই।
এই পরিস্থিতিতে সচেতন নাগরিকের কিছু দায়িত্ব কর্তব্য থেকে যায়। রামমন্দির যেভাবে একদা বাবরি মসজিদে পরিণত হয়েছিল, আজ রাজা শশাঙ্কের বঙ্গাব্দও ঠিক একইভাবে আকবরের বঙ্গাব্দে পরিণত করার অপচেষ্টা হচ্ছে, পূর্ববঙ্গ যেমন একদা পূর্বপাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ)-এ পরিণত হয়েছিল, আজ পশ্চিমবঙ্গকেও সেইভাবে ইসলামিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। সুতরাং মোদী বিরোধিতা অজুহাত মাত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাও ছল-ছুতো, বাঙ্গালি বাঙ্গলার সংস্কৃতি ভুলে ইসলামের দাসত্ব করুক (তাই বোধহয় ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিতে ইসলামপন্থীদের এত আতঙ্ক), কমিউনিস্ট-ইসলামিস্ট যোগের এই মনোগত ইচ্ছার প্রতিফলন বিজেপি-বিরোধিতার, আর এস এস বিরোধিতার বেড়া দিয়ে আড়াল করতে হচ্ছে। দেশদ্রোহীদের চিনতে আর কারোর বাকি থাকছে না।
বিশ্বামিত্রের কলম