ভারতীয় সভ্যতা ও চৈনিক সভ্যতা সুপ্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও ভারত কখনাে পররাষ্ট্র দখলের মানসিকতা পােষণ করেনি কিন্তু চীন তা বার বার লঙ্ঘন করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে কাশ্মীরের সীমান্ত বিবাদ মূলত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। এবং চীন এখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে প্রবেশ করেছে। অক্ষয় চীন (আকসাই চীন) যা বৃহত্তর কাশ্মীরের অংশ পাকিস্তানও ভারতের মধ্যে ম্যাকমােহন লাইন দ্বারা নির্ধারিত হলেও ভারত-চীন সীমান্ত নিয়ে চীনের ক্রমাগত অবস্থান বদলের পরিণতি ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধ। ১৯৫৬ সালে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে চীন গালােয়ান নদীর পূর্বভাগকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসেবে স্বীকার করে নেয় (Line of actual control)। পশ্চাশের দশকে চীন তিব্বত দখলের পর বেজিং থেকে তিব্বত পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের স্বার্থে লাদাখ ভূখণ্ডের কিছু অংশের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে এবং তার ফলশ্রুতিতে চীন একতরফা ভাবে গালােয়ান নদীর পূর্বপাড়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে গালােয়ান নদীর পশ্চিম পাড়ে স্থানান্তরিত করে। ভারতীয় পেট্রলপােস্ট ঘােষণা করেছিল চীনের কোনাে সেনা ছাউনি এই অঞ্চলে দেখা যায়নি। এম আই টি-র অধ্যাপক এম টেলার ফ্রাবল অভিমত ব্যক্ত করেন, “চীন বেজিং-তিব্বত সড়ক সুরক্ষার স্বার্থে পশ্চিম সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে”।
| ১৯৬২ সালে চীন ভারতের ভূখণ্ডে ভারতের অধিকারকে অস্বীকার করতে শুরু করে যার পরিণতি হিসেবে ভারতীয় ভূখণ্ডে দেশের পরিকাঠামাে উন্নয়ন ও উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত করতে চীন বদ্ধপরিকর হয়। পাকিস্তান নিজের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে ১৯৬৩ সাল থেকে ট্রান্স-কারাকোরাম সড়ক ও অক্ষয় চীনে চীনের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়েছে। কাশ্মীর ভূখণ্ডে ৫৫ শতাংশ জমি ভারতের মধ্যে, ৩০ শতাংশ পাকিস্তানের দখলে এবং ১৫ শতাংশ চীনের দখলে। পাকিস্তান কেবলমাত্র ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করেনি, বরং অবৈধ দখলীকৃত জমির কিছু অংশ চীনকে ব্যবহার করতে দিয়ে এই উপমহাদেশের শান্তি ও সুস্থিতিকে ক্রমাগত বিপন্ন করে তুলেছে। জে এন ইউ-এর আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক হ্যাপিমন জেকভ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, “চীন পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডাের নির্মাণে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়ােগ করেছে। গত বছরে ভারত নিজ ভূখণ্ডে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার খুব কাছে। সব আবহাওয়ার অনুকুল সড়ক নির্মাণ করেছে। লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ মন্তব্য করেন, “পূর্বে চীন নিজ ভূখণ্ডে সামরিক প্রয়ােজনে পরিকাঠামােকে উন্নত করেছে কিন্তু বর্তমানে ভারত সীমান্তরেখা বরাবর পরিকাঠামাে আধুনিকীকরণে ব্রতী হয়েছে”। | ২০১৭ সালে ডােকলাম নিয়ে সীমান্ত সমস্যা পরিকাঠামাের উন্নয়নেরই ফলশ্রুতি। ২০২০-তে লাদাখের গালােয়ান উপত্যকায় চীনা সৈন্যের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সেনা যা পরবর্তী সময়ে সীমান্ত সংঘর্ষের রূপ নেয় যাতে ১ ভারতীয় সেনা অফিসার-সহ ২০ জন জওয়ান শহিদ হন এবং ১ জন অফিসার সহ ৪৩ জন হানাদার চীনা সেনা নিহত হয়। তা ঘটে ৬ জুনের কোর কমান্ডার পর্যায়ের মিটিং হওয়ার পরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী বেজিংকে হুঁশিয়ারি দিয়ে যথার্থই বলেছেন, “ভারত শান্তি চায় কিন্তু প্ররােচনার জবাব দিতে তৈরি।। | চীন ভুলে গেছে তারা যেমন সামরিক শক্তিতে পৃথিবীর তৃতীয় শক্তিশালী দেশ, তেমনি ভারতও চতুর্থ শক্তিশালী দেশ। শক্তির সূচকের নিরিখে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় রাশিয়া, তৃতীয় চীন, চতুর্থ ভারত ও পঞ্চম জাপান। মনে রাখা প্রয়ােজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক চীনের থেকে অনেক বেশি মধুর। চীন পৃথিবীর প্রথম জনবহুল দেশ (১৪৩ কোটি) ও ভারত দ্বিতীয় জনবহুল দেশ (১৩৬ কোটি)। ভারতের সেনা সংখ্যা ২১ লক্ষ ৪০ হাজার ও চীনের ৩৪ লক্ষ। প্রতি বছর সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণকারী যুবক-যুবতীর নিরিখে ভারতবর্ষ যুক্ত করতে পারে ২ কোটি ৩০ লক্ষ যা চীনের ক্ষেত্রে ১ কোটি ৯০ লক্ষ। ভারতে বিধ্বংসী ট্যাঙ্কোর সংখ্যা ৬৪৬৪ এবং চীনের ৯১৫০। ভারতের মিসাইলের সংখ্যা ৫০০০, চীনের ১৩০০০। পারমাণবিক বােমা ভারতের ১২০-১৩০টি, চীনের ক্ষেত্রে তা ২৭০ থেকে ৩০০টি। মনে রাখতে হবে যে, ভারতের যুব জনসংখ্যা চীনের নিরিখে অনেক বেশি, যা ভারতের এক বড়াে শক্তি। করােনাবৃত পৃথিবীর কারণ হিসেবে চীন আজ সকল দেশের কাছে।
নিন্দিত, কেবল পাকিস্তান ব্যতিরেকে। সর্বোপরি আত্মনির্ভর ভারতের দেশপ্রেমিক জনগণ কালক্রমে অজস্র বহিরাক্রমণকে প্রতিহত করেছে। পার্টি সর্বস্য একনায়কতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে পৃথিবীর কোনাে শক্তি কখনাে দেশপ্রেমকে প্রতিহত করতে পারেনি ও ভবিষ্যতেও তা পারবে না। দেশপ্রেমের হােমানলে চীনের এই আগ্রাসন প্রতিহত হবেই। ২০২০-র নতুন ভারত নরেন্দ্র মােদীর নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের এই গ্রহণযােগ্যতাকে খাটো করে ১৯৬২ সালের গ্লানি আর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সূত্র : বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
ড. পঙ্কজ কুমার রায়
(লেখক কলকাতার যােগেশ চন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ)