মানবজাতির স্বার্থে চীনের সঙ্গে লড়াইটা জেতা অত্যন্ত প্রয়োজন

ভারতীয় সেনাকে আক্রমণ করে চীন একটা মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। অস্তিত্বসংকট হলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে। , অনেক সময় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আজ একদম খাদের কিনারে এসে পৌঁছে গেছে, যে কোনো সময় তার পতন ঘটতে পারে। এমনিতেই চীনা ভাইরাসের দৌলতে পৃথিবী জুড়ে যে অতিমারীর প্রকোপ চলথে তাতে প্রতিটি দেশ চীনের ওপর তথ্য গোপন করার কারণে অত্যন্ত বিরক্ত। চীনের বন্ধু বলতে গুটিকতক মাত্র দেশ রয়ে গেছে, যারা আর্থিক কারণে তার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার জেরে চীনের হাজার হাজার কোটি ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভমুখ থুবড়ে পড়েছে। ঋণ শোধ না করতে পারার ফলে যে সব দেশের জাতীয় সম্পত্তির ওপর চীন থাবা বাড়িয়েছিল, সেসব দেশের মানুষও খেপে গিয়ে তাদের নিজেদের সরকারের ওপর চুক্তি বাতিল করকার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে। তার ওপর চীনের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। কয়েকবছর ধরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার যেমন যেমন কমেছে সেই অনুপাতে বেরোজগারি এবং গরিবিও বেড়েছে। চীনের গ্রামে গ্রামে আজ অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। বিদ্রোহী হংকং অশান্ত, তাইওয়ান ঘাড়ের ওপর বসে রোজ বিদ্রুপ করছে আর উইঘুরে হাজার চেষ্টা করেও ধর্মীয় ভাবাবেগ রোখা যাচ্ছে না। উপরন্তু চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বসে থাকার পর প্রধানমন্ত্রী লি কিউয়াং এবং কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য প্রভাবশালী নেতারা মন থেকে তা মেনে নিতে পারছেন না।

এমতাবস্থায়, চীনা শাসকগোষ্ঠী নিজের দেশের মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য। জাতীয়তাবাদের আঁচলে মুখ লুকাতে চাইছে। সাউথ চায়না সিতে নৌসেনা পাঠিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভয় দেখাতে চেয়ে এখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তাদের সমর্থনে আমেরিকা তিন তিনখানা যুদ্ধবিমানবাহী রণপোত পাঠিয়ে ওখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভারত যেহেতু চিরকাল সৌহার্দ্য ও আলাপ আলোচনায় বিশ্বাসী, তাই চীন ভেবেছিল ভারত বুঝি নরম মাটি। ওরা আস্ফালন করবে আর ভারত প্রতিদানে শান্তিপ্রস্তাব দেবে, দেশের লোকের সামনে শি জিনপিং হিরো হবেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, ১৯৬২-র যুদ্ধে নেহরু ভারতীয় সেনার হাত-পা বেঁধে রেখেছিলেন, অস্ত্র ছিল না, বিমানবাহিনীকে উড়তেই দেননি, তাই চীন আকসাই চীন দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। নেহরু নিজের সেনাবাহিনীকে ভয়। করতেন আর নিজেকে বিশ্বস্তরের নেতা মনে করতেন, দুটোই ছিল মস্ত বড়ো ভুল। আজকের ভারত কিন্তু নেহরুর ভারত নয়, মোদীর ভারত। এই সরকার সেনাকে সম্মান করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তার ওপর নির্ভর করে। সেনাকে নিজের প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্ত নিজেই নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আর সরকার সর্বক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বাহিনীকে মদত করছে। বাহিনীর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগবিধিও যে বদলে গেছে, এটা যেন চীন বিস্মৃত না হয়।

চীন গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের বর্তমান সীমান্তরেখার ওপর ভারতীয় সেনার কুড়িজন সৈন্যকে হত্যা করে মারাত্মক ভুল। করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন এই বলিদান বিফলে যাবে না তখন চীনের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেননি এবং সবদিক না ভেবে তিনি কখনোই কিছু বলেন না। ১২৫ কোটি ডলারের চীনা। বিনিয়োগ সম্পন্ন প্রস্তাবিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরটি নেহরুর আমলে চীনের দখল করা ভারতীয় আকসাই চীন এলাকা এবং পাকিস্তানের দখল করা ভারতীয় গিলগিট-বালতিস্তান ও কাশ্মীর উপত্যকার । কিছু অংশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে এই দখল হয়ে যাওয়া এলাকা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিছুদিন আগেই ভারত এই গোটা অঞ্চলের নতুন মানচিত্র। প্রকাশ করেছে। ব্যাপারটা হয়তো আরও কিছুদিন বৌদ্ধিক আলোচনার স্তরে সীমাবদ্ধ থাকতো। খুঁচিয়ে ঘা করতে গিয়ে চীন সেটাকে একেবারে সামরিক সংঘর্ষের জায়গায় এনে ফেললো। এতে আখেরে ভারতে লাভ এবং চীনের প্রভূত ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।

অনেকেই বলেন চীনের যা সামরিক শক্তি, তার সঙ্গে এঁটে ওঠা দুষ্কর, কারণ ভারত অনেক পিছিয়ে আছে। হ্যা, সংখ্যার দিক দিয়ে হয়তো আমরা খানিকটা পিছিয়েই আছি। কিন্তু যুদ্ধে সংখ্যাই যে সব নয়, বাহিনীর গুণগতমান এবং যুদ্ধকৌশল সম্বন্ধীয় ব্যুৎপত্তি যে অনেক বেশি কার্যকর, সেটা যাঁরা যুদ্ধ বোঝেন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। চীনের ভূভাগ ভারতের প্রায় তিনগুণ। স্বভাবতই তাদের সৈন্যসংখ্যা এবং সাজসরঞ্জামও ভারতের চেয়ে বেশি। কিন্তু চীনের পক্ষে সমস্ত সীমান্ত অরক্ষিত রেখে একদিকে মনোনিবেশ করা সম্ভব নয়, কারণ সত্যিই যদি ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ লাগে, এত শত্রু ওরা চারপাশে সৃষ্টি করেছে যে সেক্ষেত্রে একসঙ্গে নানা ফ্রন্ট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল, যা চীন সামলাতে পারবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে, চীন জীবনে কোনো যুদ্ধ জেতেনি। বাষট্টির যুদ্ধেও জেতেনি, কারণ নেহরুর ভুল পলিসির জন্য ভারত হেরে গিয়েছিল, তাতে চীনের বিন্দুমাত্র শ্রেয় ছিল না। ১৯৭৯ -এ ভিয়েতনামের মতো একটা ছোটো গরিব দেশ পর্যন্ত চীনা সৈন্যবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল, এতটাই যে তারপর থেকে চীন আর কোনো যুদ্ধই করেনি।

চীনা সৈন্যরা সব এক সন্তান পলিসির ফসল, আলালের ঘরের দুলাল। মাত্র ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণের পর দু’বছরের বাধ্যতামূলক পরিষেবা দিতে সৈন্য সাজে, তুলনামূলকভাবে নিয়মিত সেনার সংখ্যা অনেক কম। এরা পাহাড়ের যুদ্ধ, মরুভূমির যুদ্ধ, ছায়াযুদ্ধ, মানসিক যুদ্ধ কোনো কিছুতেই তেমন পারদর্শী নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, চীনা সৈন্যবাহিনী কোনো কঠিন পরীক্ষায় কোনোদিন উত্তীর্ণ হয়নি। ১৯৬৭-তে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে এমন মার খেয়েছিল যে আর দ্বিতীয়বার ওমুখো হয়নি। অন্যদিকে ভারতীয় সেনা পুরোটাই পেশাদার, জন্মলগ্ন থেকে যুদ্ধ করতে করতে সদাপ্রস্তুত, নির্ভয়, কৌশলী, সক্ষম এবং প্রত্যয়ী। ভারতীয় সেনা হারতে জানে না, তারা শত্রুর ঘরে ঢুকে নির্বিঘ্নে তাদের মেরে দিয়ে আসে। যে কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সেনাকে যেতে হয় এবং সেনাবাহিনীতে ক্রমাগত যে ধরনের অনুশীলন চলতে থাকে তাতে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এখানে প্রত্যেক নাগরিকের প্রাণের দাম আছে। ভারতীয় সেনার নিজস্ব মর্যাদা আছে, পরম্পরা আছে, ঐতিহ্য আছে। ভারত চীন নয়। আর ভারতীয় সেনাও কেবল কুচকাওয়াজপটু চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি নয়। ভারতীয় সেনা যে কাজে হাত দেন, সেটা শেষ না করে ছাড়েন না।

তবে একটাই জায়গায় আমরা কমজোর।

চীনে একজনও ভারতপন্থী নেই অথচ ভারতে বহু চীনপন্থী আছে। শুধু চীন নয়, পাকিস্তানপন্থীও আছে বিস্তর। আর এরা পাড়ার চায়ের দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর হয়ে সংবাদমাধ্যমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণপোকার মতো ছেয়ে আছে। চীনের মতদপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও দলনেতারও অভাব নেই আমাদের দেশে। আমাদের দেশের বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ব্যবহার করে চীন বহুদিন ধরে এখানে সরকারবিরোধী জায়তাবাদবিমুখী একটা বাতাবরণ সৃষ্টিকরতে চাইছে, যা সফল না হলেও দেশের অগ্রগতিকে খানিকটা ব্যাহত নিশ্চয় করেছে। আমাদের চরিত্রগত চরম সহিষ্ণুতা পক্ষান্তরে দেশের ভেতরে বসে থাকা এই ভারতবিদ্বেষী শক্তিকে খানিকটা পুষ্টই করেছে। সেনাবাহিনী সীমান্তে তাদের কাজ করবেন ঠিকই কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে লড়াই তো শুধু সীমান্তে নয়, দেশের ভেতরেও।

যেদিন কিছু রাজনৈতিক দল অস্তিত্বহীন হবে, কিছু সম্পাদক গ্রেপ্তার হবেন, কিছু অধ্যাপকের চাকরি যাবে, কিছু চীনা দালালকে প্রকাশ্যে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে পুলিশ জেলে নিয়ে যাবে, সেদিন কিন্তু আমাদের সত্যিকারের শুদ্ধিকরণ শুরু হবে। চীনের বিরুদ্ধে লড়াইটা মূলত একটি স্বৈরাচারী আত্মকেন্দ্রিক অমানবিক মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই। গোটা মানবজাতির স্বার্থে এই লড়াইটা জেতা অত্যন্ত প্রয়োজন।

সঞ্জয় সোম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.